দফায় দফায় সময় বেঁধে দেওয়া হলেও রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প স্থানান্তর হয়নি। কোনো অগ্রগতিও নেই। প্রতিদিনের মতোই চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ করা হচ্ছে। শ্রমিকরাও ব্যস্ত সময় পার করছেন এখানে। হাতেগোনা কয়েকটি ছাড়া স্থানান্তরের ব্যাপারে কোনো ট্যানারির মালিক আন্তরিক নয়। হাজারীবাগে ছোট-বড় ও মাঝারি মিলে মোট ট্যানারির সংখ্যা ১৯৪টি। সাভারের হেমায়েতপুরে ২০০ একর জায়গাজুড়ে নির্মাণাধীন চামড়া শিল্পনগরীতে ২০৫টি প্লটে ১৫৫টি কারখানা স্থাপন করার কথা রয়েছে।
এদিকে, একজন ট্যানারি মালিক বলেন, সাভারে এখনো প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি। বর্জ্য শোধনাগারও নির্মাণ করা হয়নি। সেখানে গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ নেই। এ পরিস্থিতিতে চামড়া নিয়ে আমরা কোথায় যাব? এ ছাড়াও ট্যানারি স্থানান্তর করতে গিয়ে আমরা আর্থিক সংকটে পড়েছি। টাকা সংগ্রহ করতে গিয়ে বাড়ি বিক্রি করতে হয়েছে। একদিকে শিল্পনগরীতে বরাদ্দ নেওয়া প্লটের কিস্তি পরিশোধ অন্যদিকে নতুন করে কারখানা তৈরি। সবমিলে হিমশিম খেতে হচ্ছে। জানা গেছে, সাভারে ট্যানারি শিল্পের কাজ শুরু হতে আরও বছর খানেক সময় লাগবে। সরেজমিন দেখা গেছে, ট্যানারির পচা চামড়া ও বর্জ্যের গন্ধে দিশাহারা এলাকাবাসী। ট্যানারি কারখানার বর্জ্য, টুকরা চামড়া, গরুর হাড়, চর্বি, দাঁত পুড়িয়ে পোলট্রি ফিডসহ নানা জিনিস তৈরি করা হয়? এসব কারখানার বিষাক্ত ধোঁয়া পুরো এলাকা আচ্ছন্ন করে ফেলছে। ট্যানারি শ্রমিক হাজী সোহেল জানান, ১ এপ্রিল থেকে সরকার হাজারীবাগে কাঁচা চামড়া ঢুকতে দেয়নি। এতে প্রায় হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে ট্যানারি মালিকদের। বায়াররা অন্য দেশে অর্ডার দিয়েছেন। চামড়া শিল্পে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এতে করে চামড়া পাচার হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সাভারের চর নারায়ণপুরে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বিসিক। প্রকল্প এলাকায় ওয়েস্ট ডাম্পিং ইয়ার্ড, কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি), সড়ক, সড়কবাতি, ড্রেন, স্যুয়ারেজ লাইন, ছোট কালভার্ট, পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস লাইনসহ নানা অবকাঠামোর কাজ চলমান রয়েছে। এদিকে, ১৪ বছর আগে ট্যানারি শিল্প হাজারীবাগ থেকে সরিয়ে নিতে উচ্চ আদালত নির্দেশ দিলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। ২০০১ সালে ট্যানারি সরাতে নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। পরে কয়েক দফা সময় বাড়িয়ে ২০১১ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত স্থানান্তরের সময় বেঁধে দেওয়া হয়। কিন্তু এ সময়ের মধ্যেও ট্যানারি স্থানান্তরিত না হওয়ায় ২০১৪ সালের ১৫ এপ্রিল আদালত অবমাননার রুল জারি করে হাইকোর্ট। পরে গত বছর ২১ এপ্রিল আদালতের তলবে হাইকোর্টে হাজির হয়ে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দেন শিল্প সচিব। ২০০৩ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় (একনেক) সাভার চামড়া শিল্পনগরী প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। এ শিল্পনগরীর কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০০৫ সালে। নির্ধারিত সময়ে শেষ না হওয়ায় প্রকল্পটি সংশোধন করে মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০১০ সাল পর্যন্ত। তখন প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৫৪৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকায়। এর পরও কাজ শেষ হয়নি। পরে ব্যয় না বাড়িয়ে আবারও ২০১২ সাল পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হলেও কাজ শেষ হয়নি। সর্বশেষ ২০১৩ সালের ১৩ আগস্ট দ্বিতীয় দফায় সংশোধিত প্রকল্পের অনুমোদন হয় একনেক। এ সময় ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ৭৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা। ৩০ জুন শেষ হয়েছে ট্যানারি স্থানান্তরের সর্বশেষ সময়সীমা। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্যানারিতে চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণে কারখানা থেকে প্রতিদিন ২২ হাজার ঘনমিটার ক্রোমিয়াম, সালফার, অ্যামোনিয়াসহ ক্ষতিকর নানা বর্জ্য ওই এলাকাকে বিষিয়ে তুলেছে। হাজারীবাগের ট্যানারির মারাত্মক পানি দূষণকারী রাসায়নিক বর্জ্য পরিশোধন ছাড়াই সরাসরি ফেলা হচ্ছে বুড়িগঙ্গায়। প্রতিদিন বুড়িগঙ্গায় ১৫ হাজার ঘনমিটার দূষিত পানি নির্গমন হচ্ছে। ট্যানারির এই বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে রাজধানীর মাটি, পানি, এমনকি বাতাসও।