সোমবার, ১৩ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

ধান-চাল সংগ্রহে সরকারদলীয় লোকদের ভাগ-বাটোয়ারা

প্রতি টনে নেওয়া হচ্ছে কমিশন

নিজামুল হক বিপুল

চলতি বোরো মৌসুমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ধান-চাল সংগ্রহের দায়িত্ব ভাগ-বাটোয়ারা করে দেওয়া হয়েছে দলীয় নেতা-কর্মীদের। এ জন্য তাদের কাছ থেকে টন প্রতি কমিশনের পরিমাণও বেঁধে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। দলীয় তহবিলের নামে বেঁধে দেওয়া এই কমিশনের হার নির্ধারণ করেছেন মাঠ পর্যায়ে দলীয় সংসদ সদস্যরা। অথচ সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী কার্ডধারী কৃষক ও বৈধ চালকল মালিকদের কাছ থেকে ধান-চাল কেনার কথা খাদ্য বিভাগের। কিন্তু সেই নীতিমালার তোয়াক্কা না করে সরকারি দলের নেতা-কর্মীরা ধান-চাল সরবরাহ করার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন প্রান্তিক কৃষকরা। একই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে ধান-চাল সংগ্রহ নিয়ে সরকারকে প্রশ্নের মুখে পড়তে হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

গত বছর বোরো মৌসুমে একইভাবে দলীয় নেতা-কর্মীদের দিয়ে ধান চাল সংগ্রহ করতে গিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে সরকার। তখন অভিযোগ উঠে, কোনো বিনিয়োগ ছাড়াই গত মৌসুমে সরকারি খাদগুদামে ধান-চাল সরবরাহ করে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন সরকারি দলের নেতা-কর্মীরা। একই কায়দায় এ বছরও সরকারদলীয় এমপিদের টোকেন আর আধা-সরকারি লেটারের মাধ্যমে এমপিরা তাদের কর্মী-সমর্থক ও অনুসারীদের ভাগ-বাটোয়ারা করে দিয়েছেন ধান-চাল সংগ্রহের দায়িত্ব। গত ২৪ এপ্রিল অনুষ্ঠিত খাদ্য পরিধারণ কমিটির সভায় চলতি বোরো মৌসুমে মোট ১৩ লাখ মেট্রিক টন ধান ও চাল সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এর মধ্যে ধান হচ্ছে সাত লাখ মেট্রিক টন ও ছয় লাখ মেট্রিক টন চাল। গত ৫ মে থেকে ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়েছে। চলবে আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত।  অনুসন্ধানে জানা গেছে, ধান ও চাল সংগ্রহে সরকারি সিদ্ধান্তের পর পরই তত্পর হয়ে ওঠেন মাঠ পর্যায়ে দলীয় সংসদ সদস্যরা। দেশের বিভিন্ন এলাকায় দলীয় এমপিরা তাদের অনুসারীদের ভাগ করে দিয়েছেন কে কত মেট্রিক টন ধান ও চাল সরবরাহ করবেন। এর বিনিময়ে সরবরাহকারী দলীয় নেতা-কর্মীদের টন প্রতি ৫০০ টাকা করে দিতে হবে এমপিদের। এর ফলে মাঠ পর্যায়ে কৃষকরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, যশোরের কেশবপুর উপজেলা থেকে চলতি বোরো মৌসুমে দুই হাজার ২০০ মেট্রিক টন ধান-চাল সংগ্রহ করা হবে। এই ধান-চাল সংগ্রহের জন্য স্থানীয় এমপি উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার চেয়ারম্যান, মেম্বার ও কাউন্সিলরদের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছেন কে কত পরিমাণ ধান চাল সংগ্রহ করবেন। স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, এই ভাগ-বাটোয়ারার ক্ষেত্রে স্থানীয় এমপি বেশ কৌশল অবলম্বন করেছেন। ১১টি ইউনিয়নে যারা দলীয় প্রতীকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন এবং যারা স্থানীয় এমপির অনুসারী অথচ স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন তাদেরও প্রায় সমানভাবে ধান ও চাল সংগ্রহের দায়িত্ব দিয়েছেন। কেশবপুরের সাগরধারী ইউনিয়নে নির্বাচিত ইউনিয়ন চেয়ারম্যানকে যেমন ৭৫ মেট্রিক টন ধান ও চাল সংগ্রহের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, একইভাবে স্বতন্ত্র প্রার্থী যিনি ছিলেন তাকেও ৭৫ মেট্রিক টন ধান-চাল সরবরাহের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই ভাবে উপজেলার অন্য ইউনিয়নগুলোতে চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে দেওয়া হয়েছে। কেশবপুর পৌরসভার সরকার সমর্থক আটজন কাউন্সিলরকে জনপ্রতি ১০ মেট্রিক টন করে সরবরাহের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ জন্য সরবরাহকারী প্রত্যেককে টন প্রতি ৫০০ টাকা করে জমা দিতে হয়েছে এমপির লোকজনের কাছে। দলীয় তহবিলের নামে এই টাকা জমা দেওয়ার জন্য এমপির পক্ষ থেকে তার সহকারী একান্ত সচিব সবাইকে বলে দিয়েছেন। আর টাকা জমা নেওয়া হচ্ছে কেশবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি তপন কুমার মন্টুর কাছে। যিনি স্থানীয় এমপির ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত। কেশবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ওই টাকা নেওয়া হচ্ছে দলীয় তহবিলের নামে। কিন্তু দলীয় তহবিলের নামে নেওয়া হলেও দলের উপজেলা কোষাধ্যক্ষ এ বিষয়ে জানেন না। তাই এই টাকা যে দলের তহবিল যাচ্ছে না তা প্রায় পরিষ্কার। শুধু কেশবপুর নয়, দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও একইভাবে দলীয় এমপিরা ধান-চাল সংগ্রহের জন্য স্থানীয় নেতা-কর্মী ও নিজের অনুসারীদের দায়িত্ব দিয়েছেন। বিনিময়ে নিচ্ছেন টন প্রতি কমিশন। রাজশাহীর দুর্গাপুর, তানোর, মোহনপুর উপজেলায় ধান-চাল সংগ্রহের জন্য স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ফলে মাঠ পর্যায়ের কৃষকরা ধান-চাল সরবরাহের জন্য সরকার দলীয় নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে টোকেন সংগ্রহ করতে হচ্ছে। আর এই টোকেনের জন্য কৃষককে গুনতে হচ্ছে নগদ টাকা। স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, মোহনপুরে স্থানীয় উপজেলা যুবলীগ সভাপতি ইকবাল হোসেনের কাছ থেকে টোকেন নিতে হচ্ছে কৃষককে। দলের সমর্থক কৃষকরা টোকেন নিতে গেলে টাকা না লাগলে সাধারণ ও প্রকৃত কৃষকরা টাকা ছাড়া ধান-চাল সরবরাহের টোকেন পাচ্ছেন না। টন প্রতি দুই থেকে তিন হাজার টাকা ধরিয়ে দিলেই সাধারণ কৃষকরা টোকেন পাচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। একইভাবে তানোরে ধান-চাল সংগ্রহের পুরো কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করছেন স্থানীয় যুবলীগের সভাপতি আলফাজ আলী। স্থানীয় এমপিরা তাদের নিয়োগ করেছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।  রাজশাহী জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি বোরো মৌসুমে রাজশাহী থেকে মোট ৯ হাজার ১৯১ মেট্রিক ধান-চাল সংগ্রহ করা হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছর একই কায়দায় দলীয় কর্মীদের দিয়ে ধান-চাল সংগ্রহ করতে গিয়ে সরকারকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। সংগৃহীত ধান-চালের গুণগত মান নিয়েও ওই সময় প্রশ্ন ওঠে। কারণ সরকারদলীয় এমপিদের টোকেন আর আধা-সরকারি (ডিও) লেটারের মাধ্যমে এমপিদের কর্মী-সমর্থক ও অনুসারীরা ধান-চাল সরবরাহের ব্যবসা করেছেন। তারা নিজেদের ইচ্ছামতো মাঠপর্যায়ে খাদ্য গুদামের কর্মকর্তাদের চাপ প্রয়োগ করে দেশের অনেক এলাকায় নিম্নমানের ধান-চাল গুদামে ঢুকাতে বাধ্য করেছেন বলেও ওই সময় অভিযোগ ওঠে। এমনকি খাদ্য গুদামের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা ঢাকায় এসে এ নিয়ে মিছিল-মিটিং ও সমাবেশ করেন। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও সচিবকে স্মারকলিপিও দেন।

