শনিবার, ২৩ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে নেই সমন্বিত পরীক্ষা পদ্ধতি

দুর্ভোগে ভর্তিচ্ছুরা, উৎকণ্ঠায় অভিভাবকমহল

আকতারুজ্জামান

শিক্ষাজীবনের ১২টি সিঁড়ি পার হয়ে উচ্চশিক্ষার পীঠস্থান বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন শিক্ষার্থীদের। এমন এক শিক্ষার্থী সোনিয়া খান সুরভি। রাজধানীর খ্যাতনামা একটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাসের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেবেন তিনি। কিন্তু ভর্তি পরীক্ষা শুরুর প্রায় তিন মাস আগ থেকেই পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন তিনি। কারণ, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার জন্য ভিন্ন দিন নির্ধারিত থাকে। এক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা শেষে সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হবে পরীক্ষায় অংশ নিতে। এ ক্ষেত্রে ভর্তিচ্ছুকে পোহাতে হয় নানা দুর্ভোগ। আর উৎকণ্ঠায় থাকেন অভিভাবকরা। ভর্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রে দুর্ভোগ আর ভোগান্তি এড়াতে রাজধানীতে অবস্থিত দুই বা তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়কেই বেছে নিতে হবে সুরভিকে। পরিবার থেকে এমনটিই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ কেন্দ্রীয়ভাবে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন      করা গেলে এ ভোগান্তি থেকে রক্ষা হতো। শুধু সোনিয়া খানম সুরভি নন, দেশের প্রায় ১০ লাখ ভর্তিচ্ছু ও তাদের পরিবার সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গিয়ে পরীক্ষা দেওয়ার টেনশনে ভুগছে। ভর্তি পরীক্ষার প্রায় দুই মাস আগেই এ বিষয়টি ভাবিয়ে তুলছে তাদের। ইতিমধ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার সম্ভাব্য তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। পাবলিক, প্রকৌশল ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালগুলোয় ভিন্ন ভিন্ন দিনে পরীক্ষার তারিখ নির্ধারিত রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সময়, অর্থ উভয়ই অপচয় হবে ছাত্র-ছাত্রীদের। এ ছাড়া রাজশাহীসহ কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সাবজেক্টভিত্তিক পরীক্ষার আয়োজন করে থাকে। এতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয় ভর্তিচ্ছুদের। একের পর এক ভর্তি পরীক্ষায় নাজেহাল হয়ে যান ছাত্র-ছাত্রীরা। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগ্রহ থাকলেও ভোগান্তি এড়াতে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে যান না শিক্ষার্থীরা। তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ভালো মানের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে পরীক্ষা দেওয়া থেকে বঞ্চিত হন তারা। গুচ্ছ পদ্ধতিতে পরীক্ষা না নেওয়ার পেছনে আর্থিক একটি কারণ দায়ী বলেও মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অধ্যাপক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ভর্তি পরীক্ষা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ের বড় মাধ্যম। পরীক্ষা শেষে শিক্ষকরা আবেদনের সময় শিক্ষার্থীদের জমা দেওয়া মোটা অঙ্কের অর্থের ভাগ পান। এ কারণেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেন্দ্রীয় পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষার পক্ষে মত দেয় না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১০ সালে বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কেন্দ্রীয়ভাবে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার আওতায় আনার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের নিয়ে বৈঠক করে এ ব্যাপারে মতামত চান। কিন্তু কয়েক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এতে আপত্তি তোলেন। এরপর বিষয়টি আর এগোয়নি। শিক্ষামন্ত্রীর কাছে জানতে চাইলে তিনি এ ব্যাপারে বলেন, ‘আমি চাই দুর্ভোগ-ভোগান্তি এড়িয়ে আমার ছাত্র-ছাত্রীরা ভালোভাবে ভর্তি পরীক্ষা দিক। আমার অনুরোধ, উপাচার্যরা এ বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন।’

এর আগে ভোগান্তি ও দুর্ভোগ এড়াতে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি) এবং যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু এমন হলে শাবিপ্রবিতে সিলেটি শিক্ষার্থীদের সংখ্যা কমে যাবে এমন আশঙ্কা থেকে আর গুচ্ছ পদ্ধতিতে নেওয়া সম্ভব হয়নি। পরে এ দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই দফায় ভর্তি পরীক্ষা নিতে হয়েছে। এতে ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে ভর্তিচ্ছু ছাত্র-ছাত্রীদের।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সমন্বিত পদ্ধতিতে ভর্তি পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, “এ বিষয়টির গুরুত্ব থেকেই তিন বছর আগে চেয়ারম্যান থাকাকালে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের নিয়ে বৈঠকে বসেছিলাম। শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ আর অভিভাবকদের দুশ্চিন্তা এড়াতে সাধারণ, প্রকৌশল ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গুচ্ছ পদ্ধতি চালু করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কয়েকজন উপাচার্য এতে দ্বিমত দিলে এটি আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্তশাসিত। উপাচার্যরা মনে করেছিলেন এ ক্ষেত্রে তাদের ‘অটোনমি পাওয়ার’ বিনষ্ট হবে।” ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই উপাচার্য আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সংগতি রেখে ছাত্র নির্বাচন করতে চায়। তাই পৃথক পরীক্ষার আয়োজন করে। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয়ভাবে একটি পরীক্ষার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ থাকলে উচ্চশিক্ষা একটি স্ট্যান্ডার্ডের মধ্যে চলে আসত। কোয়ালিটি এনশিউর করা সহজ হতো। দেশের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদরাও মত দিয়েছেন গুচ্ছ পদ্ধতির পক্ষে। কীভাবে পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে তারও একটি প্রক্রিয়ার আলোকপাত করেছেন তারা। শিক্ষাবিদরা বলছেন, কেন্দ্রীয়ভাবে একটি পরীক্ষা হবে। সেদিন কেউ অসুস্থ থাকলে সাপ্লিমেন্ট পরীক্ষার আয়োজন থাকবে। এক দিনে পরীক্ষা সম্পন্নের ক্ষেত্রে ঢাকা বিভাগের সব কলেজে এ পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) মতো প্রতি বিভাগে পরীক্ষার আয়োজন করা যেতে পারে। আবেদনের সময় এ ক্ষেত্রে পরীক্ষার কেন্দ্র অপশন রাখা যেতে পারে। এসব ব্যাপারে জানতে চাইলে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ মন্জুরুল ইসলাম বলেন, কেন্দ্রীয়ভাবে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করলে একসঙ্গে অনেক লাভ হয়। পরীক্ষায় একটা স্ট্যান্ডার্ড বজায় থাকবে। একই সঙ্গে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে। অভিভাবকরা স্বস্তি পাবেন। ভর্তিচ্ছুদের ভোগান্তি কমবে। এতে দু-একটি নেতিবাচক দিক আসতে পারে। তবে ইতিবাচক দিকগুলো নেতিবাচক দিককে ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের এই অধ্যাপক।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান এ ব্যাপারে বলেন, ‘আমি মনে করি সমন্বিত পদ্ধতিতে সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভর্তির জন্য একটি কেন্দ্রীয় পরীক্ষার আয়োজন করলে তাতে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা উপকৃত হবে। আমি এ পদ্ধতির পক্ষে।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর