শনিবার, ১১ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান চলে ঋণে লোকসানে

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান চলে ঋণে লোকসানে

দেশের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে এর বেশির ভাগই চলছে ঋণ করে আর লোকসান দিয়ে। ফি-বছর বাজেটে ওই সব প্রতিষ্ঠানের জন্য ভর্তুকিও রাখা হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। লাভজনক করতে বিভিন্ন ধরনের সংস্কার কার্যক্রমসহ পারফরমেন্স চুক্তিও করা হচ্ছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো উন্নতি হচ্ছে না। সক্ষমতা না বাড়িয়ে জনগণের করের টাকায় বছর বছর এসব প্রতিষ্ঠানকে ভর্তুকি দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

অর্থ বিভাগের ডিএসএল অধিশাখা গত বছর জুন পর্যন্ত ১১২টি স্বায়ত্তশাসিত/আধা স্বায়ত্তশাসিত ও স্থানীয় সংস্থার বকেয়ার পরিমাণ নির্ধারণ করেছে। অর্থনৈতিক সমীক্ষায় প্রাপ্ত তথ্যমতে, আলোচ্য সময় শেষে এসব অ-আর্থিক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার কাছে মোট বকেয়ার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বিদ্যুৎ বিভাগের নয়টি প্রতিষ্ঠানের বকেয়ার পরিমাণ ১ লাখ ১৬ হাজার ৩২৬ কোটি টাকা, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের ছয়টি প্রতিষ্ঠানের বকেয়া ৩৪ হাজার ৪৬১ কোটি, শিল্প মন্ত্রণালয়ের চার প্রতিষ্ঠানের বকেয়া ৮ হাজার ৮৯২ কোটি টাকা, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের ছয় প্রতিষ্ঠানের বকেয়া ২ হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের পাঁচ প্রতিষ্ঠানের বকেয়া ৪ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের তিন প্রতিষ্ঠানের বকেয়া ৩ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা, অর্থ বিভাগের ১০ প্রতিষ্ঠানের বকেয়া ৫ হাজার ৬১৭ কোটি টাকা, স্থানীয় সরকার বিভাগের ৫২টি প্রতিষ্ঠানের (সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা) বকেয়া ১২ হাজার ১৮০ কোটি টাকা, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের পাঁচ প্রতিষ্ঠানের বকেয়া ১০১ কোটি টাকা, বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তিন প্রতিষ্ঠানের বকেয়া রয়েছে ২৭৪ কোটি টাকা। এ ছাড়া পিকেএসএফের ১ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা, বেপজার ৪৫০ কোটি টাকা, বিডব্লিউডিবির ২৭২ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে।

হাজার কোটি টাকার বেশি বকেয়া : একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সর্বোচ্চ বকেয়া বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি)। বিদ্যুৎ খাতের রাষ্ট্রায়ত্ত এই প্রতিষ্ঠানটির কাছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাওনার পরিমাণ প্রায় ৮০ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা। বিদ্যুৎ খাতের আরেক প্রতিষ্ঠান আরইবির বকেয়া ১৪ হাজার ৬১০ কোটি টাকা এবং ডিপিডিসির ৩ হাজার ৩৬৬ কোটি টাকা। বকেয়ার দিক দিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে জ্বালানি খাতে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। এই প্রতিষ্ঠানটির বকেয়ার পরিমাণ ২২ হাজার ২৮৪ কোটি টাকা। এ ছাড়া পেট্রোবাংলার ৯ হাজার ৮৫৯ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের বিসিআইসির ৯ হাজার ৮৫৯ কোটি টাকা, বিএসইসির ১ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা, বিআইডব্লিউটিএর ১ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা, সেতু কর্তৃপক্ষের ২ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা, ঢাকা ওয়াসার ৪ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা, চট্টগ্রাম ওয়াসার ৫ হাজার ৭০ কোটি টাকা এবং খুলনা ওয়াসার বকেয়া রয়েছে ১ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা।

সরকারের ভর্তুকি : ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১১টি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে ১ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা ভর্তুকি দেয় সরকার। চলতি অর্থবছরের ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত এটি বেড়ে ১ হাজার ৮২৪ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। লোকসানের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় বেড়েছে ভর্তুকিও। পানি উন্নয়ন বোর্ডকে চলতি অর্থবছর ৮৯১ কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয়, যা আগের অর্থবছর ছিল ৭৪৮ কোটি টাকা। এ ছাড়া কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনকে ৩৯৬ কোটি টাকা, বিআইডব্লিউটিএকে ২৭৫ কোটি টাকা, পাটকল করপোরেশনকে ৭১ কোটি টাকা, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশনকে ১২৭ কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বেশির ভাগ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা লোকসান দিচ্ছে। বিগত ৪০ বছরের ঋণ আর লোকসান পুঞ্জীভূত হয়ে এই বিশাল অঙ্কে দাঁড়িয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি লোকসানি প্রতিষ্ঠানগুলোকে লাভজনক হিসেবে গড়ে তুলতে। তবে ব্যবস্থাপনাগত সমস্যা থাকায় এটি খুব কঠিন হয়ে উঠেছে। তবে এগুলো যেহেতু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, সে কারণে ডিভিডেন্ট দিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম চালু রাখতে বাধ্য হচ্ছে সরকার।’

১৯ প্রতিষ্ঠানে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ঋণ : ১৯টি রাষ্ট্রীয় সংস্থার কাছে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের পাওনা দাঁড়িয়েছে ২৭ হাজার ৫১২ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কাছে সর্বোচ্চ ১১ হাজার কোটি টাকা ঋণ রয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি), চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের কাছে ব্যাংকের পাওনা প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা, বিপিসির ঋণের পরিমাণ ৩ হাজার ৭৪৩ কোটি টাকা, বিসিআইসির ৩ হাজার ২৬ কোটি টাকা, তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশনের (বিওজিএমসি ১ হাজার ৪০৪ কোটি টাকা, বিজেএমসির ১ হাজার ২১৭ কোটি টাকা, বিএডিসির ১ হাজার ২৭ কোটি টাকা, বিডব্লিউডিবির ৬২৮ কোটি টাকা, বিবিসির ৩৯৮ কোটি টাকা ও ঢাকা ওয়াসার ৩০১ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে (জুন-এপ্রিল) ১১টি প্রতিষ্ঠান লোকসান করেছে। গত অর্থবছর লোকসানি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল আটটি। চলতি অর্থবছরের ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত বিটিএমসির ৩৭ কোটি টাকা, বিএসএফআইসির ৪৬২ কোটি টাকা, বিসিআইসির ২২ কোটি টাকা, বিজেএমসির ৫৮৮ কোটি টাকা, বিপিডিবির ৬ হাজার ২৩৩ কোটি টাকা, বিএসসির ২ কোটি টাকা, বিআরটিসির ১০ কোটি টাকা, আরডিএর ৭ কোটি টাকা, বিএফএফডব্লিউটির ১১ কোটি টাকা, বিএফডিসির ১১ কোটি টাকা এবং আরইবির প্রায় ৩০০ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে।

আট বছরেও লাভের মুখ দেখেনি যারা : অর্থনৈতিক সমীক্ষায় দেওয়া তথ্য অনুসারে, ২০০৭-০৮ অর্থবছর থেকে ধারাবাহিকভাবে চলতি অর্থবছর পর্যন্ত লোকসান গুনে আসছে এমন প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছ বিটিএমসি, বিএসএফআইসি, বিপিডিবি, বিআরটিসি, বিএফএফডব্লিউটি এবং বিএফডিসি (চলচ্চিত্র)।

মুনাফার পরও ঋণগ্রস্ত বিপিসি : বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের দাম ব্যাপকভাবে হ্রাস পাওয়ায় দুই বছর ধরে লাভের মুখ দেখছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। ২০১৪-১৫ অর্থবছর প্রথমবারের মতো ৪ হাজার ১২৬ কোটি টাকা মুনাফা করে প্রতিষ্ঠানটি। চলতি অর্থবছরের ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত সংস্থাটির মুনাফার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ১৮৬ কোটি টাকা। অর্থ বিভাগ আশা করছে, প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে চলতি অর্থবছর অন্তত ৫ হাজার কোটি টাকার লভ্যাংশ সরকারি কোষাগারে জমা পড়বে। টানা দুই বছর ধরে মুনাফা করার পরও বিপিসি এখনো ঋণগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানটির কাছে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর পাওনার পরিমাণ প্রায় ৩ হাজার ৭৪৩ কোটি টাকা। এ ব্যাপারে অর্থ সচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, ‘বিপিসির ব্যবস্থাপনা ত্রুটি রয়েছে। আমরা পুরো পেট্রোলিয়াম খাতকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিচ্ছি। শিগগিরই বিপিসির সংস্কার কার্যক্রম শুরু হবে।’

সর্বশেষ খবর