মঙ্গলবার, ২৮ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

প্রশিক্ষণের নামে লুটপাট

নির্বাচন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট

গোলাম রাব্বানী

প্রশিক্ষণের নামে লুটপাট

নির্বাচন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে (ইটিআই) বিভিন্ন ট্রেনিংয়ের নামে অর্থ লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। সদ্য সমাপ্ত ইউপি নির্বাচনে প্রশিক্ষণ খাতের ৪৫ কোটি টাকা ব্যয় নিয়েও নানা প্রশ্ন তুলেছেন ইসির কর্মকর্তারা। কর্মকর্তাদের অভিযোগ— ইসি সচিবালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তাদের যোগসাজশেই ইটিআইয়ের টাকা ভাগ-বাটোয়ারা হয়। কর্মকর্তারা এসব টাকা নামে-বেনামে ব্যয় দেখিয়ে বিল-ভাউচার প্রদান করেন। এদিকে প্রশিক্ষণের নামে অর্থ লোপাটের অভিযোগ ছাড়াও প্রশিক্ষণের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন খোদ প্রধান নির্বাচন কমিশনার। তিনি এক নোটে লিখেছেন— ইটিআই প্রশিক্ষণের বর্তমান মান সন্তোষজনক নয়। পরিমাণগত ও গুণগত উভয় ক্ষেত্রেই ঘাটতি রয়েছে। প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়া একাধিক কর্মকর্তা অভিযোগ করেছেন— একই সময় ইসির একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিভিন্ন প্রশিক্ষণ সেশনে প্রশিক্ষক হিসেবে অংশ নেন। অনেকে অংশ না নিয়ে স্বাক্ষর করেই টাকা তুলে নেন। কিন্তু যারা প্রশিক্ষণ নিতে আসেন তাদের ভাগ্যে এসব প্রশিক্ষকের ক্লাস পড়ে না। ইসি ও ইটিআই বড় কর্মকর্তাদের এক দিনে তিন-চারটি প্রশিক্ষণ সেশনে অংশ নেওয়ার নজির রয়েছে। অভিযোগকারীরা বলেন, সদ্য সমাপ্ত ১০ পৌরসভা নির্বাচনে একজন প্রশিক্ষককে এক ক্লাসের জন্য দেওয়া হয় ৪০০০ হাজার টাকা। এ হিসেবে তিনটি ক্লাস নিলে দিনে ১২ হাজার টাকা তাদের আয় হয়। এক্ষেত্রে বড় বড় কর্মকর্তার নামে নামে মাত্র ক্লাস বরাদ্দ রাখা হয়। কিন্তু তারা অনেক সময় ক্লাস না নিয়ে ভাতা গ্রহণ করেন। এতে ইসির সচিবালয়ের অন্য দক্ষ কর্মকর্তা ক্লাস নেওয়ার সুযোগ বঞ্চিত হন। একইভাবে সারা দেশের সাড়ে ৪ হাজারের বেশি ইউপি নির্বাচনের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলেছে নয়-ছয় করেই। এই প্রশিক্ষণের টাকা লুটপাট করছেন ইটিআই কর্মকর্তারা। ইসি সূত্র জানিয়েছে, সদ্য সমাপ্ত ১০ পৌরসভার নির্বাচনের প্রশিক্ষণে যাতায়াত বাবদ প্রিসাইডিং ও সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারদের জনপ্রতি বরাদ্দ ছিল ৫০০ টাকা। পোলিং অফিসারদের ৪০০ টাকা। এ ছাড়া প্রশিক্ষণ সম্মানী বাবদ প্রত্যেক সেশনের জন্য প্রিসাইডিং ও সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারদের বরাদ্দ ছিল ৮০০ টাকা। পোলিং অফিসারদের ৪০০ টাকা। যদিও নামমাত্র তালিকা করে এসব প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। অনেকেই উপস্থিত থাকেন না। কিন্তু তাদের নামে টাকা কর্মকর্তা তুলে নেন। এ ছাড়া অনেক সময় পোলিং অফিসারসহ অন্যদের শুধুমাত্র যাতায়াত খরচ দেওয়া হয়। তাদের সম্মানী কর্মকর্তাদের পকেটে চলে যায়। অন্যদিকে প্রশিক্ষণের প্রত্যেক ব্যাচের জন্য আলাদা বিবিধ খরচও বরাদ্দ রাখা হয়। তবে এসব খরচ আদৌ হয় কিনা তা নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। জানা গেছে, নির্বাচনী প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে প্রশিক্ষণের জন্য এই অর্থবছরে এক কোটি টাকা এবং সর্বশেষ ইউপি ভোটে মাঠ পর্যায়ে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ বাবদ ৪৫ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। সাত লাখের বেশি মাঠ কর্মকর্তা ওই প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবার। এই বিপুল অর্থ ব্যয়ে ‘নয়-ছয়ের’ অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া সদ্য সমাপ্ত ১০ পৌরসভা ভোটে ১৯ লাখ ২৩ হাজার ১০০ টাকা ব্যয় হয়েছে।

