শনিবার, ৭ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত সুন্দরবনের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

নিজামুল হক বিপুল ও শেখ আহ্সানুল করিম, সুন্দরবন থেকে ফিরে

আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত সুন্দরবনের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

দফায় দফায় আগুনের ঘটনায় বিপন্ন ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন। বিপন্ন সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরিবেশ, ঝুঁকির মুখে বনের জীববৈচিত্র্য। একই সঙ্গে সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল লক্ষাধিক জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকাও। সুন্দরবনের গভীরে কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণ নিতেই স্থানীয় প্রভাবশালীরা আগুন লাগাচ্ছে। সুন্দরবনের ভিতরে মিঠা পানির মাছ আহরণের জন্য প্রভাবশালীরা বন বিভাগের সংশ্লিষ্ট রেঞ্জের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা কর্মচারীর সঙ্গে যোগাসাজশ করে বনের নিয়ন্ত্রণ নিতে আগুন দেয়। প্রায় প্রতি বছর সুন্দরবনের মতো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজে আগুন লাগার ঘটনা ঘটলেও এসব ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কখনই ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এমনকি এসব ঘটনায় আগে কোনো মামলাও হয়নি। তবে এবারই প্রথম আগুনের ঘটনায় সুন্দরবন বিভাগ ৩টি মামলা দায়ের করে। সরেজমিন অনুসন্ধান এবং স্থানীয় প্রশাসন ও বন বিভাগের কাছ থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় স্থানীয় প্রভাবশালীরা জড়িত। যারা আবার স্থানীয়ভাবে সরকার সমর্থিত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ওই প্রতিবেদনেই স্থানীয় প্রশাসন, সুন্দরবন রক্ষায় ৯টি সুপারিশ করেছে। একই সঙ্গে সুন্দরবনে বার বার আগুন লাগার ঘটনা অভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞদের দ্বারা অধিকতর তদন্ত করার কথা বলেছে। এ দিকে আগুনের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার এজাহারভুক্ত আসামিদের না ধরে পুলিশ এলাকার নিরীহ লোকজনদের হয়রানি করছে বলে অভিযোগ করেছেন এলাকাবাসী। এর ফলে পুরো এলাকা পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে। জীবিকার সন্ধানে তারা সুন্দরবনের ভিতরে যাওয়ার পরিবর্তে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন পুলিশের গ্রেফতার এড়াতে। মাত্র এক মাসের ব্যবধানে পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশন এলাকায় গভীর বনে চার দফা অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। প্রথম অগ্নিকাণ্ডটি ঘটে গত ২৭ মার্চ। এর ১৬ দিনের মাথায় ধানসাগর স্টেশনের পচাকোড়ালিয়া নল বনে আগুন লাগানো হয় ১৩ এপ্রিল। ১৮ ও ২৭ এপ্রিল আগুন লাগানো হয় একই রেঞ্জের আব্দুল্লার ছিলা ও তুলাতলা নামক এলাকায়। সুন্দরবনের গভীরে আগুন লাগানোর এসব ঘটনার বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য পাওয়া গেছে।

সরেজমিন জানা গেছে, চাঁদপাই এবং শরণখোলা রেঞ্জের শরণখোলা ও মোরেলগঞ্জে উপজেলার বন সংলগ্ন লোকালয়ের পাশ দিয়ে প্রবাহিত ভোলা নদী ও শাখা খালসমূহ ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে সুন্দরবনের পূর্ব অংশের চাঁদপাই রেঞ্জের অনেক এলাকাজুড়ে পলি পড়ে উঁচু হয়ে যায়। এ কারণে চাঁদপাই রেঞ্জ এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়ে বন মরে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে অন্তত ২০টি বিলের সৃষ্টি হয়। এসব বিলে গত কয়েক বছরে মিঠা পানির বিভিন্ন প্রজাতীর প্রচুর মাছ হচ্ছে। সুন্দরবনের ভিতরে সৃষ্টি হওয়া এসব বিলে বৈধভাবে মিঠা পানির মাছ চাষ ও এককভাবে তা আহরণের কোনো সুযোগ নেই। তবে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সরকার সমর্থক ৩/৪টি গ্রুপ সুন্দরবনের অসাধু কর্মকর্তাদের কাছ থেকে অর্থের বিনিময়ে এসব বিল দখলে নেয়। স্থানীয়রা বলছেন, বনবিভাগের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে হাত করে প্রভাবশালীরা বর্ষা মৌসুমে সুন্দরবনের এসব এলাকায় মাছধরা নিয়ন্ত্রণ করে এবং বনের ওপর আধিপত্য ধরে রাখার কৌশল হিসেবে বার বার আগুন দেয়। শরণখোলা বাজারে কথা হয় স্থানীয়দের সঙ্গে। এদেরই কয়েকজন জানান, কথিত ইজারার নামে দখলে নেওয়া পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জের এই বিলগুলোতে কৈ, শিং, মাগুর, কানমাগুর, ফলি মাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির মিঠা পানির মাছ চাষ ও আহরণ করে থাকে প্রভাবশালীরা। আর এই মাছ চাষ ও আহরণের জন্য প্রতি বছর শুকনো মৌসুমে মাছের বিল ও জাল পাতার স্থান পরিষ্কার করতে পরিকল্পিতভাবে সুন্দরবনে আগুন দিয়ে থাকে।  স্থানীয়রা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরে প্রায় নিয়মিতই সুন্দরবনে আগুন লাগানো হচ্ছে। আর সুন্দরবনে ঘন ঘন আগুন লাগানোর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বনের পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য এবং আগুনে পুড়ে মারা যাচ্ছে নিরীহ বন্যপ্রাণী। গত বুধবার শরণখোলার রায়েন্দা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে কথা হয় ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষক আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে। তিনি বলেন, সুন্দরবনের গভীর জঙ্গলে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বনের কয়েক একর জায়গা। যদিও পরিমাণের দিক থেকে খুব কম জায়গায় আগুন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এর ক্ষতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। কারণ, এই আগুনের ধোঁয়ার কারণে আশপাশের এলাকার বন ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিন দিনে আগুন নেভানো গেলেও সুন্দরবনের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর এর প্রভাব পড়েছে দীর্ঘ মেয়াদে। ওমর ফারুক ও কামাল হোসেন নামের একই বিদ্যালয়ের আরও দুই শিক্ষক বলেন, বনে কারা আগুন দিয়েছে সেটা বন বিভাগের লোকজনই ভালো করে জানে। আর সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, এই আগুনের কারণে সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল বন সংলগ্ন এলাকার লক্ষাধিক নিরীহ লোক এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন। স্থানীয়দের অভিযোগ, আগুনের ঘটনায় পুলিশ এজাহারভুক্ত আসামিদের গ্রেফতার না করে নিরীহ মানুষ গ্রেফতার করছে এবং হয়রানি করছে। শরণখোলার ইউএনও মোহাম্মদ অতুল মণ্ডলের সত্যতা স্বীকার করে বলেছেন, এতে করে নিরীহ মানুষই বেশি হয়রানির শিকার হচ্ছেন। তিনি বলেন, স্থানীয় প্রভাবশালীরা এ আগুনের পেছনে আছে বলে আমরা তদন্তে প্রমাণ পেয়েছি। তবে কারও নাম প্রকাশ করা যাবে না। তবে ঘটনার পর সুন্দরবনে প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