ধান-চাল কেনার বিষয়ে বিদ্যমান অভ্যন্তরীণ খাদ্যশস্য সংগ্রহ নীতিমালায় বলা হয়েছে, উৎপাদক কৃষকদের মূল্য সহায়তা প্রদান ও খাদ্যশস্যের বাজার দর স্থিতিশীল রাখা। ‘আগে এলে আগে ক্রয় করা হবে’ ভিত্তিতে কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয় করতে হবে। কোনো ব্যবসায়ী বা ফড়িয়ার কাছ থেকে ধান ক্রয় করা যাবে না। চালের ক্ষেত্রে বৈধ চালকল লাইসেন্সধারী আগ্রহী মিলারদের কাছ থেকে চাল কিনতে হবে। গত বছর থেকে এই নীতিমালা উল্টে গেছে। কৃষকের সহায়তার বিষয়টি মাথায় রেখে সরকার ধান ও চালের মূল্য নির্ধারণ করলেও সরকারি খাদ্য গুদামে ধানও চাল সরবরাহ করেছেন মূলত সরকারি দলের মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা। বেশির ভাগ জেলাতেই চাল কল মালিকদের কাছ থেকে ধান-চাল সংগ্রহ না করে দলীয় নেতা-কর্মীদের দেওয়া ধান-চালই গুদামে নিতে হচ্ছে খাদ্য বিভাগকে। গত ৫ মে থেকে শুরু হওয়া ধান-চাল সংগ্রহ অভিযানে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী গত ৮ জুন পর্যন্ত মোট ৬০ হাজার ৫০৩ মেট্রিক টন বোরো ধান সংগ্রহ হয়েছে।

সর্বশেষ খবর