শনিবার, ২৮ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা
বরিশাল জুড়ে আলোড়ন

মাদক ব্যবসায়ী ও পুলিশ কর্মকর্তার ফোনালাপ

রাহাত খান, বরিশাল

মাদক ব্যবসায়ী ও পুলিশ কর্মকর্তার ফোনালাপ

‘এসি ছারের (স্যারের) সাথে আজকে কথা হইছিল। ছার ডাইরেক্টলি বলেছে, শওকত, ফারুক, তালুকদার বাবুল সবগুলারে ধর। জিনিস (মাদক) লাগবে না, জিনিস ধইর‍্যা দিমুহানে। পরে বলছি কী— ছার, শওকত হইল আমাগো নিয়ারেস্ট লোক। ও মহুরিগিরি করে, ও তো ব্যাচে-ট্যাচে না (বিক্রি করে না) দুই-একটা মাল (ফেনসিডিল) খায়টায়, এইডা মিথ্যা কতা না। আর যা খায় হেইডা বাবুলের কাছ দিয়াই নেয়। ছার জিগায় এইটা সত্যি? আমি কই, জি ছার! বিসিক বাবুলের কাছ দিয়াই নেয়। ছারে শুইন্যা কয়, ঠিক আছে তাইলে। ঠিক আছে মানে কী, বিসিক বাবুলের সাথে একটা কন্ট্রাক্ট আছে মনে হয়, বোজ্য (বুঝেছ)? এই একখান কতা কইয়া তোমারে সেইভ কইর‍্যা দিছি। মাল (ফেনসিডিল) ৫০টা-১০০টা যা চালাইতে পার। ও কিন্তু ইয়াবাও ব্যাচে (বিক্রি করে) বোজ্য? ইয়াবাও ধরছে কিন্তু (ডিবিতে), গুডি (ইয়াবা) ছোডগুলা ধরছে চম্পা (মাদকসেবীদের কাছে কম দামি ইয়াবার নাম চম্পা)। হ্যাঁ (চম্পা) অন্য জায়গায় ১৩০, ১৫০ টাকাও ব্যাচে। ও (বিসিক বাবুল) ব্যাচে ১২০ টাকা। তুমি এই তথ্য দুই-চাইর জায়গায় জানাইয়া দেলে বিসিক বাবুলের বেচাকেনা একটু ভালো হইবে। আর সাপোর্ট যা দেওয়া লাগে হেইডা   আমি দিমু হানে। তুমি এর আগে ২০টা ২০টা কইর‍্যা দুইবার মাল (ফেনসিডিল) নেছালা। হেরপর আবার বাদ দিয়া দেছো। বাইরে কয় টাহা কইর‍্যা কেন? ফ্রেশ মাল আসছে, ফ্রেশ মাল। শোনো, শোনো, শোনো! এসি ছারে আর আমি দুইজনেই বিকালবেলা বাইর হইয়া গেছিলাম, ওই জায়গা দিয়া ঘুইর‍্যা আইছি। জিনিস (ফেনসিডিল) একেবারে এক নম্বর জিনিসই আনছে, সমস্যা নাই। তুমি চালাইয়া নিও। তোমার সেইফের বিষয়টা আমি দেখমুহানে। আর আমি বইল্লা দিছি বাবুলরে, শওকত ভাই কালকে থেকে ২০-৪০টা যা পারে নেবে হানে, টেনশন করার কিছু নাই, আর বাবুলরে বলছি শওকতের ব্যাপারটাও দেইখ্যেন। আর আমি ছারের সাথে বিস্তারিত বইল্লা দিছি। তুমি চাইলে ছারের সাথেও যোগাযোগ কইর‍্যা দেখতে পার যে, ছার, আপনি নাকি এই কথা বলছেন, রতন ভাই তো বলল। ঠিক আছে কালকে থেকেই কইররো কিন্তু।’ এগুলো কোনো নাটক, সিনেমা কিংবা গল্পের ডায়ালগ নয়। শওকত নামে একজন মাদকসেবী ও সরবরাহকারীর সঙ্গে বরিশাল মেট্রোপলিটন ডিবি পুলিশের সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই, নম্বর-১০৭৭) রতন চৌধুরীর ফোনালাপ এটি। এ ধরনের দুটি ফোনালাপের রেকর্ডিং এই প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত আছে। এই ফোনালাপ নিয়ে এখন বরিশালজুড়ে আলোড়ন। এর আগে আরেকটি ফোনালাপে রতন একই ব্যক্তিকে বলেন, ‘বিসিকের যে বাবুল ভাই, হে তো মনে হয় ব্যবসা শুরু করছে জান নাকি।’ শওকত উত্তরে বলেন, ‘হ হে কইছে।’ রতন বলেন, ‘তুমি যে মালডা খাও নেও, হেইডা অন্য জায়গা দিয়া না নিয়া একটা জায়গা (বিসিক বাবুল) দিয়া নেও। কারণ, এই একটা জায়গার সাথে আমাগো প্রশাসনের লিয়াজুঁ আছে। যে কারণে তুমি যদি মাল লইয়া ধরাও খাও কইলেই হইবে যে, বিসিক বাবুলের কাছ দিয়া আনছি, মাফ পাইয়া যাবা।’ শেষমেশ এএসআই রতন বলেন, ‘এহন আমার কথা শোনো, তুমি কালকে থেকে মাল নেবা বাবুলের ওইখান থেকে। এইডা তোমার সেইভের জন্য। আর না হইলে তোমারে কিন্তু ধরার হুলিয়া হইছে। যেখানে যে অবস্থায় পাওয়া যাইবে, মাল লাগবে না, এই অর্ডার হইছে বোজ্য? এই কথা আমি তোমারে গোপনে বলছি, এই কথা দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তির কানে না দিয়া তুমি যা নেও ওর (বিসিক বাবুল) কাছ থেকে নিয়াই করবা, যদি কেউ তোমারে ধরে আমারে ফোনডা ধরাইয়া দেবা, বাকিটা আমি দেখমু।’ জবাবে শওকত আবারও ‘আচ্ছা ছার’ বলে কথা শেষ করতে চাইলেও রতন বলেন, ‘আমি বাবুল ভাইরে ফোন দিয়া বলমুহানে, অন্য সবার কাছ থেকে ১ হাজার টাকা কইর‍্যা নেন, ওর (শওকত) কাছ থেকে ৫০ টাকা কইর‍্যা কম নিয়েন। যা করা লাগে আমি করমুহানে। তুমি ২০-৪০টা যা চালাইতে পারবা ওইহান দিয়া নেবা। আমি কালকে খোঁজ নিমু কিন্তু বাবুল ভাইয়ের কাছ থেকে।’ মাদকসেবীদের ভাষ্যমতে, বিসিক বাবুল প্রকাশ্যে হম্বিতম্বি করে মাদক বিক্রি করছেন। তিনি পুলিশসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের মাসোয়ারা দিয়ে ব্যবসা করেন বলে তার কাছ থেকে মাল নিলে কেউ বিপদগ্রস্ত হয় না বলে ক্রেতাদের অভয় দিচ্ছেন। কয়েক মাস আগে ব্যবসা শুরুর আগে পুলিশসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের নগদ ৫ লাখ টাকা দিয়েছেন বলে বাবুল তার ক্রেতাদের নির্ভয়ে থাকতে বলেছেন। এভাবে বরিশাল নগরীকে কয়েক মাস ধরে মাদকের স্বর্গরাজ্য বানিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু অসাধু সদস্য। এএসআই রতন ছাড়াও মেট্রো ডিবি পুলিশের এসআই মোস্তফা নগরীর আমতলা জুমির খান সড়কের ভাড়া বাসায় নিজে ইয়াবা বিক্রি করেন বলেও পুলিশের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে।

এ ছাড়া নগরীর আদম আলী হাজী গলির ভাড়াটিয়া পশ্চিম ঝালকাঠি নিবাসী সাকিল হোসেন সেন্টু, তার ছোট ভাই গির্জামহল্লার দোকানি ও ভগ্নিপতি রিকশাচালকবেশী আবুল, নথুল্লাবাদের দর্পণ, কামাল ওরফে হারবাল কামাল ও তার স্ত্রী; ফিশারি রোডের মুকুল, ইসলামপাড়া সড়কের কামাল ওরফে মাইজ্যা কামাল, নতুন বাজারের বেবি আপা এবং পশ্চিম কাউনিয়ায় রশিদ কোনো রাখঢাক না রেখেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আশ্রয়-প্রশ্রয়ে প্রকাশ্যে ফেনসিডিল ও ইয়াবা ব্যবসা করছেন। ১০ নম্বর ওয়ার্ডের কেডিসি বস্তির (আবদুর রাজ্জাক কলোনি) মাদকসম্রাজ্ঞী তাসলি বেগম ও লাবণী বেগম থানা-পুলিশ, ডিবি পুলিশ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, এপিবিএন, র‍্যাব এমনকি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য ছাড়াও কিছু অসাধু সাংবাদিককে প্রতিদিন অন্তত অর্ধলক্ষ টাকা চাঁদা দিয়ে ইয়াবা ও গাঁজা বিক্রি করছেন। এর বাইরেও নগরীতে পুলিশের তালিকাভুক্ত অন্তত ৫০০ মাদক বিক্রেতা রয়েছেন। বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (সদর) মো. হাবিবুর রহমান খান বলেন, ‘পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাদক নিয়ন্ত্রণ করবে। সেখানে পুলিশের কারও বিরুদ্ধে যদি মাদক বিক্রিতে সহায়তা করার অভিযোগ পাওয়া যায়, তাহলে অভিযোগ তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর