শনিবার, ১৬ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

পঞ্চগড়ে কারখানা মালিকদের কাছে জিম্মি চা চাষিরা

মাহমুদ আজহার ও সরকার হায়দার

পঞ্চগড়ে কারখানা মালিকদের কাছে জিম্মি চা চাষিরা

নির্ধারিত মূল্যে চায়ের পাতা বিক্রি করতে না পেরে বাগানের কাছেই স্তূপ করে রাখা হচ্ছে —বাংলাদেশ প্রতিদিন

দেশের সম্ভাবনাময় শিল্প চা বাগানে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন পঞ্চগড়ের চাষিরা। ব্রিটিশ আমলের কুখ্যাত নীলকরদের স্টাইলে কারখানা মালিকরা জিম্মি করে ফেলেছেন তাদেরকে। নিজেদের বাগানে উত্পাদিত পাতার ৫০ থেকে ৬০ ভাগই কারখানা মালিকদের বিনা টাকায় দিতে বাধ্য ক্ষুদ্র চাষিরা। পুরো পঞ্চগড়ে মাত্র ছয়টি কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে সচল চারটি। যেখানে আরও অন্তত ১৫ থেকে ২০টি কারখানা দরকার। প্রক্রিয়াজাতকরণে ছয় কারখানার তুলনায় তিনগুণ পাতা উত্পাদন হচ্ছে। এ সুযোগের ফাঁদে ফেলে কারখানা মালিকরা চাষিদের পাতার দাম অর্ধেকেরও কম দিচ্ছেন। পাশাপাশি চাষিদের সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহারও করা হচ্ছে।

জানা যায়, পঞ্চগড়ে বিডি-২৬, বিডি-২৯সহ উন্নত মানের দার্জিলিং ভেরাইটির চা উত্পাদন হয়। যা আন্তর্জাতিক মানের। দেশের একমাত্র অর্গানিক চাও পঞ্চগড়ে উত্পাদিত হয়। কিন্তু চা উত্পাদন করতে গিয়ে বেকায়দায় পড়ছেন কৃষকরা। বিকল্প কোনো ব্যবস্থা না থাকায় নানা নির্যাতন সয়ে ঘুরেফিরে ওই কারখানা কর্তৃপক্ষের কাছেই ধরনা দিচ্ছেন প্রান্তিক চা চাষিরা। তাদের দাবি, চায়ের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পঞ্চগড়ে সরকারকে অবিলম্বে পর্যাপ্ত চা প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা তৈরি করতে হবে। চা পাতা প্রক্রিয়াজাত করে দেশ-বিদেশের বাজারকে আরও গতিশীল করতে হবে। এতে দেশের অর্থনীতির চাকা আরও সচল হবে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ চা বোর্ডের পঞ্চগড় আঞ্চলিক অফিসের কর্মকর্তা সুমন শিকদার জানান, ‘কাঁচা চা পাতা কেটে নেওয়ার ব্যাপারে সরকারি কোনো নিয়ম নেই। এ ব্যাপারে কারখানা মালিকদের বার বার তাগিদ দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু তারা শুনছেন না। পঞ্চগড়ে চায়ের আবাদ দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু সেই তুলনায় কারখানা হচ্ছে না। সে জন্য বর্তমান কারখানা মালিকরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এ কাজটি করছেন।’ পঞ্চগড়ে মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে চা চাষে অভাবনীয় সাফল্য পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু বর্তমানে চা নিয়ে চরম নৈরাজ্যের অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগের তীর নর্থবেঙ্গল চা কারখানা, করতোয়া চা কারখানা, তেঁতুলিয়া টি কারখানা ও গ্রিন কেয়ার কারখানার বিরুদ্ধে। এসব কারখানায় রীতিমতো অরাজকতা চলছে। আবার এসব কারখানা সুদে ঋণ দিয়ে কৃষকদের চা চাষে উদ্বুদ্ধও করেছে। এখন চা চাষ করে বিপদে পড়ছেন চাষিরা। সুদের ঘানি টানতে হচ্ছে তাদের। অন্যদিকে চায়ের পাতার ন্যায্য মূল্যও পাচ্ছেন না। এ ব্যাপারে সরকারও কোনো পদক্ষেপই নিচ্ছে না। বাধ্য হয়ে কৃষকরা আবার ধান বা অন্য রবিশস্য চাষের দিকে ফিরে যাচ্ছেন। সূত্রমতে, স্থানীয় প্রশাসনের একটি অংশের যোগসাজশে কারখানা মালিকরা ক্ষুদ্র চাষিদের জিম্মি করছেন। চায়ের বাম্পার উত্পাদনের সুযোগকে পুঁজি করে চাষিদের উত্পাদিত লাখ লাখ কেজি কাঁচা চা পাতা অবৈধভাবে লুট করে নিচ্ছেন তারা। সরকার ত্বরিত কোনো উদ্যোগ না নিলে পঞ্চগড়ে চা শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। এদিকে সচল চারটি কারখানার মধ্যে করতোয়া চা কারখানা ১০ দিন ধরে চা পাতা নিচ্ছে না। তাই পঞ্চগড় সদরে এখন নর্থবেঙ্গল কারখানার ওপর চাপ পড়েছে। 

পঞ্চগড় সদরের চা চাষি মো. আনিছুর রহমান প্রধান। তিনি নর্থবেঙ্গল চা কারখানায় ১ হাজার কেজি চা পাতা নিয়ে যান। তাকে ৫০০ কেজি পাতার দাম দেওয়া হয়। অর্থাৎ ২৫ হাজার টাকার মধ্যে তিনি পান মাত্র সাড়ে ১২ হাজার টাকা। কেন অর্ধেক টাকা দেওয়া হলো জানতে চাইলে আনিছ প্রধান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কারখানা কর্তৃপক্ষ তাকে জানায়, এর বেশি দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। নইলে পাতা ফেরত নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়। কোনো বিকল্প না পেয়ে অর্ধেক মূল্যেই পাতা দিয়ে দেন কারখানা কর্তৃপক্ষকে। খাবিরুল নামে এক প্রান্তিক চা চাষি তার ৮০০ কেজি পাতা নিয়ে যান ওই কারখানায়। কিন্তু তার পাতা নেয়নি কারখানা কর্তৃপক্ষ। বাধ্য হয়ে সব পাতা বাড়িতে ফেরত এনে নষ্ট করে দেন খাবিরুল। এখন তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আর চা বাগান করবেন না। প্রয়োজনে ধান চাষে ফিরে যাবেন। রবিউল প্রধান নামে এক চাষি নর্থবেঙ্গল চা কারখানা থেকে সুদে ঋণ নিয়ে ৭০ বিঘা চা বাগান করেছেন। তাকে প্রতি মাসে কিস্তিতে টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে। কিন্তু তিনি চা পাতাই বিক্রি করতে পারছেন না। এখন উভয় সংকটে পড়েছেন তিনি। তার পরিবারে এখন ভয়াবহ দুর্যোগ নেমে এসেছে। তেঁতুলিয়া উপজেলার গড়িয়াগজ এলাকার হাইস্কুল শিক্ষক মাসুদ আল করিম ৭ একর জমিতে চা চাষ করেছেন। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ‘ব্রিটিশরা যেমন নীল চাষিদের ওপর অত্যাচার করত ঠিক তেমনই বর্তমানে চা কারখানার মালিকরা চা চাষিদের জিম্মি  করেছেন। কয়েক দিন আগে একটি কারখানায় কাঁচা চা পাতা বিক্রি করতে গেলে তারা ৪৫ ভাগ চা পাতা কেটে রেখে বাকিটার মূল্য পরিশোধ করে। একই অভিযোগ কানকাটা এলাকার ক্ষুদ্র চাষি চান মিঞা ও আহসান হাবিবের। তারা জানান, ২ হাজার ৫০০ কেজি কাঁচা চা পাতা বিক্রি করতে গেলে কারখানা কর্তৃপক্ষ মাত্র ১২০০ কেজি চা পাতার দাম পরিশোধ করে। এ নিয়ে কিছুই করার ছিল না। কারণ ওই কাঁচা চা পাতা ফেরত নিলে ফেলে দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। তারা জানান, কেউ প্রতিবাদ করলে তার চা পাতা ফেরত দেওয়া হয়। অনেকের সঙ্গে দুর্ব্যবহারও করা হয়। এ প্রসঙ্গে করতোয়া চা কারখানা পঞ্চগড়ের ম্যানেজার মুজাহেদুল হান্নান নিপুণের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি চাষিদের কাছ থেকে চা পাতা কেটে  নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন। এ প্রসঙ্গে নর্থবেঙ্গল সেন্ট্রাল টি ইন্ডাস্ট্রির ম্যানেজার (এডমিন) আবদুর রাজ্জাক জানান, আমাদের কারখানার ধারণ ক্ষমতা মাত্র ৪০ টন। সেখানে পাতা আসে অন্তত দেড়শ টন। বাড়তি পাতা নিতে পারছি না। বাকি পাতা ফেলে দিচ্ছি। তাছাড়া একটি জেনারেটরও বিকল হয়েছে। তা সারাতে সময় লাগছে। নইলে আরও পাতা নেওয়া যেত।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর