রবিবার, ৮ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা
বিশ্ব মা দিবস আজ

সন্তান পালনে হিমশিম খাচ্ছেন কর্মজীবীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক

সন্তান পালনে হিমশিম খাচ্ছেন কর্মজীবীরা

দেশে কর্মজীবী নারী দিন দিন বাড়ছে। প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে সরকারি-বেসরকারি চাকরি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষকতাসহ বিভিন্ন পেশা ও উত্পাদনশীল খাতে নারীর সরব অংশগ্রহণ ইতিবাচক। কিন্তু কর্মজীবী এই নারীরা সন্তান প্রসবের পর নবজাতকের লালন-পালনে পাচ্ছেন না প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা। যেসব নারীর সন্তান দেখাশোনার জন্য পরিবারে কেউ নেই তাদের অনেকেই সন্তানের জন্য কাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। আর যারা  কষ্ট করে চাকরি করছেন ও সন্তান পালন করছেন তারা দুটি একসঙ্গে সামলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। কর্মজীবী নারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পর্যাপ্ত ডে-কেয়ার সেন্টারের অভাব ও কর্মস্থলে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার না থাকায় তারা একদিকে যেমন সন্তানের যথাযথ যত্ন নিতে পারছেন না, অন্যদিকে কাজেও মনোযোগ কমছে।

সন্তান জন্মের পর প্রথম ছয় মাস শিশুর সুষ্ঠুভাবে বেড়ে ওঠার জন্য শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোর কথা। কিন্তু কর্মজীবী মায়েরা এ সুযোগ পাচ্ছেন না। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যে, দেশে মায়ের দুধ পানের হার আগের চেয়ে প্রায় ১০ শতাংশ কমেছে। মূলত প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা না পাওয়ায় কর্মজীবী নারীর সন্তানরা বুকের দুধ পান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিকল্প হিসেবে সচ্ছলরা শিশুকে গুঁড়া দুধ বা গরুর দুধ পান করান। কিন্তু এতে শিশুটি অপুষ্টির শিকার হচ্ছে এবং তার স্বাভাবিক বৃদ্ধি কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

‘কর্মজীবী নারী’র পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, ৫১ দশমিক ৩৫ ভাগ অফিস বা কারখানায় ডে-কেয়ার সেন্টারের অস্তিত্ব নেই। দেশের মাত্র ৪০ দশমিক ৫ ভাগ কারখানায় ডে-কেয়ার সেন্টার আছে। তবে এগুলো ব্যবহূত হয় না। এখানে মায়েরা তাদের শিশুদের রাখেন না। কারখানার শ্রমিকরা জানান, কারখানায় বাচ্চা রাখা হলেও দুপুরে খাবার দেওয়া হয় না। শুধু বিকালে নাস্তা দেওয়া হয়। কাঙ্ক্ষিত সেবা না পাওয়া এবং সম্প্রতি কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় শ্রমিকরা বাচ্চাদের কারখানার শিশুকক্ষে রাখার ব্যাপারে অনাগ্রহী। তবে যেদিন বিদেশি বায়ার বা অডিট টিম কারখানা পরিদর্শনে আসেন কেবল সেদিনই শ্রমিকদের শিশু নিয়ে আসার জন্য কারখানা কর্তৃপক্ষ অনুরোধ করে। কারখানাগুলোর মাত্র ৮.১ শতাংশ শিশুকক্ষ আছে যেগুলোয় বাচ্চা রাখা হয়। তবে ঢাকার কিছু আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে ডে-কেয়ার সেন্টার থাকলেও সেবা ও উত্পাদনশীল প্রতিষ্ঠানগুলোয় তা নেই। এমনকি পোশাকশিল্পের মালিকদেরও এ বিষয়ে তেমন আগ্রহ নেই। অথচ বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী, যে প্রতিষ্ঠানে ৪০-এর অধিক নারী শ্রমিক আছেন সেখানে ৬ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু সন্তানের জন্য শিশুকক্ষ বা শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের জায়গা থাকতে হবে। কিন্তু এ আইন বাস্তবে মানা হচ্ছে না, যার ফলে সন্তান পালনের জন্য বহু নারী শ্রমিককে কাজ ছেড়ে দিতে হচ্ছে। বাংলাদেশ টেক্সটাইল গার্মেন্ট ওয়ার্কার্স ফেডারেশন থেকে প্রাপ্ত তথ্য, বাংলাদেশের সচল গার্মেন্টগুলোর ৯০ শতাংশেরই ডে-কেয়ার সেন্টার নেই। আর ৮ শতাংশ নামমাত্র ডে-কেয়ার সেন্টারের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রেখেছে। তবে ২ শতাংশ গার্মেন্টে যে সেন্টারগুলো আছে সেগুলোর কার্যক্রম সন্তোষজনক নয়। অবশ্য পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র দাবি, প্রয়োজনীয় সরঞ্জামসহ শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র আছে ৬৬ দশমিক ২৭ শতাংশ কারখানায়। এদিকে বিভিন্ন পোশাক কারখানাসহ অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোয় শিশুদের জন্য ‘ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার’ না থাকায় কর্মজীবী মায়েদের বেশ সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। রাজধানীর মিরপুরে বিভিন্ন পোশাক কারখানা ঘুরে অল্প কয়েকটিতে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র থাকার কথা জানা গেলেও ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার আছে এমনটি জানা যায়নি। এমনকি বাস টার্মিনাল, রেলস্টেশন, সরকারি-বেসরকারি অফিসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার চালুর নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের এখন পর্যন্ত এমন উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। মহিলাবিষয়ক অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক শাহনওয়াজ দিলরুবা খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সারা দেশে এখন মাত্র ৪৩টি ডে-কেয়ার সেন্টার আছে। নতুন করে আরও ৩৬টি করার পরিকল্পনা আছে, যার ১২টি ঢাকায় তৈরি হবে। আর পোশাক কারখানাগুলোর মালিকদের সঙ্গে আমরা আলোচনা করে তাদের কারখানায় ডে-কেয়ার সেন্টার তৈরির আহ্বান জানাচ্ছি। এরই মধ্যে জাতীয় মহিলা সংস্থার উদ্যোগে গাজীপুরে বেশ কয়েকটি কারখানায় ডে-কেয়ার সেন্টার তৈরির প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। আর বেসরকারিভাবে কেউ যদি ডে-কেয়ার সেন্টার তৈরি করে তবে তাদের আমাদের কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হবে। সে ক্ষেত্রে আমরা এর মনিটরিং করব।’ বর্তমানে ঢাকা শহরে ৭টি এবং ঢাকার বাইরে বিভাগীয় শহর রাজশাহী, চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল, খুলনাসহ মোট ১২টি ডে-কেয়ার সেন্টার নিম্নবিত্ত কর্মজীবী ও শ্রমজীবী মহিলাদের সন্তানদের জন্য পরিচালিত হচ্ছে। রাজধানীতে কল্যাণপুর, মোহাম্মদপুর, আজিমপুর, মগবাজার, রামপুরা, খিলগাঁও ও ফরিদাবাদে এ কেন্দ্রগুলো অবস্থিত। এসব কেন্দ্রে প্রতিটি শিশুর জন্য মাসে ৩০ টাকা করে চাঁদা গ্রহণের মাধ্যমে শিশুদের দেখভাল করা হয়। ঢাকার প্রতিটি সেন্টারে ৮০ ও ঢাকার বাইরে ৬০ জন শিশুকে সেবা দেওয়া হয়। এর বাইরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির কর্মজীবী নারীদের জন্য ঢাকায় ৬টি ডে-কেয়ার সেন্টার মহিলাবিষয়ক অধিদফতরের আওতায় পরিচালিত হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ সচিবালয়, এজিবি অফিস, আজিমপুর, মহিলাবিষয়ক অধিদফতর, খিওগাঁও ও মিরপুর। এখানে মাসে ৩০০ টাকা চাঁদা নেওয়া হয়। একসঙ্গে প্রতি সেন্টারে ৫০ জন শিশুর সেবা দেওয়া হয়। এ ছাড়া বেসরকারিভাবেও দেশে বেশ কিছু শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র আছে। আর মতিঝিলে বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত নারীদের সন্তানদের জন্য ২০১৫ সালে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র চালু করা হয়।

সর্বশেষ খবর