বুধবার, ৮ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

লাখো টাকার চাঁদাবাজি আছে জলাবদ্ধতা

মাহবুব মমতাজী

লাখো টাকার চাঁদাবাজি আছে জলাবদ্ধতা

গেণ্ডারিয়া রেললাইন দখল করে গড়ে উঠেছে অবৈধ স্থাপনা (বাঁয়ে) বছরজুড়েই জলাবদ্ধতা লেগে থাকে শ্যামপুরে —বাংলাদেশ প্রতিদিন

নানা সমস্যায় জর্জরিত পুরান ঢাকার প্রাচীন শিল্পনগরী খ্যাত শ্যামপুর। আগের সেই শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর জৌলুস এখন আর নেই। এই এলাকায় লোহার ব্যবসা চলে বেশ জমজমাট। এত কিছুর পরও শ্যামপুর এলাকায় রয়েছে চরম জলাবদ্ধতা। প্রতিবছর রাস্তা উঁচু করা হয় কিন্তু স্যুয়ারেজ লাইন পরিষ্কার করা হয় না বলে জলাবদ্ধতা লেগেই থাকে। এমন অভিযোগ করেছেন পশ্চিম জুরাইনের কবরস্থান রোডের বাসিন্দারা। এ ছাড়াও রেলওয়ে আয়রণ মার্কেটে এবং করিমুল্লাহবাগে বিভিন্ন ভাঙা লোহা, পরিত্যক্ত পলিথিন ও স্যান্ডেলের গোডাউন এবং কারখানাগুলোয় অনিরাপদ ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করছে নারী-শিশুরা। এসব কাজের বিনিময়ে তাদের দেওয়া হয় খুবই সামান্য মজুরি। শ্যামপুর বাজার, গেণ্ডারিয়া রেল স্টেশনের পূর্ব পাশ, ঘুণ্ডিনগর, ফরিদাবাদ, ধলেশ্বর ও পোস্তগোলা ব্রিজ নিয়ে গঠিত শ্যামপুর থানা এলাকার মোট জনসংখ্যা এক লাখ ৯ হাজার ৩৩৩। এখানে প্রাচীন নিদর্শনাদি ও প্রত্নসম্পদের মধ্যে রয়েছে শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ গোস্বামী আখড়া এবং বিগ্রহ মন্দির। এলাকাটি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৪৭ এবং ৫৪ নম্বর ওয়ার্ডভুক্ত।  জানা গেছে, এই এলাকায় কলেজ আছে তিনটি। মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছয়টি। প্রাথমিক বিদ্যালয় ২৮টি। এনজিও স্কুল ৭টি এবং মাদ্রাসা ৯টি। উল্লেখযোগ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হচ্ছে— শ্যামপুর উচ্চবিদ্যালয়, শহীদ জিয়া গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ, জুরাইন আশরাফ মাস্টার আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়, নতুন জুরাইন কে এম মাইনুদ্দিন হাইস্কুল, মুরাদপুর সমীরণ নেসা উচ্চবিদ্যালয়, মুরাদপুর ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসা ও আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ক্লাব ৭টি রয়েছে। তবে শিল্প ও কলকারখানা, পোশাক শিল্প, আইসক্রিম ফ্যাক্টরি, বেকারি, করাতকল ও লৌহশিল্পের জন্য পরিচিতি আছে এলাকাটির। ছোট ও মাঝারি কয়েক হাজার শিল্প-কারখানা সমস্যামুক্ত হয়নি আজও। রয়েছে গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট আর জলাবদ্ধতার সমস্যা। পুরো শ্যামপুরে ঘুরলেই চোখে পড়বে ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানা, প্লাস্টিক ও অ্যালুমিনিয়াম পণ্য তৈরির কারখানা, ছোট ছোট টেক্সটাইল মিল। এখানে আছে ৪০টির মতো ডায়িং কারখানা। প্রায় ২০টির মতো রি-রোলিং মিল ও ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ। কয়েক দশক ধরে নিজস্ব উদ্যোগেই গড়ে উঠেছিল এসব ছোট ও মাঝারি শিল্প-কারখানা।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, গেণ্ডারিয়া রেল স্টেশনের কিছু দূর থেকে শুরু করে জুরাইন রেলগেট পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার রেল লাইনের দুই ধার ঘেঁষে গড়ে তোলা হয়েছে মুদি বাজার। সেখানে আবদুস সামাদ নামের এক ব্যবসায়ী জানান, এই বাজারটি রেলের জায়গার ওপর অনেক আগ থেকেই আছে। এখান থেকে কোনো ধরনের কর বা ভাড়া রেল কর্তৃপক্ষকে দেওয়া হয় না। এই বাজারের সঙ্গে সিটি করপোরেশনেরও কোনো সম্পর্ক নেই।

রেল লাইনের দু-পাশ ঘেঁষে গড়ে ওঠা জুরাইন বাজারে আছে মুরগি হাট, ফার্নিচারের মার্কেট, তরিতরকারির দোকান, ফল-ফলাদির দোকান, চা-পানের দোকান, প্লাস্টিক সামগ্রীর দোকান, হাঁড়ি-পাতিল ও খেলনা সামগ্রীর দোকান। জানা গেছে, প্রতিটি দোকানই অবৈধভাবে বসানো হয়েছে। আরও জানা যায়, গত বছরের ৮ নভেম্বর ধারাবাহিক উচ্ছেদ অভিযানের অংশ হিসেবে জুরাইন বাজারের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে অভিযান চালায় রেলওয়ে কর্মকর্তারা। এই অভিযানে রেলওয়ে পুলিশ ও শ্যামপুর থানা পুলিশও অংশ নেয়। পরবর্তীতে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের বাধায় সেই অভিযান পণ্ড হয়ে যায়।

বাজারের একাধিক ব্যবসায়ী জানান, এই বাজারটি আগে নিয়ন্ত্রণ করত জুরাইন বাজার বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি হাজী আবদুর রহিম। তিনিই আয়তন অনুসারে প্রতি দোকান থেকে প্রতিদিন ৪০-১০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা নিতেন। তারা এও জানান, আর এ বাজারটি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৫৪ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত হওয়াতে এর নিয়ন্ত্রণ এখন নিয়েছেন কাউন্সিলর হাজী মো. মাসুদ। তিনি এখান থেকে প্রতিদিন প্রায় পাঁচ লাখ টাকার বেশি চাঁদা তোলেন। বাজারের মধ্যদিয়ে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথ। এই পথে প্রতিদিন ২৬টি ট্রেন আসা-যাওয়া করে থাকে। এতে অনেকটা ঝুঁকির মধ্যেই ব্যবসা কার্যক্রম চালাতে হয় বলে স্বীকার করেন ব্যবসায়ীরা। 

সরেজমিন গিয়ে জানা যায়, জুরাইন রেলগেটের পূর্বে সুপার মার্কেটের সামনের রাস্তার ড্রেনেজ লাইন মেরামতের জন্য প্রায় দু-মাস ধরে খুলে রাখা হয়েছে। যার কারণে স্থানে স্থানে রাখা হয়েছে ময়লা কাঁদা-মাটির স্তূপ। যেগুলো পরিষ্কার করা এবং ড্রেন মেরামতের জন্য যেন কারও কোনো উদ্যোগ নেই। ফলে একটু বর্ষাতে চরম বিড়ম্বনায় পড়তে হয় সাধারণ মানুষকে। জানা গেছে, তীব্র পানি সংকটের কারণে উত্তর জুরাইন নতুন রাস্তা, খন্দকার রোড, মুন্সিবাড়ী নতুন রাস্তা ও ১৪৯ পশ্চিম জুরাইন তুলা বাগিচা রোডে লাইনে দাঁড়িয়ে প্রতিদিন পাম্পের পানি সংগ্রহ করছেন বাসিন্দারা। জুরাইন রেলগেটে বেহাল ট্রাফিক ব্যবস্থায় দিনভর লেগেই থাকে তীব্র যানজট। আর এই কারণে প্রতিদিনই পোস্তগোলা থেকে জুরাইন পর্যন্ত উজানমুখী রাস্তায় রিকশা-ভ্যানের সঙ্গে ধোলাইপাড়, গুলিস্তান ও বাবুবাজার চলাচলকারী হিউম্যান হলারের সংঘর্ষে দুর্ঘটনা ঘটে। যানজট নিরসনের কাজ ছেড়ে উল্টো আল মদিনা বেকারি এবং আল মক্কা সুইটের সামনে বসে থাকেন ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা।

আরও জানা যায়, ৫০/৮ জুরাইন বালুর মাঠ, ১৪৯, ১৫০, ১৫৫ পশ্চিম জুরাইন তুলাবাগিচা গলিগুলো অপরিচ্ছন্ন এবং শুকনো মৌসুমেও লেগে থাকে জলাবদ্ধতা। স্যুয়ারেজ লাইনে জ্যামের কারণে ড্রেনের ময়লা কালো পানি উপরে উঠে জমে থাকে। এতে চলাচলে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় সেখানকার বাসিন্দাদের। এলাকার প্রধান রাস্তাগুলো কিছুটা ভালো বটে। তবে অলিগলির অত্যন্ত করুণ দশা। মিল ব্যারাক, ফরিদাবাদ, ব্যাংক কলোনি ও বালুর মাঠ পানির পাম্প থাকলেও সরবরাহে সেগুলো অপর্যাপ্ত বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর। তারা আরও অভিযোগ করেন, এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য তুলাবাগিচা পুকুরটি রাখা হয়েছিল। কিন্তু সেটি শাহী সাহেব নামে এক ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে। যেটির একটি অংশ ভরাট করে রিকশা-ভ্যানের গ্যারেজ বানিয়ে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। এলাকার অধিকাংশ ম্যানহোলের ঢাকনা চুরি হয়ে যাওয়াতে রাতের আঁধারে ঢাকনাবিহীন খোলা ম্যানহোলে যানবাহন, যাত্রী ও পথচারী পড়ে আহত হওয়ার ঘটনা ঘটছে অহরহ। এসব ঘটনায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেও কোনো সুফল পাওয়া যায় না বলে জানান ফল ব্যবসায়ী আবু হানিফ। তিনি আরও বলেন, ৩৭১ মাজার শরীফ মার্কেটের সামনের অংশে সন্ধ্যা নামলেই এখনো চলে ছিনতাই ও মাদকসেবীদের আড্ডা। জুরাইন বাজার সম্পর্কে ৫৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. মাসুদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব শুধু আমার একার নয়। এখানে এমপি আছেন, থানা ও ওয়ার্ড সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকরাও আছেন। তিনি আরও বলেন, আর জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ চলছে। ড্রেনে ময়লা-আবর্জনায় জ্যাম লাগার কারণে এই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর