শুক্রবার, ১০ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

প্রশ্ন ফাঁস চক্রের টার্গেট এবার ফল জালিয়াতি

আকতারুজ্জামান রুনকি

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ‘এ্যানি বোর্ড কোয়েশ্চন’ নামে একটি পোস্ট দেওয়া হয়। তাতে লেখা হয়েছে, যারা এইচএসসির ভালো ফল চান তারা ০১৭৬২৯৯৮৮৯২ নম্বরে তাড়াতাড়ি যোগাযোগ করুন। সেখানে আরও লেখা রয়েছে, ঢাকা বোর্ডের টাকা পরে নেওয়া হবে। অন্যান্য বোর্ডের জন্য টাকা আগে দিতে হবে। নম্বরটিতে ফোন দিয়ে এক এইচএসসি পরীক্ষার্থীর অভিভাবক পরিচয় দিয়ে রেজাল্ট পরিবর্তনের ব্যাপারে জানতে চাইলে, অপর প্রান্ত থেকে নিজেকে ‘জয়’ আহমেদ রানা বলে পরিচয় দেওয়া হয়। অপর প্রান্তের ব্যক্তি বলেন, যে কোনো বিভাগের ফল গোল্ডেন ‘এ’ প্লাস করে দেব। এ ক্ষেত্রে ২৫ হাজার টাকা দিতে হবে। এভাবেই ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবারসহ ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার করছে ফল জালিয়াতির একটি চক্র। নিয়ম অনুযায়ী নিবন্ধনবিহীন সিমকার্ড ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা। যদি চক্রটির ব্যবহার করা সিমগুলো নিবন্ধন করা হয়েই থাকে, তবে কেন তাদের খুঁজে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না— এমন প্রশ্ন অভিভাবক ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট মহলের। জানা যায়, প্রশ্ন ফাঁসের জালিয়াত চক্রের এবার টার্গেট পরীক্ষার ফল জালিয়াতি। শিক্ষার্থীদের রেজাল্ট পরিবর্তনের আশ্বাস দিয়ে তারা হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। ঘুরেফিরে সেই একই চক্র। ফল জালিয়াতির জন্য মোটা অঙ্কের টাকাও দাবি করা হচ্ছে। দাবি করা হচ্ছে অগ্রিম। জয় নামে ওই জালিয়াত চক্রের সদস্য জানান, মাত্র ১০ হাজার টাকা অগ্রিম নেওয়া হবে। ফল পাওয়ার পর বাকি টাকা দিলে চলবে। টাকা লেনদেনের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি একটি বিকাশ নম্বর (০১৭৫০৬০৮৭৫৮) দেন। ফল পরিবর্তন করতে পারবেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘চার বছরের বেশি সময় ধরে বিভিন্ন পরীক্ষার ফল বাড়িয়ে দিচ্ছি ছাত্রছাত্রীদের। এ বছরের এসএসসিতেও দেড় শতাধিক শিক্ষার্থীর ফল জালিয়াতি করে বাড়িয়ে দিয়েছি।’ জানা যায়, ফেসবুকে এমন শত শত অ্যাকাউন্ট, পেইজ ও গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। বিভিন্ন মোবাইল নম্বর ও বিকাশ অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে পরীক্ষার ফল ভালো করে দেওয়ার আশ্বাসে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে চক্রটি। প্রশ্ন ফাঁসে বিটিআরসির সতর্ক থাকার কথা থাকলেও অভিযোগ উঠেছে, এ ব্যাপারে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই এ সংস্থাটির। ফেসবুকে দেওয়া জালিয়াত চক্রের সব সিমকার্ডই সচল রয়েছে। ফল বাড়িয়ে দেওয়ার কৌশল সম্পর্কে জানতে নাম প্রকাশ না করে জালিয়াত চক্রের আরেক সদস্য জানান, বোর্ডের কর্মকর্তা ও কর্তাব্যক্তিদের মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ফল বাড়িয়ে নেওয়া হয়। এসএসসিতে জিপিএ-৩ পাওয়া ছাত্রকে গোল্ডেন জিপিএ-৫ করিয়ে দেওয়ার রেকর্ড রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রতিবেদক পরিচয় দিয়ে রেজাল্ট পরিবর্তনের কথা বলে প্রতারণার কারণ জানতে চাইলে জয় দাবি করেন, ‘আমরা কোনো প্রতারণা করি না। টাকা নিই রেজাল্ট দিই।’ এদিকে ‘সাদমান পিকে’ নামের অ্যাকাউন্টের টাইমলাইন ঘেঁটে দেখা গেছে, এনটিআরসিএ পাস করিয়ে দেওয়াসহ বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। তিনি লিখেছেন, যারা খারাপ ফল করেছ অথবা পুরো রেজাল্ট পরিবর্তন করতে চাও তারা পিতা-মাতাসহ চাইলে দেখা করতে পার। ০১৬৩১৪৪০২২৮ মোবাইল নম্বর দিয়ে তিনি লিখেছেন, বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্ন শতভাগ কমন পড়ার শর্তেই পরীক্ষার পর টাকা নেবেন তিনি। নম্বরটিতে কয়েকবার ফোন করা হলেও কেউ ধরেননি। ‘পিএসসি টু মাস্টার্স, মেডিকেলস অ্যান্ড নিবন্ধন এক্সাম ১০০ পার্সেন্ট রিয়েল প্রশ্ন অল বোর্ড’ নামে গ্রুপ ব্যবহার করছে প্রশ্ন ফাঁস জালিয়াত চক্রের সদস্যরা। এখানে পোস্ট করে প্রশ্ন ফাঁস, রেজাল্ট পরিবর্তন করে দেওয়ার আশ্বাস দিচ্ছে চক্রটি। এর মাধ্যমে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে তারা মোটা অঙ্কের টাকা। এস কে আবদুল আলম নামের এক ফেসবুক ব্যবহারকারী গ্রুপটিতে ঘোষণা দিয়ে ঢাকা, রাজশাহী ও দিনাজপুর বোর্ডের এইচএসসি রসায়ন দ্বিতীয় পত্রের প্রশ্ন দেওয়ার আশ্বাস দিচ্ছেন। টাইমলাইনে দেওয়া ০১৭৫৮৭১২০৫৮ নম্বরে ফোন করা হলে তিনি কল রিসিভ করেননি।

প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের ৯ সদস্য গ্রেফতার : এদিকে গতকাল রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থেকে ভুয়া প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের ৯ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। গ্রেফতার ব্যক্তিরা হলেন সাইফুল ইসলাম ওরফে জুয়েল, রুবেল বেপারী, আবদুস সাত্তার, মেজবাহ আহম্মেদ, কাওছার হোসেন, আল আমীন, ইকরাম হোসাইন, হৃদয় হোসেন ও জাহাঙ্গীর। বুধবারের অভিযানে তাদের কাছ থেকে এইচএসসি ২০১৬ পরীক্ষার রসায়ন (দ্বিতীয় পত্র), হিসাববিজ্ঞান (প্রথম পত্র), পদার্থবিজ্ঞান (সৃজনশীল), জীববিজ্ঞান (দ্বিতীয় পত্র) ইত্যাদি পরীক্ষার ভুয়া প্রশ্নপত্র এবং ১০টি মোবাইল সেট উদ্ধার করা হয়। ডিবির (পশ্চিম) এসি মাহমুদ নাসের জনি বলেন, জুয়েল তাদের সহযোগী পলাতক আসামি আলমগীর হোসেন চক্রের নেতৃত্ব দেন। তারা দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন পরীক্ষার ভুয়া প্রশ্নপত্র অনলাইনে পোস্ট করে এবং এর বিনিময়ে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনসহ রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে আসছেন। তারা মূলত বিভিন্ন নামে ফেসবুক আইডি, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবারের মাধ্যমে স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের প্রতারণার ফাঁদে ফেলে প্রশ্নপত্র দেওয়ার নামে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিত।

সর্বশেষ খবর