শিরোনাম
শুক্রবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১৬ ০০:০০ টা

বিদ্যুৎ-পানি সংকটে নাকাল জনজীবন

শুক্রবারের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক : প্রতিমন্ত্রী

জিন্নাতুন নূর

তীব্র গরমে একদিকে জনজীবন যখন হাঁসফাঁস করছে তখন মানুষের ভোগান্তিকে আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে মাত্রাতিরিক্ত লোডশেডিং আর পানির সংকট। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা শহর ও গ্রামগুলোতে এখন ঘণ্টায় ঘণ্টায় বিদ্যুৎ বিভ্রাট ও লোডশেডিং হচ্ছে। দিনে-রাতে হওয়া এই বিদ্যুৎ সমস্যার কারণে গ্রাহকদের চরম সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। কয়েক দিন ধরে নৌযান শ্রমিকদের ধর্মঘটের কারণে তেলের অভাবে সারা দেশে ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উত্পাদন ব্যাহত হয়। নৌযান শ্রমিকদের ডাকা ধর্মঘট স্থগিত হওয়ায় আজ শুক্রবারের মধ্যে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। অন্যদিকে গ্যাস সংকটের ফলে এবার গ্রীষ্মে কিছুটা হলেও গ্রাহকদের বিদ্যুৎ বিভ্রাটের জন্য কষ্ট পেতে হবে বলে আশঙ্কা করছেন প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, শুধু জ্বালানি (তেল-গ্যাস) সংকটের জন্য গত কয়েক দিন আড়াই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উত্পাদন কম হয়েছে। অন্যদিকে গরমে পানির চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং লোডশেডিংয়ের কারণে পাম্প বন্ধ থাকায় তীব্র সংকটে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে নগরবাসীর স্বাভাবিক জীবন।

নসরুল হামিদ গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘নৌযান শ্রমিকদের ধর্মঘটের কারণে গত কয়েক দিন তেল না পাওয়ায় ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম উত্পাদিত হয়। তেলের অভাবে অনেক পাওয়ার প্লান্টই আমরা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হই। এ ছাড়া গ্যাসের অভাবে এখন প্রায় এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম উত্পাদিত হচ্ছে।’ বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘বর্তমানে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে প্রায় ৯ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু সরবরাহ হচ্ছে ৮ হাজার মেগাওয়াট। ৯ হাজার মেগাওয়াট উত্পাদন-ক্ষমতা থাকলেও জ্বালানি ঘাটতির কারণে তা করা যাচ্ছে না। নৌযান ধর্মঘটের কারণে সাগরে ৭০টি জ্বালানি তেলবাহী জাহাজ ভেসে ছিল। আর ধর্মঘট স্থগিত হওয়ার পর জাহাজ থেকে ডিপো হয়ে তেল বিদ্যুেকন্দ্রে পৌঁছাতে কমপক্ষে দুই দিন লাগবে। আশা করছি শুক্রবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।’ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২৪ এপ্রিল দেশে মোট বিদ্যুতের চাহিদা ছিল আট হাজার ৪০০ মেগাওয়াট। এদিন লোডশেডিং হয় ৫৪৩ মেগাওয়াট। ২৫ এপ্রিল মোট চাহিদা ছিল আট হাজার ৩০০ মেগাওয়াট আর লোডশেডিং হয় ৬৫১ মেগাওয়াট। ২৬ এপ্রিল বিদ্যুতের চাহিদা ছিল আট হাজার ৩০০ মেগাওয়াট আর লোডশেডিং হয় ৭০৭ মেগাওয়াট। এ ছাড়া ডিপিডিসি ও ডেসকো এই দুই বিদ্যুৎ বিতরণকারী সংস্থার গত কয়েক দিনে মোট লোডশেডিং হয় ৩০০ মেগাওয়াট। ২৭ এপ্রিল ৬০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ ঘাটতি ছিল। তবে গতকাল লোডশেডিংয়ের মাত্রা কিছুটা কমে আসে। এদিন চাহিদা ছিল ৭ হাজার ৫৭৩ মেগাওয়াট আর সারা দেশে ঘাটতি ছিল ২৯১ মেগাওয়াট। গতকাল গ্যাস, বিদ্যুৎ ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে দেশের কিছু স্থানে লোডশেডিংয়ের কথা স্বীকার করা হয়। এতে বলা হয়, বিদ্যুৎ বিভাগসহ নিয়ন্ত্রণাধীন সংস্থা সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতি শিগগিরই স্বাভাবিক হবে বলে তাদের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রীষ্মে বিদ্যুতের চাহিদা সাড়ে আট হাজার থেকে নয় হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যায়। ফলে আসছে দিনগুলোতে জ্বালানি সংকটের সমাধান না করতে পারলে বিদ্যুতের সংকট আরও বাড়বে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এখন দিনে-রাতে কয়েকবার লোডশেডিং হচ্ছে। মিরপুর পল্লবী এলাকার বাসিন্দা নাদিয়া আক্তার বলেন, বিদ্যুৎ না থাকায় মোটর দিয়ে পানি তুলতে পারছেন না। ফলে প্রতিদিনই গোসল ও রান্নার কাজে সমস্যা হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দিনে তিন থেকে চারবার লোডশেডিং হচ্ছে। এমনকি রাতেও লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণা থেকে রেহাই মিলছে না। তবে শহরের তুলনায় জেলা শহর ও গ্রামাঞ্চলে এ সমস্যা বেশি হচ্ছে। গ্রামে বিদ্যুৎ একবার চলে গেলে টানা কয়েক ঘণ্টা দেখা মিলছে না। গাইবান্ধার পলাশবাড়ী থেকে পল্লীবিদ্যুতের এক গ্রাহক বলেন, ‘আমাদের এখানে দিনে-রাতে বেশ কয়েকবার করে লোডশেডিং হচ্ছে। একবার বিদ্যুৎ গেলে তা কয়েক ঘণ্টা পর ফিরছে।’ তবে জ্বালানি তেলের বাইরে গরমে আরও কিছু কারণে বিদ্যুৎ সংকট দেখা দেয়। সংশ্লিষ্টরা জানান, গরমে বাসা-অফিসে বিভিন্ন শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র চলার কারণে বিদ্যুতের চাহিদাও বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া গরমে বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার নষ্ট হয়ে যায়। ফলে বিদ্যুৎ সরবরাহে সমস্যা দেখা দেয়। বিদ্যুৎ বিভাগের দেওয়া তথ্যে, গত দুই-তিন সপ্তাহ তাপমাত্রা অতিরিক্ত বৃদ্ধির ফলে বিদ্যুতের উত্পাদন কেন্দ্র, বিতরণ ও সঞ্চালন ব্যবস্থা উত্তপ্ত হয়ে এগুলোর দক্ষতা কমে যাচ্ছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানি বিষয়ক বিশেষ সহকারী ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ম তামিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মার্চ-এপ্রিল এ দুই মাস বছরের সবচেয়ে বড় ফসল বোরো ধানের উত্পাদন হয়। আর সেচের কারণে এ সময় বিদ্যুতের চাহিদাও বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া এ সময় এসি ও ফ্যানের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে না পারলে লোডশেডিং বাড়ে। সাধারণত গ্রীষ্মে শুধু এসি ব্যবহারেই এক হাজার মেগাওয়াট বাড়তি বিদ্যুতের চাহিদা তৈরি হয়। এ ক্ষেত্রে অপচয় রোধ করতে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী ফ্যান ও এসি ব্যবহারের পরামর্শ দেন ম তামিম। তার মতে, বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে আরও সাশ্রয়ী বিদ্যুেকন্দ্র প্রয়োজন। এদিকে গরম শুরু হওয়ার আগে থেকেই নগরীর পানি সংকট এখন মারাত্মক রূপ নিয়েছে।

নগরীর রামপুরা, মিরপুর, হাজারীবাগ, মগবাজার, মোহাম্মদপুর, গেণ্ডারিয়া, আজমপুর, কলাবাগান, ইন্দিরা রোড, কাঁঠালবাগান, লালমাটিয়া, ধানমন্ডিসহ পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় পানির সংকটে ভুগছেন মানুষ। ওয়াসা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, লোডশেডিংয়ের কারণে তাদের পাম্পগুলো বন্ধ থাকায় এ সমস্যা তীব্র হচ্ছে। প্রতি বছর মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত সময়ে গরমের জন্য পানি সংকট দেখা দেয়। ঢাকায় এখন ওয়াসা ৫৯৯টি গভীর নলকূপ ও চারটি পানি শোধনাগারের মাধ্যমে দৈনিক ২১৫ থেকে ২৩৫ কোটি লিটার চাহিদার বিপরীতে গড়ে ২১৪ থেকে ২২৪ কোটি কোটি লিটার পানি সরবরাহ করছে।

 

সর্বশেষ খবর