শুক্রবার, ১০ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

কুষ্টিয়ায় কালের কণ্ঠ ও বাংলাদেশ প্রতিদিন প্রবেশে বাধা

নিজস্ব প্রতিবেদক

দৈনিক কালের কণ্ঠে সংবাদ প্রকাশের জের ধরে কুষ্টিয়ায় বেপরোয়া তত্পরতা চালাচ্ছে স্থানীয় সংসদ সদস্য মাহবুব-উল আলম হানিফের অনুসারীরা। কালের কণ্ঠের সাংবাদিক, সংবাদপত্র এজেন্টসহ বিভিন্নজনকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়ার পাশাপাশি পত্রিকা লুটের ঘটনা ঘটিয়েছেন তারা। সংবাদ সম্মেলন ও মানববন্ধনে কালের কণ্ঠ পত্রিকার নামে কুৎসা রটাচ্ছেন হানিফ অনুসারীরা। এদিকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে এসব ঘটনা রোধে আশ্বাস দেওয়া হলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। সশস্ত্র ক্যাডারদের মহড়া অব্যাহত রয়েছে কুষ্টিয়া শহরে। সার্বিক পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বিব্রত ও আতঙ্কিত। স্থানীয় সাংবাদিকরাও উৎকণ্ঠিত এ অবস্থায়। জেলা আওয়ামী লীগের একজন সিনিয়র নেতা এ প্রসঙ্গে বলেন, যেদিন থেকে আওয়ামী লীগে হানিফের উত্থান ঘটেছে, সেদিন থেকেই কুষ্টিয়ায় পেশিশক্তির প্রদর্শন বেড়েছে। তিনি আচরণগত কারণে আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে না পেয়ে বেছে নিয়েছেন দাগী সন্ত্রাসীদের। তার কাছে শোভন আচরণ প্রত্যাশা করাটাই বোকামি। গণমাধ্যমের সংবাদে কেউ একমত না হলে প্রতিক্রিয়া এমন হতে পারে না। প্রতিবাদের যথাযথ প্রক্রিয়া আছে। আওয়ামী লীগ-যুবলীগের নামে যারা ব্যানার নিয়ে রাস্তায় দাঁড়াচ্ছে, তাদের অধিকাংশই রাজনৈতিক নয়। ব্যক্তিস্বার্থে তারা জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে পত্রিকায় আগুন দিচ্ছে, ভাঙচুর করছে। তার দায় আওয়ামী লীগ নেবে না। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতারা হানিফ অনুসারীদের কর্মকাণ্ডে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তবে তারা নিরাপত্তার প্রশ্নে নাম প্রকাশে রাজি হননি। গতকাল জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনেও উপস্থিত হননি। এ পরিস্থিতিতে কালের কণ্ঠের বিরুদ্ধে আয়োজিত মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে দেখা গেছে চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও ভাড়াটে লোকজনকে। তারা ‘হানিফ ভাই, জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিয়ে মিছিল করেছে গতকালও। কুষ্টিয়া জেলা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সাগর বলেন, সংবাদপত্র প্রবেশে বাধাদান ও সাংবাদিকদের হুমকির ঘটনা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আর রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সাংবাদিক পরিচয়ে আমরা কেউ অংশ নিচ্ছি না। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় প্রেসক্লাবসহ সাংবাদিকরা সংশ্লিষ্ট নন।

পত্রিকা প্রবেশে বাধা : গতকাল কালের কণ্ঠ ও বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকা কুষ্টিয়া জেলায় প্রবেশে বাধা দিয়েছেন হানিফের অনুসারীরা। তারা কুষ্টিয়া জেলার প্রবেশমুখে পাংশাতে সংবাদপত্রবাহী গাড়ি থামিয়ে কালের কণ্ঠ পত্রিকা কেড়ে নেন। খোকসা উপজেলাতেও সংবাদপত্রের গাড়ি তল্লাশি করেন কয়েকজন সশস্ত্র যুবক। এরপরও বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকা কুষ্টিয়ায় পৌঁছলে তা বিলি না করার জন্য হকার ও এজেন্টকে হুমকি দেন হানিফের ক্যাডাররা। শহরের বিভিন্ন স্থানে সশস্ত্র ক্যাডাররা ঘুরে ঘুরে খোঁজ নিতে থাকেন কালের কণ্ঠ পত্রিকা ঢুকেছে কিনা। কুষ্টিয়ার সংবাদপত্র এজেন্ট এ বিষয়ে বলেন, ‘যুবলীগের কয়েকজন বলেছেন— কালের কণ্ঠ পত্রিকা আনলে মেরে ফেলা হবে। যে গাড়িতে পত্রিকা বহন করা হবে, তা পুড়িয়ে দেওয়া হবে। অন্তত প্রাণরক্ষার স্বার্থে আমাদের পক্ষে পত্রিকা আনা সম্ভব নয়। যারা হুমকি দিচ্ছেন, তারা সব কিছুই করতে পারেন।’ কুষ্টিয়া শহরের এক হকার বলেন, হানিফের অনুসারীরা টার্গেট করে ছিলেন মূলত কালের কণ্ঠ পত্রিকাকে। বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় এ সংক্রান্ত সংবাদ ছাপা হয়েছে তা তারা জানতেন না। সকালে পত্রিকা বিলি শুরু হলে তারা টের পেয়ে বিভিন্ন স্থানে গিয়ে এসব পত্রিকা কেড়ে নেন এবং পুড়িয়ে দেন। এরপর এজেন্টদের কাছে গিয়ে হুমকি দিতে থাকেন।

সশস্ত্র মহড়া : মাহাবুব-উল আলম হানিফের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশের অভিযোগ তুলে দুই দিন ধরে কালের কণ্ঠের বিরুদ্ধে মানববন্ধনের নামে সশস্ত্র মহড়া দিচ্ছেন যুবলীগ নামধারী কয়েকজন। তারা কুষ্টিয়ায় কালের কণ্ঠ কার্যালয়ে ককটেল নিক্ষেপ ও ভাঙচুর করেছেন। গতকাল তাদের একাংশ যুবলীগের ব্যানার নিয়ে মানববন্ধন করেছেন শহরের বকচত্বরে। ‘হানিফ ভাই, জিন্দাবাদ’ স্লেগান দিয়ে তারা মজমপুর গেট এলাকায় মিছিলও করেন। কুষ্টিয়া শহর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক জেড এম সম্রাট এসব তত্পরতায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার তালিকায় যিনি চিহ্নিত সন্ত্রাসী। তার নামে চাঁদাবাজি, হুমকির একাধিক মামলা রয়েছে। র‌্যাবের হাতে তিনি গ্রেফতার হয়েছেন কয়েক দফা। অন্যদিকে জেলা আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক রাশেদুল ইসলাম বিপ্লব বিভিন্ন কর্মসূচিতে সাংবাদিক ইউনিয়নের ব্যানার নিয়ে হাজির হচ্ছেন। তবে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি শাবান মাহমুদ জানিয়েছেন, ‘সাংবাদিক ইউনিয়নের কোনো ইউনিট কুষ্টিয়াতে নেই। যারা ব্যানার বহন করছে তারা সাংবাদিক ইউনিয়নের সদস্য নন।’

সংবাদ সম্মেলন : কুষ্টিয়া-৩ সদর আসনের সংসদ সদস্য মাহবুব-উল আলম হানিফের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ায় গতকাল এক সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করা হয় জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে। দুপুরে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক স্বপন কুমার ঘোষ। জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আলহাজ সদর উদ্দিন খান, সহ-সভাপতি শেখ গিয়াস উদ্দিন মিন্টু, মতিয়ার রহমান মজনুসহ হানিফ অনুসারী কিছু নেতা-কর্মী এ সময় উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে কুষ্টিয়ায় কর্মরত গণমাধ্যম কর্মীদের অধিকাংশকে দেখা যায়নি। সাংবাদিকদের অনেক আসন দখল করে ছিলেন যুবলীগ ও ছাত্রলীগ কর্মীরা। সংবাদ সম্মেলনে কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি সদর উদ্দিন খান বলেন, ‘আগামী কাউন্সিলে দলের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলামের সরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা আছে। আমি রোজা অবস্থায় বলছি, এক্ষেত্রে মাহাবুব-উল আলম হানিফ দলের সাধারণ সম্পাদক হবেন। তবে সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল হকও দলের সাধারণ সম্পাদকের পদ পেতে চেষ্টা করছেন। এ কারণে হানিফ সাহেবের বিরুদ্ধে পত্রপত্রিকায় অপপ্রচার চালানোসহ নানা ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে।’ তিনি ‘কুষ্টিয়ার উন্নয়ন’ অব্যাহত রাখতে এসব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় স্থানীয় সাংবাদিকদের মাহবুব-উল আলম হানিফের পক্ষে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান। গত ৭ জুন দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ‘কুষ্টিয়ায় রাজত্ব, হানিফ লীগের’ শিরোনামের সংবাদ। হানিফ অনুসারীদের দৌরাত্ম্যসহ নানা অনিয়ম এ প্রতিবেদনে প্রকাশ পাওয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে কতিপয় ব্যক্তি কুষ্টিয়ায় কালের কণ্ঠ বিরোধী নানা তত্পরতা শুরু করেছে।

সর্বশেষ খবর