মঙ্গলবার, ২৬ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

মানহীন কাগজে পাঠ্যবই ছাপতে চান না মুদ্রণ ব্যবসায়ীরা

এনসিটিবির বিরুদ্ধে গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ শেষ

নিজস্ব প্রতিবেদক

আগামী বছর মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যের এক কোটি পাঠ্যবই ছাপাতে মানহীন কাগজের ব্যবহার নিয়ে ক্ষুব্ধ দেশের মুদ্রণ শিল্প মালিকরা। তারা বলেছেন, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড-এনসিটিবির শীর্ষ কর্মকর্তাদের অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে যে নিম্নমানের বই আমাদের ছাপতে হবে সেটার দায় এসে আমাদের ওপরই বর্তাবে। কারণ, মানহীন কাগজ দিয়ে ভালো প্রকাশনা আশা করা যায় না। আমরা এনসিটিবির অনিয়মের অংশীদার হতে চাই না।  সূত্র জানায়, কাগজ উৎপাদনে নেই এমন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেই কাগজ কিনে সরকারি অর্থ হরিলুটে মেতে উঠেছেন এনসিটিবি কর্তাব্যক্তিরা। দেশের পণ্যমান নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটের (বিএসটিআই) অনুমোদন নেই, এমন প্রতিষ্ঠান থেকেই কাগজ কেনার কারণে এনসিটিবির স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তাদের প্রশ্রয়ে এমন ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠানগুলোর দৌরাত্ম্য বেড়েছে। এনসিটিবির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, গত বছর ২০১৫ সালের মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবইয়ের জন্য প্রায় দেড়শ কোটি টাকার ২০ হাজার টন কাগজ কেনে এনসিটিবি। ৯টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কয়েকটি নিম্নমানের কাগজ সরবরাহ করে। এমনকি কাগজের মিল নেই এমন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কাগজ কেনায় সময়মতো সরবরাহ পায়নি এনসিটিবি। আবার যখন দিয়েছে, তা ছিল অত্যন্ত নিম্নমানের কাগজ। এ নিয়ে মুদ্রণশিল্প মালিকদের অভিযোগ, গত বছরের কাগজের মান যথাযথ ছিল না। কাগজ মানসম্পন্ন কি-না, তা খতিয়ে দেখতে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ পরীক্ষার নির্দেশ দিলেও তা উপেক্ষা করে এনসিটিবি। বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদে (সায়েন্স ল্যাবরেটরি) কাগজের মান পরীক্ষায় দেখা গেছে, একটি কাগজ মিলের সরবরাহ করা কাগজ নিম্নমানের। দরপত্রের শর্তানুযায়ী, সরবরাহকৃত কাগজে জিএসএম (গ্রামজ স্কয়ার মিটার) থাকার কথা ৬০ শতাংশ। পরীক্ষায় পাওয়া গেছে ৫৮ দশমিক ৮৯ ভাগ। একইভাবে কাগজের বাস্টিং ফ্যাক্টর থাকার কথা ১২ ভাগ, আছে মাত্র ৮ দশমিক ৫৮ ভাগ, ব্রাইটনেস থাকার কথা ৮০ ভাগ, আছে মাত্র ৬৭ দশমিক ৭৮ ভাগ। গত বছরের আশকারার কারণে এবার আরও খারাপ কাগজ সরবরাহের আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মুদ্রণশিল্প সমিতির চেয়ারম্যান শহীদ সেরনিয়াবাত বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এনসিটিবির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য দেশের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হাতে নিম্নমানের বই তুলে দেওয়ার পাঁয়তারা করছে। কিন্তু আমরা নিম্নমানের কাগজে বই ছাপিয়ে সুনাম নষ্ট করতে পারি না। নিম্নমানের বই ছাপালে সরকারের সুনাম নষ্ট হতে পারে। আমাদের ওপরও বদনাম চাপতে পারে। তিনি এনসিটিবিকে সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, দুই নম্বরি থামান। তথ্যমতে, বই ছাপানোকে কেন্দ্র করে বেপরোয়া বাণিজ্য শুরু করেছে এনসিটিবির এক শ্রেণির প্রভাবশালী অসাধু কর্মকর্তা। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালের নতুন বছরে মানহীন কাগজে প্রায় এক কোটি শিক্ষার্থীর হাতে মানহীন পাঠ্যবই দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে বলে অভিযোগ তুলেছেন মুদ্রণশিল্প ব্যবসায়ীরা। জানা যায়, এনসিটিবির টেকনিক্যাল কমিটি কাগজ কেনার টেন্ডার মূল্যায়ন করে ৯টি প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচিত করে সম্প্রতি অনুমোদনের জন্য ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে পাঠিয়েছে। ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি এই প্রস্তাবে অনুমোদন দিলেই কাগজ উৎপাদনে সক্ষম নয় এমন প্রতিষ্ঠান থেকে কাগজ কেনার প্রক্রিয়া শুরু হবে। মানহীন কাগজ দিয়ে মাধ্যমিকের বই ছাপা হলে এ নিয়ে সরকারকে সমালোচনার মুখে পড়তে হবে। বাংলাদেশ পাঠ্যপুস্তক মুদ্রক ও বিপণন সমিতি সূত্র জানায়, অর্থ লেনদেন ও খাতিরের বিনিময়ে এবার কাগজ সরবরাহের কাজ পেয়েছে অনেকে। এ মুহূর্তে এনসিটিবির গুদামে রক্ষিত ও আরামবাগের বিভিন্ন প্রেসে বই ছাপা হতে থাকা কাগজের মান পরীক্ষা করলেই নিম্নমানের কাগজ সরবরাহের সত্যতার প্রমাণ মিলবে। অভিযোগ রয়েছে, চলতি বছর নিম্নমানের কাগজে ছাপা হওয়া পাঠ্যবই শিক্ষা বছরের ছয় মাস না যেতেই ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের বইয়ের কাগজ নিয়ে এমন অভিযোগ শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকদের। আগামী শিক্ষাবর্ষের জন্য যে বই ছাপা হবে, সেখানেও নিম্নমানের কাগজ ব্যবহারের তত্পরতা শুরু হয়েছে। যাদের কাছ থেকে কাগজ কেনা হচ্ছে তাদের কাগজের জিএসএম, ব্রাস্টিং ফ্যাক্টর, ব্রাইটনেস কোনো কিছুই ঠিক থাকার কথা নয়। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, বই প্রকাশে সরকারের বিপুল অর্থ ব্যয় হয়। তাই এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা অবশ্যই থাকতে হবে। বিনামূল্যে দেওয়া হবে বলে ছাত্রছাত্রীদের হাতে যেনতেন কাগজের বই ধরিয়ে দেওয়া চলে না।

সর্বশেষ খবর