শুক্রবার, ২৪ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

বখরা আদায়ের মহড়া

মহাসড়কে পুলিশি দৌরাত্ম্য

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানীর বাইরে মহাসড়কগুলোতে ট্রাফিক সার্জেন্টরা তাদের সহযোগীদের নিয়ে সড়কের অপেক্ষাকৃত ফাঁকা স্থানে ওতপেতে থাকেন। উভয় পাশে চলাচলরত ট্রাকগুলোকে সারিবদ্ধভাবে তারা দাঁড় করান। এসব কাগজপত্র চেকিংয়ের নামে চলতে থাকে বখড়া আদায়ের মহড়া। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের বিপিএটিসি ফাঁড়ি, গাজীপুর রোডের টঙ্গীতে, জয়দেবপুর চৌরাস্তায়, বাইপাস মোড়ে, চট্টগ্রাম রোডের কাঁচপুর ব্রিজের অদূরে, সিলেট রোডের ভৈরব ঘাটে, উত্তরবঙ্গের গন্তব্যে উত্তরার ধউর মোড়ে, সাভারের বাইপাইল ও কালিয়াকৈরের চন্দ্রা মোড়ে পুলিশের চাঁদাবাজি সব মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। এসব স্থানে যানবাহন চালকরা চাঁদার বিরুদ্ধে টুঁশব্দটি করা দূরের কথা, চাঁদা প্রদানে একটু দেরি হলে সার্জেন্ট-ট্রাফিক ও তাদের সহযোগীদের হাতে চড়-থাপ্পড় পর্যন্ত খান। ঢাকা-গাজীপুর রুটে চলাচলকারী বলাকা পরিবহনের ড্রাইভার আবদুল আজিজ জানান, পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজির ঘটনা অনেক পুরনো। তবে এখনকার মতো এত খারাপ অবস্থা আগে কখনো দেখা যায়নি। আগে মালিক সমিতি আর শ্রমিক ইউনিয়নের নামে চাঁদা তোলা হতো। এখন ওই দুই সংগঠনের নামেই ২০-২৫টি সংগঠন চাঁদা আদায় করছে। আবার অনেকে কোনো রেজিস্ট্রেশন নম্বর ছাড়াই একটি মনগড়া নাম লিখে চাঁদা আদায় করে। আবার বিভিন্ন এলাকায় পেশাদার সন্ত্রাসী ও সরকারি দলের নেতাদেরও চাঁদা দিতে হয়। এসব চাঁদা না দিয়ে রাস্তায় গাড়ি চালানো যায় না। এসব চাঁদাবাজির কারণেই পরিবহন খরচ বাড়ে, যাত্রীদের কাঁধে চাপে বাড়তি ভাড়ার চাপ। গুলিস্তান স্ট্যান্ড ঘিরেও চাঁদাবাজির উৎপাত আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। পরিবহন সেক্টর ও ফুটপাথ বাজারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা চাঁদাবাজ চক্রটি রীতিমতো স্থায়িত্ব লাভ করেছে। প্রতিটি সরকারের আমলেই তারা নানা কায়দা-কৌশলে ক্ষমতাসীন দলের ব্যানারে বাধাহীন চাঁদাবাজিতে মেতে ওঠে। নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, মাওয়াঘাট, দাউদকান্দি, গাজীপুর ও মুন্সীগঞ্জগামী বিভিন্ন পরিবহন থেকে দিনে ৮০০ থেকে ১১০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা ওঠানো হচ্ছে। ফ্লাইওভারের ঠিক মাথায় গাড়ি থামিয়ে যাত্রী ওঠানো-নামানোর সুযোগ দেওয়ার নামেও চলছে চাঁদাবাজি। নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, আদমজী, দাউদকান্দিসহ কয়েকটি রুটের বাস-মিনিবাসগুলো মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের গুলিস্তান লুপের ঠিক মুখেই অঘোষিত টার্মিনাল গড়ে তুলেছে। সেখানেই যাত্রী ওঠা-নামা করাতে একটি চক্র গাড়িপ্রতি ৩০০ টাকা করে চাঁদা হাতিয়ে নিচ্ছে। এদিকে গুলিস্তান বাসস্ট্যান্ডকেন্দ্রিক ফুটপাথ বাজার জুড়েও তিনটি চক্রের অব্যাহত চাঁদাবাজি চলছে। প্রতিদিন ফুটপাথের দোকানভেদে আদায় হচ্ছে ৩০০ থেকে হাজার টাকার চাঁদা। প্রকাশ্যেই লাইনম্যানরা এ টাকা উত্তোলন করছেন।

আতঙ্ক হাইওয়ে পুলিশ : কাঁচপুর, গাজীপুর, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন পয়েন্টে হাইওয়ে পুলিশের ভয়ঙ্কর চাঁদাবাজির অসংখ্য অভিযোগ উঠেছে। সড়কপথের পয়েন্টে পয়েন্টে নিরীহ মানুষজনকে হয়রানি, গাড়ির চালক ও মালিকদের কাছ থেকে বেপরোয়া চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন খাতের মাসোহারা আদায়ের আলাদা সাম্রাজ্য গড়ে তোলা হয়েছে। হাইওয়ে পুলিশের চিহ্নিত ইন্সপেক্টররা রীতিমতো টোকেন প্রথা চালু করেছেন। প্রতি মাসেই হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির সীমানায় চলাচলকারী গাড়িপিছু ধার্যকৃত চাঁদা দিয়ে টোকেন সংগ্রহ করতে হয়। মাটি বহনকারী ট্রাক, হাইওয়ে রোডে চলা সিএনজি, ব্যাটারিচালিত অটো, টু স্ট্রোক বেবিট্যাক্সি, ট্রাকস্ট্যান্ড, বাসস্ট্যান্ড, কোচ কাউন্টার, পেট্রলপাম্প, রাস্তাঘেঁষা দোকান, মিল-কারখানার মালামাল বহনকারী কাভার্ড ভ্যান, রপ্তানি পণ্যবাহী লং ভেহিকেলস থেকে শ্রেণিভেদে মাসোহারা নির্ধারণ করে টোকেন দেওয়া আছে। ঢাকায় নিয়ে আসা মাদক পাচারকারী চক্রগুলো থেকেও প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের চাঁদাবাজি চালায় কাঁচপুরের হাইওয়ে পুলিশ। তাদের চাঁদাবাজির খাত আর ধরন দেখে খোদ পুলিশের সদস্যরাও অবাক বনে যান। হাইওয়ে পুলিশের কর্মকর্তা হয়েও তাদের কেউ কেউ নৌপথে আসা পাথর, বালু, সিমেন্টবোঝাই বার্জ কার্গো থেকেও চাঁদা নিতে বিন্দুমাত্র ভুল করেন না। সড়কের গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে মোড়ে স্কুটার, লেগুনা, হিউম্যান হলার, ইজিবাইক স্ট্যান্ড বানিয়ে, সড়কে হকার বসিয়ে প্রতি মাসে বাণিজ্য করে ২০ লাখ টাকা।

গাজীপুর টাউন ফাঁড়ির ইনচার্জ অবৈধ উপায়ে এ বাণিজ্য করছেন এমন অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জয়দেবপুর শহরের আবাসিক এলাকা ও বাণিজ্যিক এলাকায় যাতায়াতের জন্য মাত্র একটি সড়ক রয়েছে। আর শহরে আসা-যাওয়ার একটি মাত্র প্রধান সড়ক হলেও এর দুই পাশের ফুটপাথ দখল করে হকার বসিয়ে নিয়মিত ভাড়া আদায় ও সড়কের বিভিন্ন স্থানে স্কুটার, লেগুনা, হিউম্যান হলার, ইজিবাইক স্ট্যান্ড থেকেও বিপুল পরিমাণ মাসোহারা আদায় করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

সর্বশেষ খবর