আকাশপথে পণ্য পরিবহনে ঝুঁকি বাড়ছেই। এ ঝুঁকির কারণ দেখিয়ে পণ্য পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে রপ্তানিতে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজার জার্মানি। তবে ইউরোপের প্রধানতম অর্থনীতির দেশ জার্মানি ঝুঁকিপূর্ণ বলে কেন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, তা জানে না বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। অভিযোগ রয়েছে, শাহজালাল বিমানবন্দরে সাধারণ যাত্রী থেকে শুরু করে ব্যবসায়ীদের আমদানি-রপ্তানির পণ্য চুরির মহোৎসব চলছে। কোনোভাবেই এই পণ্য চুরি থামছে না। একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের আগ্রাসী সিন্ডিকেটে অসহায় হয়ে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। জানা গেছে, ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় বাংলাদেশ থেকে সরাসরি আকাশপথে পণ্য পরিবহনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে জার্মানির বেসামরিক বিমান সংস্থা লুফথানসা এয়ারলাইনস। শাহজালাল বিমানবন্দরের পণ্য পরিবহন (কার্গো) ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসকে রবিবার এ সিদ্ধান্তের কথা ই-মেইল করে জানিয়েছে লুফথানসা এয়ারলাইনস। সংস্থাটি ই-মেইল বার্তায় বলেছে, লুফথানসা এয়ারলাইনস আকাশপথে সরাসরি বাংলাদেশ থেকে পণ্য পরিবহন করবে না। বাংলাদেশ থেকে পণ্য পরিবহনকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছে লুফথানসা এয়ারলাইনস। তবে এ নিয়ে মৌখিক বা লিখিতভাবে কিছু জার্মান সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়নি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং বেবিচককে।
তবে শাহজালাল বিমানবন্দরে পণ্য চুরি ও নিরাপত্তা সম্পর্কে ব্যবসায়ী এবং সাধারণ যাত্রীদের অভিযোগ হলো, কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে কোনো নিয়মের তোয়াক্কা করা হয় না। অনেক বেশি অর্থ ব্যয় করে বিমানে পণ্য পরিবহন করা হলেও সেবার বদলে পাওয়া যায় হয়রানি। মালপত্র ছাড়ে ৩০ ঘাট ঘুষ গুনতে হয়। এর পরও কার্গো কমপ্লেক্স ও কার্গো ভিলেজ যেন চুরি আর লুটপাটের মহারাজ্য। বন্দর, বাংলাদেশ বিমান, কুরিয়ার সার্ভিস, কাস্টমস আর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের আগ্রাসী সিন্ডিকেট এই পণ্য চুরির সঙ্গে জড়িত বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা। এপ্রিলে সিঙ্গাপুর থেকে বোতামের একটি চালান শাহজালাল বিমানবন্দরে আসে দেশের শীর্ষ পোশাক পণ্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান সিনহা গ্রুপের। এর পর থেকে ওই বোতামের চালানটি আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আর সিনহা গ্রুপ ওই চালনটি না পেলে তাদের রপ্তানির শিপমেন্ট বাতিল হয়ে যেতে পারে বলে জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে বেবিচকের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এহসানুল গনি চৌধুরী গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আকাশপথে সরাসরি পণ্য পরিবহনে জার্মানি ঝুঁকিপূর্ণ কেন বলেছে তা আমরা জানি না। এটা সরকার খতিয়ে দেখছে। আমাদের এ বিষয়ে আরও জানতে হবে। কারণ জার্মানি আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি। তবে আমাদের শাহজালাল বিমানবন্দরের পণ্য পরিবহন (কার্গো) ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসকে একটি ই-মেইল পাঠিয়েছে জার্মানির লুফথানসা এয়ারলাইনস। কিন্তু আমাদের সরকারি পর্যায়ে জার্মানি রাষ্ট্রীয়ভাবে কিছু জানায়নি।’ বিমানবন্দরে আমদানি-রপ্তানি পর্যায়ে পণ্য চুরি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা দেখার দায়িত্ব বিমানের, বেবিচকের নয়। অভিযোগ রয়েছে, পণ্য চুরি হওয়ার পর অনেক সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট বিমানের কাছে অভিযোগ দিলেও পণ্য ফেরত পান না। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স লিমিটেড বিমানবন্দরগুলোর কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্ব পালন করে। মূলত পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের একক ক্ষমতা বিমানের কাছে থাকায় কিছু কর্মকর্তা এ সুযোগ কাজে লাগাচ্ছেন। ঢাকা কাস্টমস এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন নেতাদেরও দাবি, হরহামেশা চুরি হয়ে যাচ্ছে শত শত কোটি টাকার মূল্যবান পণ্যসামগ্রী। প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি চুরি ও হারিয়ে যাওয়া মালপত্রের অভিযোগ বিমানের অভিযোগ শাখায় ফাইলবন্দী হয়ে আছে। তথ্যমতে, বাংলাদেশের প্রধান বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর পাঁচ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি হয়। এর পরই দ্বিতীয় প্রধানতম বাজার জার্মানিতে পণ্য রপ্তানি হয় চার বিলিয়ন ডলারের। আর যুক্তরাজ্যে রপ্তানি হয় ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। অঞ্চল হিসেবে ইউরোপের দেশগুলো বাংলাদেশি রপ্তানি পণ্যের অন্যতম প্রধান ক্রেতা। সেখানে ব্রেক্সিটের কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে যাওয়ার ফলে অর্থনীতিতে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। এর প্রভাব কিছুটা বাংলাদেশেও পড়ার আশঙ্কা অর্থনীতির বিশ্লেষক ও ব্যবসায়ীদের। এমন প্রেক্ষাপটে রবিবার বাংলাদেশের আকাশপথে পণ্য পরিবহনকে ঝুঁকিপূর্ণ অবহিত করে জার্মানির নিষেধাজ্ঞা আরোপে হতাশা প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ীরা। দেশের প্রধান রপ্তানি খাত বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্ব যুক্তরাজ্যের প্রতিষ্ঠান রেডলাইন এভিয়েশন সিকিউরিটিকে দেওয়ার পর আগের চেয়ে মান এখন অনেক উন্নত হয়েছে। আমি মনে করি, জার্মানি যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, তা সে দেশের সিভিল এভিয়েশনের কর্মকর্তারা আমাদের বিমানবন্দর পরির্দশন করার পর থাকবে না।’ এ লক্ষ্যে আজ মঙ্গলবার (গতকাল) রাতে জার্মানির সিভিল এভিয়েশনের একটি প্রতিনিধিদল ঢাকায় আসছে বলেও জানিয়েছেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের এই পরিচালক। এর আগে গত বছর ডিসেম্বরে অস্ট্রেলিয়া ও চলতি বছরের মার্চে যুক্তরাজ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ঘাটতির কথা বলে বাংলাদেশ থেকে আকাশপথে পণ্য পরিবহনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। বাণিজ্যিক ক্ষতির মুখে পড়ে তখন এ সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নেয় সরকার। এরপর যুক্তরাজ্যের পরামর্শ নিয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নয়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। একপর্যায়ে মার্চের শেষ সপ্তাহে শাহজালাল বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় যুক্তরাজ্যের প্রতিষ্ঠান রেডলাইন এভিয়েশন সিকিউরিটিকে নিয়োগ করা হয়। পরে মে মাসে শাহজালাল বিমানবন্দর ‘আরএ-৩’ (ইইউ এভিয়েশন সিকিউরিটি ভ্যালিডেটেড রেগুলেটেড এজেন্ট) মর্যাদা পায়। এর ফলে বাংলাদেশ থেকে তৃতীয় দেশ ঘুরে আবারও যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ায় পণ্যবাহী বিমান চলাচল করতে পারবে বলে তখন জানিয়েছিলেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন। তার দাবি, অস্ট্রেলিয়ায় কার্গো যেতে তৃতীয় দেশে রি-স্ক্রিনিং করাতে হবে। তবে যুক্তরাজ্যের ক্ষেত্রে রি-স্ক্রিনিংয়ের প্রয়োজন হবে না।