রবিবার, ১৯ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

কাজে আসছে না সিসিটিভি

নিম্নমানের ক্যামেরায় বাজার সয়লাব

সাখাওয়াত কাওসার

কাজে আসছে না সিসিটিভি

গত ১০ তারিখ বনানী ১০ নম্বর সড়কে ব্যক্তিগত কাজে গিয়েছিলেন তানজিনা আনিস প্রেমা। গাড়িচালকসহ ওই মহিলা পার্শ্ববর্তী ভবনে গিয়ে ১৫ মিনিটের ব্যবধানেই নেমে আসেন। তবে ওই সময়ের মধ্যেই উধাও তার টয়োটা ১১০ মডেলের প্রাইভেট কারটি। কোনো উপায় না পেয়ে সোজা বনানী থানায়। সাধারণ ডায়েরি। অতঃপর গাড়ি উদ্ধারের সহায়তা চেয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ, এলিট ফোর্স র‌্যাব-১। তবে গতকাল পর্যন্ত প্রেমার গাড়িটি উদ্ধার হয়নি। একই দিন তারাবির নামাজের সময় বনানী মসজিদের সামনে থেকে আরও একটি প্রাইভেট কার চুরির ঘটনা ঘটে। গতকাল পর্যন্ত একটি গাড়িও উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। এ তো গেল মাত্র দুটি ঘটনা। অন্যান্য এলাকার মতো রাজধানীর অভিজাত এলাকাগুলোতেও প্রায়ই গাড়ি চুরি, ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধের ঘটনা ঘটে। তবে এ ক্ষেত্রে পুলিশের দাবি, ফুটেজ স্পষ্ট না হওয়ার কারণে অনেক অপরাধ উদ্ঘাটিত হয় না। ভুক্তভোগীরা বলছেন, পুলিশের দাবি অনুযায়ী রাজধানীর গুলশান-বনানী ও বারিধারা সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় এসেছে। অথচ এভাবে এসব গুরুত্বপূর্ণ এলাকা থেকে গাড়ি চুরির বিষয়টি খুবই হতাশাজনক। অনেকে বলছেন, নিজ উদ্যোগে সিসিটিভি স্থাপনের পরও তারা খুব একটা উপকার পাচ্ছেন না। এজন্য নিম্নমানের সিসিটিভি বিক্রেতাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার দাবি তাদের।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সারা বিশ্ব যেখানে প্রযুক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশের রাজধানীতে গত ১৫ বছরেও সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। এটা সত্যি অনেক বড় ব্যর্থতা। এটা লজ্জারও বটে। কর্তৃপক্ষের উচিত অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য পুরো রাজধানীকে অতি দ্রুততর  সময়ের মধ্যে সিসিটিভির আওতায় নিয়ে আসা। এদিকে বনানীতে চুরি যাওয়া গাড়ির বিষয়ে জানতে চাইলে গুলশান বিভাগের উপকমিশনার মোশতাক আহমেদ বলেন, বনানী ১০ নম্বর সড়ক সিসিটিভির আওতায় আনা হয়নি। তবে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। বনানী মসজিদের সামনে থেকে চুরি যাওয়া গাড়ির বিষয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়ে খোঁজ না নিয়ে কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না। অন্যদিকে রাজধানীসহ সারা দেশে একের পর এক নৃশংস খুনের ঘটনায় সচেতনতার অংশ হিসেবে নগরজুড়ে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা বসানোর হিড়িক পড়েছে। বিভিন্ন স্তরের ক্রেতা নিজেদের নিরাপত্তার জন্য সিসিটিভি কিনছেন। যদিও বিভিন্ন আলামতের পাশাপাশি অপরাধীদের শনাক্তে ঘটনাস্থল বা আশপাশের ক্লোজ সার্কিট ফুটেজই যেন এখন পুলিশের বড় ভরসার জায়গা। কিছু হলেই তারা সিসিটিভি ফুটেজ খুঁজছেন। যদিও ২০১৫ সালের পয়লা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নারী নির্যাতনের ফুটেজ থাকার পরও তা অপরাধী শনাক্তে কাজে আসেনি। গত বছর আজিজ সুপার মার্কেটে নিজ অফিসের ভিতর শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর কর্ণধার দীপনের হত্যাকারীদেরও সিসিটিভি ফুটেজ থেকে শনাক্ত করতে পারেননি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। সর্বশেষ চট্টগ্রামে পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যার