সোমবার, ১১ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

সন্দেহ হতাশা সমন্বয়হীনতা বিএনপিতে

কাউন্সিলের তিন মাসে কমিটি নেই। গুলশান-নয়াপল্টন অফিসের সমন্বয় নেই। চেইন অব কমান্ডের বালাই নেই। দমনপীড়নে পতিত তৃণমূল নেতা-কর্মীদের খবর নেয় না কেউ

শফিউল আলম দোলন ও মাহমুদ আজহার

সন্দেহ হতাশা সমন্বয়হীনতা বিএনপিতে

বিএনপিতে এখন চলছে সমন্বয়হীনতা। কেউ কারও কথা শোনেন না। এই মুহূর্তে অন্তর্কোন্দল, নেতা-কর্মীদের পারস্পরিক সন্দেহ-অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতা, আন্তরিকতা ও বিশ্বস্ততার অভাব প্রকট। এর ওপর সরকারের কঠোর দমননীতির কবলে রীতিমতো ভজঘট অবস্থায় পড়েছে বিএনপি। রয়েছে চেয়ারপারসনের খুব কাছের লোকের বেইমানি ও মোনাফেকি। ফলে দল গোছানো বা আন্দোলন—কোনোটাই হচ্ছে না। চেয়ারপারসন একের পর এক নির্দেশনা দিলেও বাস্তবায়ন হচ্ছে না। ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বদলে নেতারা হচ্ছেন শতভাগ ঐক্যভ্রষ্ট। এসব কারণে জাতীয় কাউন্সিলের সাড়ে তিন মাস পরেও দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটিসহ পূর্ণাঙ্গ নির্বাহী কমিটি গঠন করতে পারছেন না খালেদা জিয়া। যদিও বারবার বলা হচ্ছে, চেয়ারপারসন পূর্ণাঙ্গ কমিটির জন্যই এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন।

তবে বিএনপির ভজঘট অবস্থার কথা মানতে নারাজ দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এখন দল গোছানোর কাজ চলছে। সাংগঠনিক এই কার্যক্রম শেষে গণতান্ত্রিক কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে হতাশা নেই বলেও দাবি করেন তিনি। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কমিটি গঠনের দীর্ঘসূত্রতায় দলের যারপর নাই ক্ষতি হচ্ছে। আশা করি চেয়ারপারসন যতদ্রুত সম্ভব কমিটি ঘোষণা করবেন। আর এক্ষেত্রে কোনো সমস্যা থাকলে স্থায়ী কমিটির সদস্যদের নিয়ে আলোচনা করেও সিদ্ধান্ত নিতে পারেন তিনি।

দলের প্রভাবশালী একাধিক নেতা জানান, আওয়ামী লীগ এখন সরকারি দল। তাদের কমিটি না হলেও তেমন সমস্যা নেই। বিএনপি বিরোধী দলের রাজনীতি করছে। এখানে আন্দোলন ও ত্যাগের বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে। পূর্ণাঙ্গ কমিটি না হওয়ায় রাজনীতি থেকে দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে বিএনপি। হতাশ হচ্ছে যোগ্য ও ত্যাগীরা। কমিটি দিলে কমবেশি সমালোচনা থাকবেই। তারপরও দ্রুত কমিটি দেওয়া উচিত। বিএনপির অঙ্গ-সংগঠনগুলোর অবস্থাও নাজুক। নামে যুবদল হলেও মাঠে দেখা মেলে না তাদের। ছাত্রদলের অবস্থাও একই। সংগঠনের কিছু নেতা টেলিভিশনের টকশো আর ইনডোর মিটিংয়ে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে দায়িত্ব পালন শেষ করেন। শ্রমিক দলের সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদককে দলের নেতা-কর্মীরাই চেনেন না। বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য এবং একজন ভাইস চেয়ারম্যান তাদের দুজনের ব্যক্তিগত অনুগত দুই ব্যক্তিকে সংগঠনটির সভাপতি ও সেক্রেটারি পদে ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। কৃষক দলের কমিটি হয় না দীর্ঘ ১৯ বছর। ছাত্রদলের ৭৩৬ সদস্যের যে কেন্দ্রীয় কমিটি দেওয়া হয়েছে তার অবস্থাও তথৈবচ। কমিটি ঘোষণার পরদিনই বিদ্রোহী নেতা-কর্মীরা নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় পুড়িয়ে দিয়েছেন পেট্রল ঢেলে। মহিলা দলের ভিতরের অবস্থা আরও খারাপ। বয়স ও শরীরের ভারে নড়াচড়া করতে বড্ড কষ্ট হয় অনেক নেতা-নেত্রীর। সারাজীবন মাঠে থাকলেও মে মাসে বিএনপির আংশিক নির্বাহী কমিটি ঘোষণার পর থেকে বঞ্চনার দুঃখে, রাগে-ক্ষোভে অভিমানে গুলশান কার্যালয় থেকে দূরে সরে গেছেন সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানা। কেউ বলছেন তিনি গুলশান কার্যালয়ের এক ক্ষমতাধর নেতার ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে ছিটকে পড়েছেন, আবার কেউ বলছেন নিজে থেকেই সরে গেছেন। তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন নগর মহিলা দলের সভাপতি সুলতানা আহমেদ। প্রতিটি অঙ্গসংগঠনের আজ একই অবস্থা। এ ব্যাপারে বিএনপি স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কমিটি গঠনের সব এখতিয়ার চেয়ারপারসনের। কারণ ১৯ মার্চ দলের জাতীয় কাউন্সিলররা তাকে সেই ক্ষমতা দিয়েছেন। কাজেই চেয়ারপারসন তার সুবিধামতো সময়ে সময়োপযোগী কমিটি ঘোষণা করবেন— এটিই প্রত্যাশা। দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘আশা করছি, শিগগিরই নির্বাহী কমিটি দেওয়া হবে। তাছাড়া কমিটির জন্য কোনো সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড তো থেমে নেই। যেসব পদে নাম ঘোষণা হয়নি, ওইসব পদ বহাল আছে।’ বিএনপির সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মো. শাহজাহান বলেন, ‘বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল হয়েছে। এরইমধ্যে আংশিক কমিটিও হয়েছে। বাকিগুলোও হবে। এ নিয়ে টেনশনের কোনো কারণ নেই। কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি গঠনে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি কাজ করছেন। সময়মতো পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করবেন।’

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত আজ দলের চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ার দশা। কারও কথা কেউ মানে না। কারণ দেশের জেলা-উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন থেকে একেবারে ওয়ার্ড পর্যন্ত প্রতিটি ইউনিট কমিটি গঠনেই কমবেশি পদ বাণিজ্য হওয়ার ফলে সঠিক পদে সঠিক লোক আসতে পারেনি। ফলে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

জানা গেছে, নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলের একটি গ্রুপ একেবারে নিজেদের বাড়িঘর বানিয়ে বসলেও মহাসচিবের সঙ্গে কর্মসূচির কোনো সমন্বয় রাখছেন না তারা। বরং মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে এক ধরনের কোণঠাসা করে রেখেছেন তারা। চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ের একটি সূত্র জানায়, সম্প্রতি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের কোনো প্রোগ্রামের বিষয়ে মহাসচিবের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করা হয় না। এমনকি চেয়ারপারসনের নামের বিবৃতি পর্যন্ত কতিপয় নেতা দল বা নিজেদের নামে প্রচার করে যাচ্ছেন। গত শুক্রবার রাত দেড়টায় গুলশানের হলি আর্টিজান ক্যাফেতে হামলা চলাকালে দলের পক্ষ থেকে মিডিয়ায় একটি বিবৃতি পাঠানোর কয়েক ঘণ্টা পর একই বিবৃতি পাঠানো হয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নামেও। এদিকে দল ও অঙ্গসংগঠন ছাড়াও বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের অবস্থাও ভালো নয়। জোটের অন্যতম শরিক দল জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে ভালো যাচ্ছে না বিএনপির সম্পর্ক। অন্যদিকে জোট সম্প্রসারণের ব্যাপারে মহাসচিবের নেতৃত্বে যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল বিএনপির পক্ষ থেকে সেটিও প্রায় ভেস্তে যাওয়ার পথে। অধ্যাপক ড. বদরুদ্দোজা চৌধুরী, ড. কামাল হোসেন, আ স ম আবদুর রব, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীসহ ডান, বাম, মাঝারি কট্টর সবপন্থি রাজনৈতিক সংগঠনের সম্মিলিত প্লাটফর্ম বা ঐক্যের যে ঘোষণা খালেদা জিয়া দিয়েছিলেন সেটিও অপাতত হারিয়ে গেছে। দল কিংবা জোট শক্তিশালীকরণ সংক্রান্ত যে কোনো কর্মসূচি বানচালের জন্যে সরকারি এজেন্ট হিসেবে বেশ কিছু লোক চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে থেকে কাজ করছেন বলে দলের অনেকের অভিযোগ। সূত্র জানায়, চলতি মাসেই খালেদা জিয়া লন্ডনে যেতে পারেন। সপরিবারে তার হজও করার কথা। এর মধ্যে কমিটি না হলে বিএনপির রাজনীতিতে বড় ধরনের ঝড় বইতে পারে। কোরবানির ঈদের পর কমিটি হওয়ার কথাও বলছেন কেউ কেউ। দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে শলাপরামর্শ করেই কমিটি দেওয়া হবে বলেও সূত্রে জানা যায়।

সর্বশেষ খবর