শুক্রবার, ২৭ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

১২ দূষণে দুর্বিষহ নগর জীবন

সাঈদুর রহমান রিমন

১২ দূষণে দুর্বিষহ নগর জীবন

ঢাকায় উচ্চশব্দসহ সর্বগ্রাসী ১২ ধরনের দূষণে ৩১টি কঠিন রোগ জনজীবন দুঃসহ করে তুলেছে। রাজধানীর চারপাশে তুরাগ, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু, ধলেশ্বরী ও বংশী নদীর প্রায় ১১০ কিলোমিটার ও পাশের অঞ্চল আজ দুর্বিষহ দূষণের শিকার। দূষণের বিস্তৃতিতে শহরতলির ৩০ গ্রামের কৃষি ধ্বংসের মুখে। পরিবেশ দূষণ আর প্রতিবেশ বৈরিতায় রাজধানীজুড়ে চলছে দুর্বিষহ জীবনযাত্রা। দূষণের ভয়াবহতায় বিপন্ন হয়ে পড়েছে নগরজীবন। কারখানার কেমিক্যাল বর্জ্যে ঢাকার নদী-নালা-খালের সব জলাধার বিষাক্ত হয়ে আছে। বর্জ্য মিশ্রিত পানি শুধু বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু আর শীতলক্ষ্যা নদীকে বিষাক্ত করেই ক্ষ্যান্ত হয়নি, রাজধানী সংলগ্ন ৩০টিরও বেশি গ্রামের কৃষিক্ষেত্রকে ধ্বংস করে দিয়েছে। এখন সেসব এলাকার তিন ফসলি জমিও সারা বছর অনাবাদি পড়ে থাকে। বিষময় বর্জ্যের ধকলে বোরো ধানের আবাদ পর্যন্ত করা যাচ্ছে না। ফলে জমি-ফসলের উপর নির্ভরশীল লক্ষাধিক কৃষক সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, পরিবারগুলোতে নেমে এসেছে অভাবের      যন্ত্রণা। এদিকে শব্দ ও বায়ু দূষণে হৃদরোগ, শ্বাসকষ্ট-অ্যাজমাসহ জটিল রোগের শিকার হচ্ছেন নগরবাসী। দূষিত পানির ভয়াবহতায় দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভুগছেন নদী-তীরবর্তী বিপুলসংখ্যক মানুষ। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ সূত্র জানায়, উচ্চশব্দসহ ১২ ধরনের দূষণ ৩১টি কঠিন রোগ সৃষ্টি করছে। কার্ডিওলজিস্ট ডা. বিপ্লব ভট্টাচার্য বলেন, গাড়ির হর্ন, বোমা বিস্ফোরণ বা যে কোনো ধরনের উচ্চশব্দ হৃদরোগীর জন্য খুবই ক্ষতিকর। মাত্রাতিরিক্ত শব্দের কারণে মানুষের করোনারি হার্ট ডিজিজও হতে পারে। ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশের এক জরিপে শব্দ দূষণের প্রভাব সম্পর্কে বলা হয়, অতিশব্দের কারণে বিরক্তবোধ, মাথাধরা, মেজাজ খারাপ হওয়া, মনসংযোগের সমস্যা, ঘুমের ব্যাঘাত এবং কানে কম শোনার ঘটনা ঘটছে। চিকিৎসকদের মতে, শব্দদূষণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) এক গবেষণার তথ্য মতে, প্রতিদিন দশমিক ৫ মিলিয়ন ঘনমিটার গৃহস্থালি বর্জ্যের বিপরীতে প্রায় ৭ হাজার শিল্প ইউনিট থেকে নির্গত ১ দশমিক ৩ মিলিয়ন ঘনমিটার শিল্পবর্জ্য মূলত খাল-নদী-জলাশয় দূষণের জন্য শতকরা ৬০ ভাগ দায়ী। পানীয় জলে জীবাণু আছে, নালা-নর্দমা পরিচ্ছন্নতারও বালাই নেই। যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ক্লিনিক্যাল বর্জ্য-বিষাক্ত কেমিক্যাল। আবাসিক বাড়িঘরই ব্যবহৃত হচ্ছে রাসায়নিক দ্রব্যাদির গুদাম হিসেবে। এত সব দূষিত পরিবেশে মানুষের আয়ু, কর্মদক্ষতা ও শিশুদের সুস্থ বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দেখা দিচ্ছে নিত্যনতুন রোগবালাই। পরিবেশ বিপর্যয়ের এমন হাজারো অব্যবস্থাপনার শিকার হচ্ছেন সিংহভাগ মানুষ। বিশেষজ্ঞদের মতে, দূষণের কারণে মানুষের সঙ্গী হচ্ছে নানা জটিল রোগ-বালাই, কমছে গড় আয়ু আর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। এখন থেকে পরিবেশ সুরক্ষা করতে না পারলে সামনে অপেক্ষা করছে ভয়াবহ বিপর্যয়। ঢাকা মহানগরীতে মানুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দূষণ। কিন্তু বাড়েনি প্রয়োজনীয় গাছপালা আর সবুজ বেষ্টনী; বরং কমেছে। রমনা, শাহবাগ, তেজগাঁও, বনানী, গুলশান, বাড্ডা, মানিক মিয়া এভিনিউসহ ঢাকার অন্যান্য রাস্তাঘাট, পার্ক ও উদ্যান থেকেও বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বৃক্ষ। এককালের ছায়া-সুনিবিড় ঢাকা এখন খাঁ খাঁ মরুভূমি যেন। গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইএসএসের গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে রাজধানীর সবুজ উধাও হওয়ার ভয়াবহ চিত্র। গাছপালার অভাবে ঢাকার আবহাওয়া ক্রমেই উত্তপ্ত হচ্ছে। বিশিষ্ট পরিবেশ বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. কাজী জাফর হোসেন বলেন, ঢাকা আসলে বসবাসের উপযোগী নয়। ঢাকায় পরিবেশের প্রাণ সবুজ বৃক্ষ আর নেই। যেটুকু আছে তা-ও কিছু অংশ বিদেশি গাছ। শুধু গাছ লাগালে হবে না, ঢাকায় দেশি প্রজাতির গাছ লাগিয়ে ব্যাপকভিত্তিক বনায়ন প্রয়োজন। ফলে ক্রমশ হুমকির মুখে পড়ছে জনস্বাস্থ্য ও জীববৈচিত্র্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ু দূষণের শতকরা ৩৫ ভাগ দায়ী অপরিকল্পিত ইটভাটা। এর কালো ধোঁয়া ঢাকায় এসিড বৃষ্টির আশঙ্কাও বাড়িয়ে তুলছে। জনবসতিপূর্ণ এলাকার ৫ মাইলের মধ্যে কোনো ইটভাটা নির্মাণ না করার নিয়ম থাকলেও তা কেউ মানে না। সরকারি হিসাব অনুযায়ী দেশে মোট ইটভাটার সংখ্যা ১ লাখ ২৬ হাজার ৫১০টি। এর মধ্যে অবৈধ ইটভাটার সংখ্যা ১ লাখ ৫১০টি। সবচেয়ে বেশি ইটভাটা রয়েছে ঢাকায়। ঢাকা বিভাগে ২৬ হাজার ইটভাটার মধ্যে বৈধ মাত্র ৫ হাজার ৫১০টি। সিংহভাগ ইটভাটাই গড়ে উঠেছে রাজধানীর মতো ঘন জনবসতিকে ঘিরে। প্রতিমাসে জেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদফতর ও বিভিন্ন প্রশাসনিক সংস্থাকে মোটা অঙ্কের মাসোহারা দিয়ে ইটভাটাগুলো সচল রাখা হয়।

সর্বশেষ খবর