বুধবার, ১১ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

প্রবাসীদের ভোগান্তির শেষ নেই দূতাবাসে

শৃঙ্খলা ফেরাতে সরাসরি অভিযোগ জানানোর ব্যতিক্রমী উদ্যোগ

জুলকার নাইন

কুমিল্লার নজির প্রধান। থাকেন ইতালিতে। হাতে লেখা পাসপোর্টের পরিবর্তে মেশিন রিডেবল পাসপোর্টের প্রক্রিয়া সেরেছেন মিলানে বাংলাদেশ কন্স্যুলেটে। ফিঙ্গার প্রিন্টসহ সংশ্লিষ্ট সব কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর এখন পাসপোর্ট হাতে পাওয়ার অপেক্ষায়। কিন্তু পাসপোর্ট বিলম্ব হওয়ায় চিন্তায় পড়েছেন। কারণ আসছে ১০ জুন তার ইতালিতে বসবাসের ডকুমেন্ট নবায়নের শেষ দিন। তাই উদ্বিগ্ন নজির ফোন করেন কন্স্যুলেট অফিসে কর্মরত সুবির সরকারকে। কিন্তু দূতাবাসের এই কর্মী প্রবাসী নজিরের উদ্বেগ কমাতে সাহায্য করার পরিবর্তে করেন দুর্ব্যবহার। নজির প্রধানের ভাষায়, ‘ওনাকে ফোন দিয়ে আমি যেন মহাঅপরাধ করে ফেলেছি। গরু-ছাগলের মতো    ব্যবহার। বলেন, আপনাকে যে পাসওয়ার্ড দেওয়া হয়েছে তা দেখেন, ফোন দেবেন না। মনে হয় যেন আমরা করুণা চাচ্ছি।’ এই প্রবাসী বাংলাদেশির দাবি, ‘অনেকে আছে পাসপোর্ট ৩-৪ মাসেও পায় না, পরে অ্যাম্বাসিতে যোগাযোগ করলে বলে আপনার এটা বাকি ওটা বাকি। এগুলা দিয়ে আবার শুরু হয় ঘোরাঘুরি। কিছু হয় না। তবে দালালের মাধ্যমে টাকা দিলে সব হয়ে যায় চোখের পলকে। নজির বললেন, একবার মিলান যেতে-আসতে ১৩০ ইউরো খরচ হয়, আর মালিক এক কাজের জন্য কয়দিন ছুটি দেবে? তাই দূতাবাসে যদি ফোন করে জানতে পারতাম আসলে কবে পাসপোর্ট পাব তাহলেই আমরা খুশি থাকতাম। কিন্তু তা তো পাওয়াই যায় না, বরং দূতাবাসের লোকজন মনে করেন, ওনারা অফিসার আমরা কামলা।’ যুক্তরাজ্যে বসবাসরত মো. মাসুম মিয়ার দাবি, ‘লন্ডন অ্যাম্বাসিতে একবার ফোন করে দেখেন, ৩ দিনেও ফোন ধরবে না। লন্ডন অ্যাম্বাসিতে গেলে মনে হয় কোনো উপজেলা কমপ্লেক্স টাউট-বাটপারের মেলায় প্রবেশ করেছেন। অ্যাম্বাসিতে প্রতিটি কর্মচারী যতভাবে সম্ভব প্রবাসীদের হয়রানি করে।’ রোম মিশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে প্রবাসী সিরাজ মিয়া বলেন, ‘কিছু তথ্যের জন্য প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে রোমে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসে কল করছি। শুধু রিং বাজে, কেউ রিসিভ করে না। দূতাবাসে অফিসের কাজকর্ম ও পরিবেশ যা তা বাংলাদেশের অফিসগুলোকেও হার মানাবে।’ আরব আমিরাতের কামাল হোসাইনের অভিযোগ, ‘আবুধাবী বাংলাদেশ দূতাবাসে গেলে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের গরমে খোলা জায়গায় অপেক্ষা করতে হয়। একটা ফটোকপির জন্য ঘুরতে হয় তিন মাইল। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের ক্ষেত্রে এমন হয় না।’ দূতাবাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে প্রায় একই ধরনের অভিযোগ সৌদি আরব প্রবাসী মোমেনুল ইসলাম, মালয়েশিয়ার মনির শিকদারসহ অসংখ্য প্রবাসীর। বছরের পর বছর ধরে প্রবাসীরা এ ধরনের অভিযোগ করে আসছে। কিন্তু কোথাও তাদের অভিযোগ শোনা হয়নি। ভোগান্তির অবসানও হয়নি। প্রবাসীদের এই হয়রানি লাঘবে উদ্যোগী হয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। প্রতিমন্ত্রী নিজে উদ্যোগী হয়ে দূতাবাসের সেবা নিশ্চিত করার জন্য যে কোনো অভিযোগ সরাসরি তার কাছে করতে বলেছেন। প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম গত বুধবার প্রবাসীদের উদ্দেশে ঘোষণা দিয়েছেন, ‘বিদেশে বাংলাদেশের কোনো দূতাবাস বা হাইকমিশনে অফিস সময়ের মধ্যে ফোন করে পাননি বা কাঙ্ক্ষিত সেবা পাননি, এ ধরনের সুনির্দিষ্ট (তারিখ, সেবার ধরন এবং সম্ভব হলে যে ব্যক্তির সঙ্গে আপনার কথা হয়েছে তাসহ) অভিযোগ থাকলে তা আমাকে ংস—সড়ভধ.মড়া.নফ-তে ই-মেইল করে বা ইনবক্স করে দয়া করে জানান।’ এরপর থেকেই বিশ্বের নানান প্রান্ত থেকে প্রবাসীরা অভিযোগ করছেন ই-মেইলে, ফেসবুকে, প্রতিমন্ত্রীর ইনবক্স ও স্ট্যাটাসের কমেন্ট বক্সে। প্রতিমন্ত্রীও বিষয়টির ফলোআপ করছেন। যার প্রমাণ আগের ঘোষণার ২৪ ঘণ্টা পার হওয়ার আগেই প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম একজন দূতাবাস কর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বলেছেন, ‘অনেক প্রবাসীর কাছ থেকে মেসেজ পেয়েছি। ব্যস্ততার মধ্যেও কিছু উত্তর দিয়েছি। বেশির ভাগই সংশ্লিষ্ট মিশনে পাঠিয়েছি। যেসব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, সেসব ক্ষেত্রে মিশন অভিযোগকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করবে। টেলিফোন না ধরা একটা বড় সমস্যা। প্রয়োজনীয় নির্দেশনা পাঠানো হচ্ছে। একজনকে শাস্তিমূলক বদলিও করা হয়েছে। চেষ্টা অব্যাহত থাকবে পরিস্থিতি উন্নতি করার।’

প্রবাসীদের বাংলাদেশ দূতাবাস কী ধরনের সেবা দিয়ে থাকে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বিদেশে পাসপোর্ট হারিয়ে গেলে বা চুরি হয়ে গেলে এমন অবস্থায় কারও জরুরি ভিত্তিতে বাংলাদেশে আসার প্রয়োজন হলে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ট্রাভেল ডকুমেন্টের ব্যবস্থা করে দেয়। পাসপোর্টের মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে তা নবায়ন করে দেয়। মেশিন রিডেবল পাসপোর্টের আবেদন গ্রহণ এবং নতুন মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট করে দেয়। মেশিন রিডেবল পাসপোর্টের আবেদন করার জন্য সাময়িক বা স্থায়ী জন্ম নিবন্ধন সনদ প্রদান করে। বিদেশে বসবাসকারী বাংলাদেশি নাগরিকদের সে দেশে জন্মগ্রহণ করা সন্তানের জন্ম নিবন্ধনের ব্যবস্থা করে এবং নবাগত শিশুর পাসপোর্ট করে দেয়। বিভিন্ন কারণে বিদেশে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত বাংলাদেশি নাগরিকদের আইনি সহায়তা দেয়। বিদেশে কেউ মারা গেলে ওই দেশ থেকে লাশ পাঠানোর প্রশাসনিক কাগজপত্র প্রদান এবং আইনি পরামর্শ ও সহায়তা দিয়ে থাকে। জন্মসূত্রে বাংলাদেশি নাগরিক কিন্তু পরবর্তীতে অন্য কোনো দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে থাকলে তাদের জন্য পাসপোর্টে বিনা ভিসা সিলমোহর (নো ভিসা রিকোয়ার সিল) দেওয়ার ব্যবস্থা করে। অন্য দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণের পর বাংলাদেশের নাগরিকত্ব এমনিতেই বাতিল হয়ে যায়। এমন অবস্থায় বাংলাদেশে দ্বৈত নাগরিকত্ব গ্রহণে আগ্রহীদের দ্বৈত নাগরিকত্ব সনদের ব্যবস্থা করে দেয়। বিদেশে বসবাসকালে ওই দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি, পড়াশোনা বা যে কোনো প্রয়োজনে কোনো কাগজপত্র দাখিলের প্রয়োজন হলে সেসব কাগজ প্রয়োজন অনুযায়ী সত্যায়িত করা, পাওয়ার অব অ্যাটর্নি, হলফনামাসহ নানাবিধ কাজ করে দেয়। বিদেশে চাকরি করতে গিয়ে ওই দেশের মালিকদের দ্বারা প্রতারিত হলে বা কোনো সমস্যায় পড়লে প্রয়োজনীয় অভিযোগ করা যায় এবং পরামর্শ গ্রহণ করা যায়। বাংলাদেশ থেকে প্রাপ্ত আন্তর্জাতিক ড্রাইভিং লাইসেন্স ভেরিফিকেশন করে দেয়। পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেটের আবেদন গ্রহণ করে। বাংলাদেশ মিশন এবং কন্স্যুলেট আরও কী কাজ করে তা জানতে প্রত্যেক মিশনের ওয়েবসাইট ভিজিট করতে পারেন বা ফোন করেও জেনে নিতে পারেন।

সর্বশেষ খবর