মঙ্গলবার, ১০ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

সর্বত্রই ময়লার ভাগাড়, দুর্গন্ধ

সাঈদুর রহমান রিমন

সর্বত্রই ময়লার ভাগাড়, দুর্গন্ধ

রাজধানীর প্রধান প্রধান সড়কে এভাবে ফেলে রাখা হয়েছে ময়লা-আবর্জনা —বাংলাদেশ প্রতিদিন

গোটা রাজধানীই উৎকট দুর্গন্ধময়, ময়লা-আবর্জনার বিশাল ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। তিলোত্তমা এ মেগাসিটির রাস্তাঘাট, অলিগলি, আবাসিক, বাণিজ্যিক কি শিল্প এলাকা— সর্বত্রই ধুলা, ধোঁয়া, ময়লা-আবর্জনার বিদঘুটে ছড়াছড়ি। ড্রেন-নর্দমার তরল ময়লা উপচে পড়ছে রাস্তাঘাটে, ঢুকে পড়ছে বাড়িঘরে। কোনো কারণে বর্জ্য-ময়লা চোখে না পড়লেও উৎকট দুর্গন্ধ ঠিকই পাওয়া যায়। কি অভিজাত, কি ঘন ঘিঞ্জি নোংরা বসতি এলাকা— সর্বত্রই অভিন্ন চিত্র। গত কয়েক দিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন অনুসন্ধানে ময়লা-আবর্জনা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বেহাল পরিস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। বেশির ভাগ এলাকার রাস্তাজুড়ে কিংবা গলির মুখে ফেলা হচ্ছে আবর্জনা। সেসব স্থান থেকে দিনভর সিটি করপোরেশনের গাড়িতে খোলামেলাভাবে ময়লা-আবর্জনা বয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ডাম্পিং ডিপোতে। চলন্ত গাড়ি থেকে উৎকট দুর্গন্ধযুক্ত তরল ময়লা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে ব্যস্ততম রাজপথে। যাত্রী-পথচারীর শরীরে লেগে নোংরা হয় জামা-কাপড়। কোতোয়ালি, বংশাল, যাত্রাবাড়ী, চকবাজার ও মিরপুরের বিভিন্ন স্থানে রাখা করপোরেশনের ডাস্টবিনগুলো পূর্ণ হয়ে ময়লা উপচে পড়ছে চারপাশে। ভুক্তভোগী বাসিন্দাদের অভিযোগ, দিন-সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও এসব ডাস্টবিন পরিষ্কার করতে দেখা যায় না। টিপু সুলতান রোডের বাসিন্দা নূর আলী বলেন, ‘ময়লার জঞ্জাল সহ্যের সীমা ছাড়ালে এলাকাবাসী চাঁদা তুলে ডাস্টবিন পরিষ্কার করিয়ে নিতে বাধ্য হয়।’ টিপু সুলতান রোডের মতো মুগদাপাড়া, বাসাবো মাঠের কোনায়, যাত্রাবাড়ী মোড়, শংকর বাসস্ট্যান্ড, মনেশ্বর রোডের বটতলা মোড়, গুলবাগ, কলাবাগান লেকসার্কাস রোড, গ্রিন রোড, কাঁঠালবাগান রোড, আদাবর রিংরোড, তেজকুনিপাড়ায় বসানো ডাস্টবিনগুলো কবে যে পরিষ্কার হয় আর কবে যে হয় না, তা বুঝতে পারেন না বাসিন্দারা। তারা প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে ডাস্টবিন উপচে ময়লা-আবর্জনা ছড়ানো-ছিটানো অবস্থায় দেখেন। খোলা ময়লা-বর্জ্য নিয়ে কাক-কুকুরের টানাহেঁচড়ায় বিদঘুটে নোংরা অবস্থার সৃষ্টি হয়। ডিসিসির পরিচ্ছন্ন বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, রাজধানীতে এ রকম চার হাজার ৬০০ ডাস্টবিন রয়েছে। রাজধানীর গোলাপবাগ, গোপীবাগ, নারিন্দা, শহীদ ফারুক রোড, করাতিটোলা, মিরপুর মাজার রোড, কাফরুল পূর্ব কাজীপাড়া, তেজতুরীবাজার এলাকার বেশ কয়েকটি রাস্তায় আবর্জনার স্তূপ জমে জমে ছোটখাটো টিলায় রূপ নিয়েছে। ময়লা ঢিবির কারণে প্রায়ই সেসব রাস্তায় রিকশা-গাড়ির চলাচল পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়। এর পরও উপায়হীন মানুষজন মল-মূত্র, কাদা-পানিতে একাকার থাকা ময়লার বর্জ্যে পা ডুবিয়ে পথ চলতে বাধ্য হচ্ছেন। ঢাকা সিটি করপোরেশনের উত্তর ও দক্ষিণের দফতর সূত্র জানায়, রাজধানীতে প্রতিদিন প্রায় সাড়ে চার হাজার টন ময়লা-আবর্জনা জমে ওঠে। এর মধ্যে সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্ন বিভাগ সর্বোচ্চ তিন হাজার টন ময়লা-আবর্জনা অপসারণ করতে পারে। অবশিষ্ট দেড় হাজার টন ময়লা-আবর্জনা রাস্তাঘাটে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে। আটকে থাকে ড্রেন-নর্দমায়। ঢাকায় প্রতিদিন জমে ওঠা ময়লা-আবর্জনার মধ্যে দুই শতাধিক টন ক্লিনিক্যাল বর্জ্য খুবই বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত। এসব বর্জ্য ধ্বংসের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা না থাকায় সাধারণ ময়লা-আবর্জনার সঙ্গে মিলেমিশে নানা সংক্রামক রোগের বিস্তার ঘটাচ্ছে। পাশাপাশি শিল্প-কারখানা, কাঁচাবাজার, ব্যবসা কেন্দ্র, হোটেল-রেস্তোরাঁ, নির্মাণ বর্জ্যসহ বাসাবাড়ির ময়লা-আবর্জনা মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে এনেছে।

টয়লেট থেকে কাঁচাবাজার : ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি) নির্মিত ৭০টি পাবলিক টয়লেটের সবগুলোই ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে আছে। পথ-চলতি মানুষ বিপজ্জনক এসব টয়লেট ব্যবহারের পরিবর্তে রাস্তা, গলি ও ফুটপাথের কোনায় কোনায় অঘোষিত টয়লেট বানিয়ে ফেলেছে। ফলে মল-মূত্র আর তীব্র দুর্গন্ধে ফুটপাথ-রাস্তায় হেঁটে চলাই কঠিন। এদিকে রাজধানীর কাঁচাবাজারগুলো একেকটি যেন ময়লা-আবর্জনার ভাগাড় হয়ে উঠেছে। কাপ্তানবাজারের নোংরা ময়লা-আবর্জনার অব্যবস্থাপনা গুলিস্তান পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে। পুরো রাস্তায় ফেলা হচ্ছে জবাই করা মুরগির নাড়িভুঁড়ি, পালক, গরু-ছাগলের মল-মূত্র। যাত্রাবাড়ীর মাছের আড়তের আশপাশ দিয়ে দ্রুতগতির গাড়িতে যাতায়াত করারও জো নেই। দুর্গন্ধের ঝাপটা মুহূর্তেই যে-কাউকে অসুস্থ বানিয়ে দেয়। মিরপুর ১১ নম্বরে ডিসিসির নির্মাণাধীন মার্কেটের সামনে পুরো এলাকায় ময়লা-আবর্জনা আর ড্রেনের পানি মিশে দুর্বিষহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আশপাশের ফলের দোকানের পচা ফলের গন্ধে এখান দিয়ে হাঁটাই দায়। ভোরবেলা ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, খিলগাঁও রেলগেট এলাকার পরিবেশ খুবই নাজুক হয়ে ওঠে। মালিবাগ এলাকার বাসিন্দা লুত্ফর রহমান, সামসুজ্জামান, আলহাজ শহিদুল ইসলামসহ কয়েকজন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘রাজধানীর আবর্জনা ব্যবস্থাপনা বলতে কিছু আছে বলে মনে হয় না। ঘুপচি মহল্লায় এত অ্যাপার্টমেন্ট নির্মিত হয়েছে, অথচ কোনোটিতেই ন্যূনতম ডাস্টবিন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়নি। বহুতল একেকটি অ্যাপার্টমেন্টের দুই-তিনশ পরিবারের নিত্য আবর্জনা কোথায় ফেলা হয়!’

বিপন্ন পরিবেশ-প্রতিবেশ : অপরিচ্ছন্নতা, নোংরা আবর্জনা ও কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য পুরান ঢাকার অন্যতম প্রধান সমস্যা। প্রায় প্রতিটি সরুপথের পাশে ময়লার স্তূপ, মোড়ে মোড়ে বিপজ্জনক রাসায়নিকের কারখানা, বিষাক্ত বর্জ্য। আরমানিটোলা, লালবাগ, সূত্রাপুর কিংবা হাজারীবাগ যে কোনো স্থানে দুদণ্ড দাঁড়িয়ে এতটুকু নিঃশ্বাস নেওয়াই দায় হয়ে যায়। ট্যানারির অশোধিত বর্জ্য হাজারীবাগ, লালবাগ, রায়েরবাজার, জিগাতলা, ধানমন্ডিসহ আশপাশের ১০ বর্গকিলোমিটার এলাকার জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত করে তুলছে। বিপন্ন হয়ে পড়েছে পরিবেশ-প্রতিবেশ। বাতাস আর পানিতে ঘুরছে বর্জ্যের বিষ। নানাভাবে এ বিষেই আক্রান্ত হচ্ছে রাজধানীর মানুষ। এক সমীক্ষায় বলা হয়, বর্জ্যের কারণে ১০ বর্গকিলোমিটার এলাকার ৩০ লক্ষাধিক মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। শুধু হাজারীবাগের ১৯৪টি ট্যানারি কারখানা থেকে প্রতিদিন ১৫ হাজার কিউবিক মিটার তরল বর্জ্য নিষ্কাশন হচ্ছে, ছড়িয়ে পড়ছে আরও ১০ মেট্রিক টন কঠিন বর্জ্য। লালবাগ এলাকার ট্যানারিগুলো থেকে সাত হাজার কিউবিক মিটার তরল ও ৫ হাজার মেট্রিক টন কঠিন বর্জ্য পরিবেশে ভয়াবহ দূষণ সৃষ্টি করে চলেছে।

পরিচ্ছন্ন ঢাকা গড়তে তত্পরতা : ঢাকাকে পরিচ্ছন্ন রাজধানী হিসেবে গড়ে তুলতে ডিসিসির দুই মেয়রের নানা উদ্যোগ ও ক্লান্তিহীন তত্পরতা নাগরিকদের মনে আশার সঞ্চার করেছে। ডিসিসি উত্তরের মেয়র আনিসুল হক ও দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকনের আহ্বানে শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ এরই মধ্যে পরিচ্ছন্নতার নানা অভিযানে স্বতঃস্ফূর্ত অংশ নিয়েছেন। ক্লিন ঢাকা-গ্রিন ঢাকা স্লোগানে পরিচ্ছন্ন এলাকা গড়তে সচেতনতা সৃষ্টির নানা কার্যক্রম চলছে জোরেশোরে। ইতিমধ্যে ২০১৬ সালকে ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা বর্ষ ঘোষণা করা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর