বুধবার, ৪ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

মৃত্যুর সঙ্গে বসবাস রেল বস্তিতে

নিজস্ব প্রতিবেদক

মৃত্যুর সঙ্গে বসবাস রেল বস্তিতে

রেললাইনের ওপর ঝুঁকি নিয়ে চলে দোকানপাট —বাংলাদেশ প্রতিদিন

রাজধানীতে রেললাইন-ঘেঁষা বস্তিবাসীর জন্য ট্রেন যেন ‘মৃত্যুদূত।’ প্রতিনিয়ত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাসকারীরা প্রায়ই ট্রেনের চাকায় কাটা পড়েন— এদের কেউ কেউ মারা যান, আবার অনেকেই আজীবনের জন্য পঙ্গুত্বের শিকার হন। এত যে জীবনের ঝুঁকি, তবু রেললাইন-ঘেঁষা বস্তিসমূহে কয়েক হাজার মানুষ বছরের পর বছর ধরে বসবাস করছে। ট্রেনের হুইসেল শুনলে তারা আঁতকে উঠেন, ব্যস্ত হয়ে পড়েন নিজ নিজ শিশুসন্তানদের খোঁজে। গেণ্ডারিয়া রেলক্রসিং সংলগ্ন বস্তিতে বাস করেন প্রায় আড়াইশ পরিবারের সহস্রাধিক মানুষ। সেখানেই বসবাস জমিলা বেগমের। গেণ্ডারিয়া এলাকাতেই ঠিকা ঝিয়ের কাজ করে সংসার চালান তিনি। কাজ শেষে ঘরে ফিরতে প্রায়ই তার রাত ১০টা বেজে যায়। প্রতি রাতেই ঘরে ফেরার সময় তিনি উৎকণ্ঠায় থাকেন- তার পঙ্গু স্বামী ও সন্তানদের সুস্থ দেখতে পাবেন তো? জমিলা বেগমের মতো উদ্বিগ্ন বাসিন্দারা তাই রেললাইনের ওপর লাল ব্যানার টাঙিয়ে রাখেন নিত্যদিন। লাল কাপড়ের ব্যানার দেখে ট্রেন চালক ধিরে সুস্থে চালাবেন- এমনটাই বিশ্বাস করেন রেলবস্তির বাসিন্দারা। তবু দুর্ঘটনা তাদের পিছু ছাড়ে না, মাঝে মধ্যেই রেল চাকায় কাটা পড়ার নির্মমতারও শিকার হন তারা। পাঁচ বছরের মেয়ে আকলিমা। রেললাইন থেকে তিন হাত দূরেই এক খুপরি ঘরে সাত বছর ধরে সে মা-বাবার সঙ্গে বাস করে। এক সকালে সে খেলতে গিয়ে রেললাইনের ওপর ওঠে পড়ে। এ সময় চট্টগ্রামগামী মহানগর প্রভাতী ট্রেনের চাকায় দুই হাত কাটা পড়ে তার। প্রায় আড়াই মাস হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ায় আকলিমার জীবন বাঁচলেও দুটি হাত ছাড়াই তাকে ফিরে যেতে হয় অভিশপ্ত রেলবস্তিতেই।

শুধু গেণ্ডারিয়ায় নয়, খিলগাঁও রেলক্রসিং সংলগ্ন বস্তিতেও বসবাস করেন পাঁচ শতাধিক মানুষ। সেখানে বস্তির আশপাশে ট্রেনের চাকায় কাটা পড়ে মৃত্যুর ঘটনা বাসিন্দাদের কাছে নতুন কিছু নয়। সম্প্রতি এ বস্তিরই বাসিন্দা সোহাগ নামে ছয় বছরের শিশু ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যায়। সোহাগ মা-বাবার সঙ্গে রেললাইন-ঘেঁষা বস্তিঘরে বাস করত। রেললাইনের অপর পাশেই থাকত তার ফুফু খোদেজা বেগম। ট্রেনের ধাক্কায় আহত নেত্রকোনার সেলিম মিয়ার (৩০) দিন কাটে অর্ধাহারে অনাহারে। এক বছর আগে রাত ১১টার দিকে ঘরে ফেরার সময় ট্রেনের ধাক্কায় তিনি আহত হন। তার দুই পা ভেঙে যায়। এ পর্যন্ত তার চিকিৎসা বাবদ খরচ হয়েছে প্রায় ৭০ হাজার টাকা। শেষ সম্বল গ্রামের ভিটেমাটি বিক্রি ও লোকজনের সাহায্য নিয়ে কিছু টাকা জোগাড় করলেও সেলিম মিয়া তা পরিবারের খাওয়া-দাওয়ার পেছনে ব্যয় করতে বাধ্য হন। ফলে আর নিজের চিকিৎসা করাতে পারেননি তিনি। সায়েদাবাদ টার্মিনাল সংলগ্ন রেলবস্তিতে বসবাস করেন চা বিক্রেতা সুলতান মিয়া (৩৫)। তিনি জানান, তার ছেলে রবি (৪) খেলতে গিয়ে রেললাইনের ওপর পা পিছলে পড়ে যায়। এ সময় কমলাপুর স্টেশনের দিক থেকে আসা মালগাড়ির (ট্রেন) ধাক্কায় তার মাথা বিপজ্জনকভাবে ফেটে যায়। সুলতান মিয়া জানান, ভাগ্য ভালো বলে ছেলেটার জীবন রক্ষা পেয়েছে।

পঙ্গু সনু মিয়ার ছেলে মঞ্জিলেরও (২) জীবনে এমন ঘটনা ঘটেছে। দুই মাস আগে ট্রেনের বগির ধাক্কায় তার মাথা ফেটে যায়। প্রচণ্ড রক্তপাতের কারণে গুরুতর অসুস্থ হয়ে ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে মঞ্জিল। তার চিকিৎসা করার কোনোরকম সাধ্য নেই সনু মিয়ার। সনু মিয়া বলেন, ১১ বছর আগে তার নিজের বাম পা রেল চাকায় কেটে যায়। তখন থেকেই তিনি পঙ্গুত্ব বরণ করে আছেন। এদিকে রেললাইন-ঘেঁষা বস্তির লোকজন রেলের চাকায় কাটা পড়ে আহত হলেও রেল কর্তৃপক্ষ তাদের জন্য কোনোরকম চিকিৎসার ব্যবস্থা নেয় না। বরং আহত ব্যক্তির বিরুদ্ধেই উল্টো জিআরপি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি লিপিবদ্ধ করে রাখা হয় বলে জানা গেছে। রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানান, প্রতি মাসেই দু-একবার বস্তি উচ্ছেদ করা হয়। কিন্তু উচ্ছেদের কয়েক ঘণ্টা পর আবার বস্তিবাসীরা ঘর তোলে। পলিথিন ও বাঁশের তৈরি এসব ঘর সহজেই বানানো যায়। বস্তিবাসীরা জানিয়েছেন, তাদের ঘরভাড়া করে থাকার সামর্থ্য নেই বলেই তারা ঝুঁকির মধ্যে বাস করতে বাধ্য হচ্ছেন।

সর্বশেষ খবর