প্রশিক্ষণ মান নিয়ে সিইসির প্রশ্ন : নির্বাচনী প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের প্রশিক্ষণ মান নিয়ে সন্তুষ্ট নন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ। গুণগত মানের ঘাটতির কথা তুলে ধরে সিইসি আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ সূচি করতে কার্যপত্র তৈরির তাগিদ দিয়েছেন ইসি সচিবালয়কে। এ বিষয়ে একটি নোট তিনি ইসি সচিবকে দিয়েছেন। জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের ভোট সামনে রেখে ‘প্রথাগত’ প্রশিক্ষণে কোটি টাকা ব্যয় এবং ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নির্বাচনী অনিয়মে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগের মধ্যেই সিইসির এ নির্দেশনা এলো। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ওই নোটে কমিশন সচিবকে লিখেছেন, ইটিআই প্রশিক্ষণের বর্তমান মান সন্তোষজনক নয়। পরিমাণগত ও গুণগত উভয় ক্ষেত্রেই ঘাটতি রয়েছে, যা দ্রুততম সময়ের মধ্যে উন্নত করে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের মানে উন্নয়ন করা প্রয়োজন। প্রশিক্ষণের মানোন্নয়নে কার্যপত্র তৈরি করে দেশের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান প্রধানদের কাছে পাঠিয়ে তাদের সুপারিশ নেওয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন সিইসি। তিনি ঈদের পর এ বিষয়ে সভা করার তাগিদ দিয়েছেন। কাজী রকিব নোটে বলেন, একটি ব্রেইন স্টর্মিং সভার আয়োজন করা যায়, যেখানে পিএটিসি, বিয়াম, ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট-এনএপিডি, ট্রেইনিং ইনস্টিটিউট ফর হেলথ কেয়ার, নিয়াম, ট্রেইনিং অ্যাকাডেমি ফর ফরেন সার্ভিস অফিসার্স ও ট্রেইনিং ইনস্টিটিউট অব জুডিশিয়াল সার্ভিসেস অফিসিয়াল-এর প্রধান এবং দুটি প্রাইভেট ট্রেইনিং ইনস্টিটিউটের প্রধানকেও অংশ নেওয়ার আমন্ত্রণ জানানো যেতে পারে। ঈদের পর এ সভায় চার নির্বাচন কমিশনারেরও থাকার কথা বলা হয়েছে সিইসির নোটে।

ইটিআই ও প্রশিক্ষণ : নির্বাচন কমিশনের সব পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীর দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য নির্বাচনী প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। এ ছাড়াও সাধারণ ভোটার, রাজনৈতিক কর্মী, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী, নির্বাচনী এজেন্ট এবং নির্বাচন সংশ্লিষ্ট অন্যদের সচেতনতা বৃদ্ধি ও নির্বাচনী কার্যক্রমের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার আয়োজন করে। নির্বাচন কমিশনের সবপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী এই প্রশিক্ষণ নেন। বিভিন্ন নির্বাচনে দায়িত্বপ্রাপ্ত রিটার্নিং অফিসার, সহকারী রিটার্নিং অফিসারসহ নির্বাচন সংশ্লিষ্ট এবং ভোটার তালিকা প্রণয়ন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও এর মধ্যে রয়েছেন। প্রশিক্ষক ও অতিথি বক্তা হিসেবে ইসি ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দফতরের পেশাদার ও দক্ষ প্রশিক্ষকরা উপস্থিত থাকেন। এ বিষয়ে নির্বাচন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক খোন্দকার মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, নির্বাচনী প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে প্রশিক্ষণের জন্য এই অর্থবছরে এক কোটি টাকা এবং সর্বশেষ ইউপি ভোটে মাঠ পর্যায়ে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ বাবদ ৪৫ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। সাত লাখের বেশি মাঠ কর্মকর্তা ওই প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবার। এই অর্থ ব্যয়ে ‘নয়-ছয়ের’ অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, বাস্তবে এর কোনো সত্যতা নেই। ইটিআইতে প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ চলে এবং মাঠে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে কারও কাছ থেকে নির্ধারিত বরাদ্দের কম অর্থ দেওয়ার অভিযোগ কখনো ওঠেনি। তবে নির্বাচন ও ভোটার তালিকা হালনাগাদকে কেন্দ্র করে একই ব্যক্তিকে অনেকবার প্রশিক্ষণ দিতে হয় এবং নিতেও হয়। মান নিয়ে সিইসির অসন্তোষের বিষয়ে মিজানুর রহমান বলেন, প্রশিক্ষণের মানোন্নয়নে তাগিদ দিয়েছেন সিইসি। সে লক্ষ্যে দিকনির্দেশনাও দিয়েছেন। বর্তমানে আবাসন সমস্যা থাকায় প্রশিক্ষণে কিছুটা সমস্যা হয়। মাঠ পর্যায়েও খুবই স্বল্প মেয়াদি (আধাবেলা থেকে এক দিন) প্রশিক্ষণ চলে। তাছাড়া ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের সুষ্ঠু ভোট নিয়ে শঙ্কার মধ্যে থাকতে হয়। সঠিকভাবে প্রশিক্ষণ পেলেও তাদের মধ্যে উদ্বেগ কাজ করে।

সর্বশেষ খবর