ইউএনওর পৃথক তদন্ত : শরণখোলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ অতুল মণ্ডল নিজে উদ্যোগী হয়ে একটি তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। তার প্রতিবেদনে আগুনের চারটি কারণ এবং সাত ধরনের ক্ষতির চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি বন রক্ষায় ৫ বছরের জন্য জনসাধারণের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ, সুন্দরবনে বন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এক বছরের বেশি কর্মরত না রাখাসহ ৯টি সুপারিশ করা হয়েছে। ইউএনওর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত দুই বছরে একই স্থানে আরও ১৫টি আগুনের ঘটনা ঘটেছে।  ইউএনওর প্রতিবেদনে সুন্দরবন রক্ষায় ৯টি সুপারিশ করা হয়েছে। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো ওই সুপারিশের মধ্যে রয়েছে— সুন্দরবনকে ঘিরে বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) সব কার্যক্রম কঠোর মনিটরিংয়ে আনা, সুন্দরবনভিত্তিক প্রত্যেক প্রকল্প গ্রহণের পূর্বে স্থানীয় সরকারি সংস্থাগুলোর মতামত গ্রহণ, সুন্দরবন নিকটবর্তী অঞ্চলগুলোতে একাধিক আইনপ্রয়োগকারী সরকারি সংস্থার উপস্থিতি নিশ্চিত করা, নৌ পুলিশ ফাঁড়ি, কোস্টগার্ড ক্যাম্প, ফরেস্ট ক্যাম্প ইত্যাদির মধ্যে অন্তত দুটির উপস্থিতি নিশ্চিত করা, স্থানীয় কমপক্ষে দুটি সরকারি অফিসের জন্য দ্রুতগামী জলযানের ব্যবস্থা করা, বনবিভাগের নিজস্ব যোগাযোগের জন্য ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক সৃষ্টি করা। এদিকে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের ডিএফও সাইদুল ইসলাম বলেন, বনের বিল লিজ দেওয়ার এ দাবি সঠিক নয়। বনবিভাগ নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মাছ ধরার অনুমতি দেয়। মাছ ধরে ফেরার সময়ে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করা হয়।  ২০০২ সাল থেকে এ পর্যন্ত সুন্দরবনে ২১ বার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর প্রতিটি ঘটনাই ঘটেছে ডিসেম্বর থেকে মার্চ-এপ্রিল মাসের মধ্যে। ২১ বার লাগা আগুনে পুড়েছে প্রায় ৭০ একর বনভূমি। এবারের ৪ দফা আগুনে সুন্দরবনের সাড়ে ১২ একর বন পুড়েছে। অবশ্য ফায়ার সার্ভিসের হিসাবে সংরক্ষিত বন পুড়েছে প্রায় ২৫ একর। একই সঙ্গে পুড়ে ছাই হয়েছে উদ্বিড়াল, কচ্ছপ, গুইসাপসহ অনেক বন্যপ্রাণী। আর ইউএনওর প্রতিবেদন অনুযায়ী ২ বছরে একই এলাকায় ১৫টি ঘটনা আছে।

মামলায় আসামি আওয়ামী লীগ নেতা : পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই ধানসাগর এলাকার সর্বশেষ ৩টি আগুনের ঘটনায় আসামি করা হয়েছে শরণখোলা উপজেলার রায়েন্দা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মো. শাহজাহান হাওলাদার ওরফে শাহজাহান শিকারিসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগের ১৭ নেতা-কর্মীকে। বন বিভাগের দায়ের করা ওই মামলায় নাম উল্লেখ না করে অজ্ঞাত আরও কয়েকজনকে আসামি করা হয়েছে। তবে পুলিশ এজাহারভুক্ত কোনো আসামিকে এখনো গ্রেফতার করতে পারেনি।

সর্বশেষ খবর