বৃহস্পতিবার, ১২ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

জবরদখলের ফুটপাথে ঘিঞ্জি হাট-বাজার

সাঈদুর রহমান রিমন

জবরদখলের ফুটপাথে ঘিঞ্জি হাট-বাজার

রাজধানীর ফুটপাথে বসানো অস্থায়ী দোকানপাট ক্রমেই স্থায়ী রূপ নিচ্ছে, পরিণত হচ্ছে ঘন ঘিঞ্জি হাট-বাজারে। ফুটপাথ ও সংলগ্ন রাস্তা-গলির কোথাও এক চিলতে জায়গা ফাঁকা থাকতে দেওয়া হচ্ছে না। যারা যেভাবে পারছে সেভাবেই দখল করে জমিয়ে তুলছে বাজার। গুরুত্বপূর্ণ মোড় ও পয়েন্টে কোনটা রাস্তা কোনটা বাজার তা খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। গুলিস্তান, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, দিলকুশা, ফার্মগেট, উত্তরা, বিমানবন্দর ও মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর এলাকায় মাঝ রাস্তার আইল্যান্ড পর্যন্ত জবরদখল করে বসানো হয়েছে বাজার। এত দিন চট-চাদর, পলিথিনের ছাউনি টানিয়ে যেসব দোকানপাট চলছিল, এখন সেগুলোয় বাঁশ-চটি-বেড়া লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে স্থায়ী রূপ। প্রতি মাসে এসব ফুটপাথ মার্কেট থেকে অন্তত ছয় কোটি টাকার চাঁদাবাজি চলছে বলে তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে।

খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, গুলিস্তান এলাকা মোট ১৫টি জোনে ভাগ করা রয়েছে। জোনগুলোর চাঁদা আদায়ের দায়িত্বে আছে কালু, মিজান, পুইরা হারুন, একটি রাজনৈতিক সংগঠনের শ্রমিক নেতা আনোয়ার, মজনুসহ কয়েকজন। ফার্মগেট এলাকা ভাগ করা হয়েছে তিনটি জোনে। একইভাবে মতিঝিল-দিলকুশায় ছয়টি জোন, মালিবাগ মোড়ে দুটি জোন, নিউমার্কেট-সায়েন্স  ল্যাবরেটরির মোড় পর্যন্ত পাঁচটি জোন, পল্টন-বায়তুল মোকাররম এলাকায় চারটি জোন, মৌচাক-মালিবাগ, মিরপুর-১ ও মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বর এলাকায় দুটি করে জোন রয়েছে। এ ছাড়া সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল, গাবতলী বাস টার্মিনাল, ফুলবাড়িয়া টার্মিনাল চত্বর ও কারওয়ান বাজারের আশপাশ এলাকায় ফুটপাথ-দখলবাজির বাজার রমরমা হয়ে উঠেছে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের (ডিসিসি) তথ্যানুযায়ী, ঢাকা মহানগরীতে ১৬৩ কিলোমিটার ফুটপাথ রয়েছে। এর মধ্যে ১০৮ দশমিক ৬০ কিলোমিটার ফুটপাথই বেদখল হয়ে আছে। অন্যদিকে ঢাকার ২২৮৯ দশমিক ৬৯ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে জবরদখল হয়েছে ৫৭২ দশমিক ৪২ কিলোমিটার। ক্ষমতাসীন দল অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের ছত্রচ্ছায়ার বসেছে পণ্যের পসরা। রাজধানীর দুই শতাধিক স্পটে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ফুটপাথ বাজার এখন রাস্তাজুড়ে সম্প্রসারিত হয়েছে। এতে যান ও লোক চলাচলে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হচ্ছে। কথা ছিল সিটি করপোরেশনে মেয়র-কাউন্সিলর পদে নির্বাচিত হওয়ার পর ঢাকা শহরের ফুটপাথগুলো অবৈধ দখলমুক্ত করবেন প্রার্থীরা। কিন্তু সে কথা আর রাখা হচ্ছে না। উপরন্তু প্রার্থীদের নানা স্তরের সাঙ্গোপাঙ্গরা এখন ঢাকার ফুটপাথ দখলের মহোৎসবে মেতে উঠেছেন। নির্বাচনের আগে প্রার্থীদের পক্ষ হয়ে বিভিন্ন ওয়ার্ডে একশ্রেণির দলীয় কর্মী-সমর্থক ব্যানার-পোস্টার-ফেস্টুন ছাপিয়ে প্রচারণা চালিয়েছিলেন। তাতে ওই কর্মী-সমর্থক ও বিভিন্ন ওয়ার্ডের পাতি নেতারা পরিচিত হয়ে উঠেছেন নির্বাচিত প্রার্থীদের লোক হিসেবে। তারা সেই পরিচিতি কাজে লাগিয়ে এবং বিজয়ী প্রার্থীদের নাম ভাঙিয়ে ফুটপাথ দখলে নিচ্ছেন। নির্বাচিত অনেক কাউন্সিলর ফুটপাথ দখলবাজদের পৃষ্ঠপোষকতা করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। গুলিস্তানের বঙ্গবন্ধু এভিনিউ এলাকায় অলিখিত ইজারা প্রক্রিয়া চালু করেছে প্রভাবশালী মাস্তান চক্র। সেখানে ক্ষমতাসীন দলের নাম ভাঙিয়ে জনৈক দুলালের নেতৃত্বে পাঁচ-সাতজন মাস্তান প্রতিটি রাস্তা, গলি ও মার্কেটের ফাঁকা প্যাসেজ ইজারা দিয়েছে। দোকানের পজেশন বাবদ এককালীন ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত হাতানোর পাশাপাশি দোকানপ্রতি দৈনিক ২০০ টাকা হারে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় শুধু বঙ্গবন্ধু এভিনিউ এলাকা থেকেই দুলাল সিন্ডিকেট প্রতি মাসে ১০-১২ লাখ টাকা পকেটস্থ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কাপ্তানবাজারের মুরগিপট্টি, এরশাদ মার্কেটসহ আশপাশের যাবতীয় ফুটপাথ বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে মিন্টু সিন্ডিকেট। সেখানে শুধু ফুটপাথ বাজারই নয়, নেশার আসর থেকে শুরু করে ছিনতাইকারী, পকেটমার চক্রের পৃষ্ঠপোষক ওই সিন্ডিকেট। ঝুপড়িঘরের ক্লাবগুলোতে হরদম চলে জুয়ার আসর। টিকাটুলীর রাজধানী সুপার মার্কেট ঘিরে চলছে বহুমুখী চাঁদাবাজি। সেখানে কানকাটা মঞ্জুর নেতৃত্বে ন্যাড়া আলী, পাগলা কামালসহ ১০-১২ জন সন্ত্রাসী সর্বেসর্বা হয়ে উঠেছে। তারা ফুটপাথে পজেশন বিক্রি, রাজধানী সুপার মার্কেটের গলিপথে নতুন নতুন দোকান নির্মাণ, ভাড়া আদায়, বিদ্যুতের চোরাই সংযোগ প্রদানের মাধ্যমে প্রতি মাসে ১০ লক্ষাধিক টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। কানকাটা মঞ্জু গ্রুপ মার্কেট ও ফুটপাথ বাজার দখলবাজি ছাড়াও সরকারি খাসজমি দখল, বিবদমান জায়গা-জমি হাতিয়ে নেওয়া, এমনকি হাসপাতাল পর্যন্ত জবরদখল করে রেখেছে বলে এন্তার অভিযোগ রয়েছে। বায়তুল মোকাররম-সংলগ্ন ওভারব্রিজ ঘেঁষা জায়গায় রাস্তা দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে ফলের বাজার। পাশাপাশি ঈদ উপলক্ষে নানা সামগ্রীর ডালা সাজিয়ে বসেছেন নতুন নতুন ব্যবসায়ী। ফার্মগেট টেম্পোস্ট্যান্ডের আশপাশে পজেশন নিয়ে বসা হকারদের কাছ থেকে চাঁদা তোলা হচ্ছে একটি রাজনৈতিক দলের যুব সংগঠনের ব্যানারে। তৌহিদ, কাজল, মোফাজ্জল, তারাসহ আরও কজন এখানে চাঁদাবাজি চালিয়ে থাকে। কারওয়ান বাজারের মূল রাস্তাটি অলিখিত ইজারা দিয়ে চাঁদা তুলছে শ্রমিক ও যুব সংগঠনের তিন নেতা। আম্বরশাহ মসজিদ গলি বন্ধ করে গড়ে তোলা মুড়ির বাজার থেকে চাঁদা তোলে আরেকটি সিন্ডিকেট। ফার্মগেটের খুদে হকাররা জানান, প্রতিদিন ‘পুলিশের বিট’ বাবদ ৫০, ‘হকারদের কল্যাণকারী নানা সংগঠনের চাঁদা’ বাবদ ৩০ এবং স্থানীয় ক্লাব-সমিতির নামে ‘মাস্তানি ভাতা’ বাবদ আরও ২০ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়। দোকানিদের কাছ থেকে চাঁদা তোলার জন্য প্রতি লাইনেই একজন করে দোকানদার ‘লাইনম্যান’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ দায়িত্বটুকু পালন করায় ‘লাইনম্যান দোকানি’ থাকেন চাঁদামুক্ত। কয়েকটি লাইন মিলে একটি করে জোন গড়ে তোলা হয় এবং জোনের দায়িত্বে থাকে মূল পজেশন বিক্রেতার নিজস্ব কর্মী। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা রাজনৈতিক দলের পরিচয় বহন করে থাকে। রাজধানীর বৃহত্তর উত্তরা এলাকায় বর্তমানে রাজউকের প্লট, খোলা জায়গা ও ফুটপাথ জবরদখল করে অবৈধ কাঁচাবাজার, দোকানপাট ও মাদক ব্যবসা বেশ জমজমাট হয়ে উঠেছে। আর এসব দখলের নেতৃত্ব দিচ্ছে রাজউকের সুপারভাইজার সাইদুল, রুহুল, মান্নান, কালা কালাম ও তাদের সহযোগী বখাটে সন্ত্রাসীরা। ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় কিছু নেতা-কর্মী ও সমর্থক দখলবাজদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা।

দখলের অভিশাপ বারিধারায় : ফুটপাথসহ রাস্তা দখলবাজি কী ভয়ঙ্কর অভিশাপ ডেকে আনে তা প্রগতি সরণিতে যাতায়াতকারী মানুষজন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। ব্যস্ততম ওই সড়কের বারিধারা অংশের ফুটপাথ ও রিকশার লেনটি আরও কয়েক বছর আগেই দখলবাজরা নিজেদের কব্জায় নিয়ে নিয়েছে। তারা সরকারি রাস্তা ও ফুটপাথ পজেশন আকারে ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দেয়। ফলে ১২০ ফুট প্রশস্ত প্রগতি সরণি দিনে দিনে ৮০ ফুটে নেমে এসেছে। অপ্রশস্ত এ রাস্তার মধ্যেও এক লেন দখল করে বানানো হয়েছে অঘোষিত পার্কিং পয়েন্ট। ফলে শত শত যানবাহন নর্দ্দা ওভারব্রিজ থেকে সুবাস্তু টাওয়ার পর্যন্ত আড়াই কিলোমিটার সড়কে খুব সতর্কতার সঙ্গে ধীরগতিতে একটি একটি করে চলতে বাধ্য হচ্ছে। এটুকু রাস্তা পেরোতেই বাস-মিনিবাস, প্রাইভেট কারের এক-দেড় ঘণ্টা লেগে যায়। ওই তিন কিলোমিটার রাস্তায় ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত দুঃসহ যানজটে অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হন হাজার হাজার যাত্রী-পথচারী। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, ক্ষমতাসীন দল ও সহযোগী সংগঠনের স্থানীয় পর্যায়ের চার নেতা আড়াই কিলোমিটার দীর্ঘ রাস্তার ফুটপাথ ও রিকশার লেন দখল করে নিয়েছেন। তারা পজেশন আকারে অন্তত ৬০০ দোকান, গাড়ি-ফার্নিচারের শোরুম, চাইনিজ রেস্টুরেন্ট, সিকিউরিটি গ্রুপ, ওয়ার্কশপ ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। পজেশন বিক্রি থেকেই তারা কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এখন পজেশনধারী দোকানিদের কাছ থেকে মাসোয়ারা নেওয়ার ভিত্তিতে থানা পুলিশ ও ট্রাফিক বিভাগ শুধু তাদের বাড়তি সুবিধা নিশ্চিত করে দিচ্ছে। সুবিধাগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রতিটি ওয়ার্কশপ ও গাড়ির শোরুম-সংলগ্ন মূল রাস্তায় নির্বিঘ্নে সারি সারি গাড়ি পার্কিংয়ের সুযোগ করে দেওয়া। মাসোয়ারা প্রদানকারীরা তাদের নিজ নিজ প্রতিষ্ঠান-সংলগ্ন ফুটপাথ ও রিকশার লেন ঘিরে সীমানা-বেড়া লাগানোসহ রংবেরঙের বাতিতে সাজিয়ে রাখারও সুবিধা পান।

সর্বশেষ খবর