ঘটনায় সংগৃহীত সিসিটিভি ফুটেজও স্পষ্ট নয়। উদ্ঘাটন হয়নি এসব হত্যারহস্য। বিভিন্ন সূত্র জানায়, মানভেদে এসব ক্যামেরার দাম ১৫০০ থেকে আড়াই লাখ টাকা। মূলত নাইট ভিশন ক্যামেরাগুলো দেড় হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আগে এগুলো পাওয়া যেত ১-২ হাজার টাকায়। তবে প্যানেল ক্যামেরার দাম বেশি। এগুলোতে রেকর্ডসহ একাধিক প্যানেল রয়েছে। এসব ক্যামেরা তিন থেকে চার লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আগে এগুলোর দাম ছিল দেড় থেকে দুই লাখ টাকা। বেশির ভাগ সিসি ক্যামেরাই চীন থেকে আমদানি করা, যে কারণে দামও কম। তবে তাইওয়ান, কোরিয়া, জাপান থেকেও কিছু নিরাপত্তাসামগ্রী আসছে। সাধারণ মানের ক্যামেরা দিয়ে মাত্র ১০ থেকে ২০ মিটার দূরত্বের চিত্র ধারণ সম্ভব। তবে এইচডি মানের ক্যামেরা দিয়ে ৩০ থেকে ৭০ মিটার দূরত্বের চিত্র ধারণ করা যায়। কিন্তু মানুষের মধ্যে ধারণা না থাকায় নিম্নমানের ক্যামেরা তুলনামূলক বেশি বিক্রি হচ্ছে বলে জানান এক সিসি ক্যামেরা ব্যবসায়ী। রাজধানীর বায়তুল মোকাররমের সিসিটিভি বিক্রেতা মনির বলেন, বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি হলেও চীনের তৈরি সিসি ক্যামেরার দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় বিক্রি হচ্ছে বেশি। এলিফ্যান্ট রোডের মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের সিসি ক্যামেরা বিক্রেতা ডিউক বলেন, নিরাপত্তাসামগ্রী বিক্রি দুই থেকে তিন গুণ বেড়েছে। আগে বড় কোম্পানি ও শপিং মলে সিসি ক্যামেরা বসানো হতো। এখন ছোটখাটো দোকান থেকে শুরু করে বাসাবাড়িতেও বসানো হচ্ছে। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলেন, সুনির্দিষ্ট কোনো নিয়ম-নীতি ও মনিটরিং না থাকায় চীন থেকে গণহারে আনা হচ্ছে নিম্নমানের সিসি ক্যামেরা। এসব ক্যামেরার চিত্র ধারণক্ষমতা একেবারেই সীমিত। নিম্নমানের ক্যামেরায় নাইটভিশন সিস্টেম দুর্বল হওয়ায় রাতের চিত্র দেখে অপরাধীকে শনাক্ত করা কঠিন। সাধারণ মানের ক্যামেরা দিয়ে মাত্র ১০ থেকে ২০ মিটার দূরত্বের চিত্র ধারণ সম্ভব। তবে এইচডি (হাই ডেফিনেশন) মানের ক্যামেরা দিয়ে ৩০ থেকে ৭০ মিটার দূরত্বের চিত্র ধারণ করা যায়। কিন্তু মানুষের মধ্যে ধারণা না থাকায় নিম্নমানের ক্যামেরা তুলনামূলক বেশি বিক্রি হচ্ছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমামুল হাসান বলেন, সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের আগে মানুষের উচিত এ ক্ষেত্রে ভালো জ্ঞান রয়েছে এমন কারও সঙ্গে পরামর্শ করা। কারণ ইউএস এবং সিই অনুমোদিত হলে এসব পণ্যের মান ভালো হওয়ার কথা। দাম একটু বেশি হলেও যাচাই করে সিসিটিভি ক্যামেরা কেনা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রায় ৬৫ কোটি টাকা খরচ করেও গত ১৫ বছরে পুলিশ রাজধানীতে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করতে পারেনি। অনেকটা জলে গেছে বিপুল পরিমাণ টাকা। সর্বশেষ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করতে রাজধানীবাসীকে উৎসাহ জোগাচ্ছেন। এরই অংশ হিসেবে ২০১৪ সালে রাজধানীর অভিজাত গুলশান, নিকেতন, বারিধারা এলাকার বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে ৬৪২টি সিসিটিভি স্থাপন করা হয়। এর নিয়ন্ত্রণ দেওয়া হয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের গুলশান বিভাগকে। তবে সিসিটিভি স্থাপনের পরও অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারাকে পুলিশের ব্যর্থতা হিসেবে দেখছেন অনেকেই।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর