শনিবার, ১৪ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

ভোট পড়েছে অস্বাভাবিক বেশি কোথাও শতভাগ, তদন্তে ইসি

গোলাম রাব্বানী

ভোট পড়েছে অস্বাভাবিক বেশি  কোথাও শতভাগ, তদন্তে ইসি

ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অনিয়ম, ভোট কেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাই, প্রকাশ্যে সিল মারার ঘটনার পাশাপাশি অনেক কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়ার চিত্র খুঁজে পেয়েছে নির্বাচন কমিশন। এমনকি অনেক এলাকায় মৃত ও বিদেশে অবস্থানরত ভোটারের ভোট কাস্ট হওয়ারও প্রমাণ মিলেছে। সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসার এ নিয়ে মুখ না খুললেও ইসিতে পাঠানো কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফলের তথ্য পেয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন ইসি সচিবালয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এমন চার ধাপের ভোটে চার শতাধিক কেন্দ্রে ৮০ ভাগের বেশি ভোট পড়াকেও অস্বাভাবিক মনে করছেন নির্বাচন বিশ্লেষকরা। তাদের দাবি, স্থানীয় নির্বাচনে অনেক ভোটার এলাকার বাইরে অবস্থান করেন, এ ছাড়া ভোট গ্রহণে দায়িত্ব থাকা বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তাও ভোট দিতে পারেন না, এমন পরিস্থিতে ৮০ ভাগের ওপরে ভোট কাস্ট অসম্ভব ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে সিল মারা ছাড়া এমন ভোট হতেই পারে না। এদিকে শতভাগে ভোট গ্রহণসহ যেসব কেন্দ্রে অস্বাভাবিক ভোট গ্রহণ হয়েছে তা তদন্ত করার উদ্যোগ নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন।

ইসি সূত্র জানিয়েছে, চতুর্থ ধাপে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার চরআড়ালিয়া ইউপির দুটি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে। পরাজিত প্রার্থী বুধবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার বরাবর এ-সংক্রান্ত অভিযোগও জমা দিয়েছেন।

এর আগে তৃতীয় ধাপের ভোটে অস্বাভাবিক ভোট পড়ার হার দেখা গেছে। বিগত সব রেকর্ড ভঙ্গ করে খাগড়াছড়ির মাটিরাঙা উপজেলার বেলছড়ি ইউপিতে সর্বোচ্চ প্রদত্ত ভোটের হার দেখানো হয়েছে ১৯৬ শতাংশ। একইভাবে নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার চন্দননগর ইউপিতে ভোট পড়েছে ১০৭ শতাংশ। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) প্রস্তুত করা ফলাফল বার্তায় এ তথ্য দেখানো হয়েছে। যত ভোটার তত ব্যালট ব্যাপার ইসি সরবরাহ করে থাকলেও এত ব্যালট পেপার কোথা থেকে এসেছে তা নিয়ে অবাক ইসির কর্মকর্তারা। যদিও ওই ধাপের এ তথ্যকে ভুল বলে উড়িয়ে দিয়েছিল ইসি। কিন্তু চতুর্থ ধাপেও শতভাগ ভোট পড়ার ঘটনায় টনক নড়েছে ইসির। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এটা অসম্ভব। কেন্দ্রে সব ভোট পড়ার সুযোগ নেই। বিদ্যমান তালিকায় দু-এক জন মৃত ভোটার, প্রবাসী কিংবা অন্য এলাকায় নির্বাচনী দায়িত্বে থাকা ভোটার থাকেই। শতভাগ ভোট পড়ার বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। ইসি কর্মকর্তারা জানান, বিষয়টি তদন্ত না করে গেজেট প্রকাশ করা হবে না। অনিয়ম নিয়ে দায়িত্বশীল রিটার্নিং কর্মকর্তা ভোটের দিন কোনো অভিযোগ না জানানোয় ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে। শিগগির তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। চতুর্থ ধাপের প্রাথমিক ফলাফলে দেখা গেছে, বাতাকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৮৫২ ভোটের সব ভোটই দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে নৌকায় ৮৪৩, হাতপাখায় ১ ও বাতিল হয়েছে ৮ ভোট। বটতুলি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোট রয়েছে ১ হাজার ৯০। এতে নৌকা প্রতীকে ১ হাজার ৭৩, ধানের শীষে ৩, হাতপাখায় ৪ ও বাতিল ভোট ১০। খামারপাড়া মাদ্রাসায় ৯২১ ভোটের মধ্যে ৯০০ ও ৯৭৪ ভোটের মধ্যে ৯৭৩ ভোট পড়েছে। চরআড়ালিয়া ইউপির ৯টি কেন্দ্রে মোট ভোটার ১০ হাজার ১০০। এর মধ্যে বৈধ ভোট পড়েছে ৮ হাজার ৫৩২টি। বাতিল হয়েছে ১১০ ভোট। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী নুরুজ্জামান সরকার (নৌকা) পেয়েছেন ৫ হাজার ৪৮, বিএনপির মো. হাসানুজ্জামান (ধানের শীষ) ৩ হাজার ২৮৫ ও স্বতন্ত্র মো. শাহানশাহ পেয়েছেন ১৯৯ ভোট। এ বিষয়ে রায়পুরা উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. ফখর উদ্দিন বলেন, ‘চরআড়ালিয়া ইউপির দুটি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়ার বিষয়টি রিটার্নিং কর্মকর্তার মাধ্যমে জেনেছি। বিষয়টি নিয়ে কমিশন তদন্ত করতে পারে; এখন ইসির সিদ্ধান্ত পেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ একইভাবে শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার ৬ নম্বর সদর ইউনিয়নের এক সাধারণ সদস্য পদের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী সোহেল রানা ইসিতে অভিযোগ করেছেন, তার ২ নম্বর ওয়ার্ডের ১ হাজার ৪৫৩ ভোটারের মধ্যে ৫৩ জন মৃত। বাকিদের ৭ জন নির্বাচনী দায়িত্বে ইউনিয়নের বাইরে ছিলেন। প্রবাসেও রয়েছেন কয়েকজন। কিন্তু ৩১ মার্চের দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে ওই কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ দেখানো হয়েছে ১ হাজার ৪২২টি। তিনি দাবি করেন, তার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রার্থী মো. আবদুল হালিম ও ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য প্রার্থী আইয়ুব আলীর সমর্থকরা কেন্দ্র থেকে তার এজেন্ট বের করে দিয়ে ভোট ভাগ-ভাটোয়ারা করে নিয়েছেন।

৮০ ভাগের বেশি ভোট অস্বাভাবিক : তৃতীয় ধাপের ভোট বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ৬১৫ ইউপির মধ্যে ৯টিতে ৯০ ভাগের ওপরে ভোট পড়েছে। এর মধ্যে কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীর নুনখাওয়া ইউপিতে ভোট পড়েছে ৯৩.১৭ ভাগ। এ ছাড়া রাজশাহীর তানোর উপজেলার চান্দিড়িয়া ইউপিতে ভোট পড়েছে ৯০.৮১ ভাগ, এখানে মোট ভোটার ৮ হাজার ৭০১ জন। এ ছাড়া তানোরের সরনজাইয়ে ভোট পড়েছে ৯০.২০ ভাগ, তালন্দতে ৯১.৪৫ ভাগ। এ তিন ইউপিতে নৌকা বিজয়ী হয়েছে। এদিকে ২৩১ ইউপিতে ৮০ ভাগের ওপরে ভোট পড়েছে। এসব ইউপির অধিকাংশে জয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা। বিশ্লেষকদের মতে, ভোটের দিন এসব ইউপিতে ভোটার উপস্থিতি অনেকটা কম থাকলেও এই অস্বাভাবিক ভোট গ্রহণ হয়েছে! অন্যদিকে প্রথম ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে অন্তত ১২৭টিতে। এর মধ্যে ৯০ শতাংশের ওপরে ভোট পড়েছে ছয় ইউপিতে। এ হিসাবে এক-চতুর্থাংশ ইউপিতে ৮০ শতাংশের ওপর ভোট পড়েছে। এ ধাপের ৫১৪টির ফল পর্যালোচনায় এ তথ্য পাওয়া গেছে। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ১২৭টি ইউপির মধ্যে ৯১টিতে আওয়ামী লীগ মনোনীতরা জয়ী হয়েছেন। এ ছাড়া ১৫টিতে বিএনপি ও ২১টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। স্বতন্ত্রদের দু-এক জন বাদে বাকি সবাই আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী হয়ে এ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। তা ছাড়া ২৬৩ ইউপিতে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত ভোট পড়েছে।

এক কেন্দ্র স্থগিত থাকলেও গেজেট প্রকাশের সিদ্ধান্ত : চলমান ইউপি নির্বাচনে কেন্দ্র স্থগিত থাকলেও ভোটের ব্যবধানে জয় নিশ্চিত হলে নির্বাচিতদের ফলাফল গেজেট প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি। আগে কেন্দ্র স্থগিত রেখে গেজেট প্রকাশ করা হতো না। একজন নির্বাচন কমিশনার জানান, ‘কোনো ইউপিতে মাত্র একটি কেন্দ্রের ভোট স্থগিত থাকলে চেয়ারম্যান পদের গেজেট প্রকাশ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে ওই কেন্দ্র ছাড়া বাকি ওয়ার্ডের সদস্যপদে বিজয়ীদের গেজেটও করা হবে। সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে আমরা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। স্থগিত কেন্দ্রের পুনর্নির্বাচনের পর ওই ওয়ার্ডের সদস্যদের গেজেট পরবর্তীতে করা হবে।’ প্রথমবারের মতো দলীয় ভিত্তিতে ইউপি ভোট হচ্ছে এবার। চার ধাপের ভোট শেষ হয়েছে। ২৮ মে ও ৪ জুন পরবর্তী দুই ধাপের ভোট হবে।

সর্বশেষ খবর