মঙ্গলবার, ২৬ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা
ঐতিহ্য

গৌরনদীর মিষ্টি-দধি খ্যাতির শীর্ষে

রাহাত খান, গৌরনদী থেকে ফিরে

গৌরনদীর মিষ্টি-দধি খ্যাতির শীর্ষে

ভোলা থেকে অফিশিয়াল কাজে বরিশালের গৌরনদীতে এসেছিলেন খোকন বণিক। বাড়ি যাওয়ার আগে বাসস্ট্যান্ডের দোকান থেকে এক প্যাকেট মিষ্টি এবং এক হাঁড়ি দধি কিনেছেন তিনি। ভোলায় দোকান থাকতে কেন তিনি গৌরনদীর  মিষ্টি কিনলেন? জবাবে খোকন বণিক জানালেন, যুগ যুগ ধরে শুনে আসছেন গৌরনদীর দধি-মিষ্টির গুণাগুণ। তাই গৌরনদী এলেই প্রিয়জনদের জন্য গৌরনদীর মিষ্টি-দধি নিয়ে যান। তার মতে, গৌরনদীর মিষ্টি গরুর খাঁটি দুধ দিয়ে তৈরি। এতে কোনো ভেজাল দেওয়া হয় না। খেতে খুব সুস্বাদু। অফিসের কাজে এসেছিলেন, অফিসের কাজ শেষে বোনাস হিসেবে স্বজনদের জন্য গৌরনদীর দধি-মিষ্টি নিয়ে যাচ্ছেন তিনি। একইভাবে নতুন ঠিকাদারি সাইডের (কাজ) উদ্বোধন করবেন মাদারীপুরের পাভেল রহমান। উদ্বোধন উপলক্ষে দোয়া-মোনাজাতের আয়োজন করেছেন তিনি। এজন্য মিষ্টি না হলেই নয়। তাই সুদূর মাদারীপুর থেকে গৌরনদী এসেছেন তিনি। পাভেলের মতে, গৌরনদীর মিষ্টির রয়েছে বিশেষ গুণাগুণ। এই মিষ্টি একবার খেলে আরেকবার খেতে মন চায়। এই মিষ্টি নির্ভেজাল, খেতেও অসাধারণ। তাই কষ্ট হলেও দোয়া-মোনাজাত অনুষ্ঠানের জন্য মিষ্টি কিনতে মাদারীপুর থেকে গৌরনদীতে তিনি এসেছেন। গৌরনদীর আরেক যুবক রাশেদ সরদার। ঢাকায় চাচার বাসায় যাচ্ছিলেন, কিন্তু খালি হাতে যাওয়া অশোভন। তাই গৌরনদী থেকে এক প্যাকেট মিষ্টি এবং এক হাঁড়ি দধি কিনেছেন। ঢাকায় দেশের খ্যাতনামা অনেক মিষ্টি পাওয়া গেলেও গৌরনদী থেকে কষ্ট করে ঢাকায় দধি-মিষ্টি কিনে নেওয়ার কারণ হিসেবে রাশেদ সরদারের বক্তব্য- শুধু ঢাকা নয়, কোনো আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি গেলেই গৌরনদীর দধি-মিষ্টি নিয়ে যান। গৌরনদীর মিষ্টি-দধি দেখে আত্মীয়-স্বজনরা খুব খুশি হন। তাদের খুশিতে তিনি নিজেও পুলকিত হন। খোকন, পাভেল ও রাশেদের মতো শত শত মানুষ প্রতিদিন গৌরনদীর দধি-মিষ্টি নিয়ে যাচ্ছেন দেশের বিভিন্নস্থানে বসবাসকারী প্রিয়জনদের জন্য। শুধু দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় গৌরনদীর দধি-মিষ্টি। বাণিজ্যিকভাবে রপ্তানি না হলেও সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, সৌদিআরবসহ মধ্যপ্রাচ্য, এমনকি ইউরোপ-আমেরিকায় বসবাসকারী দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ দেশে বেড়ানো শেষে ফেরার  সময় প্রিয়জন, সহকর্মী এবং বন্ধুদের জন্য নিয়ে যান গৌরনদীর দধি-মিষ্টি। গৌরনদী বাসস্ট্যান্ডের গৌরনদী বিসমিল্লাহ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের ম্যানেজার আলাউদ্দিন হাওলাদার জানান, চমচম রসগোল্লা শুকনা মিষ্টি কালোজামসহ হরেক নামের মিষ্টি এবং দধি তৈরি করেন তারা। এই মিষ্টির খুব চাহিদা। তিনি বলেন, দুধ যত খাটাবে (আগুনে জ্বাল দিয়ে ঘন করবে) দধি ততই ভালো হবে। এ কারণেই গৌরনদীর দধির খ্যাতি সর্বত্র। আর মিষ্টি বানানো হয় খাঁটি গরুর দুধ দিয়ে ছানা কাটানোর পর। ছানা ছাড়া মিষ্টিতে আর কিছুই দেওয়া হয় না। তবে মিষ্টির গোল্লা ধরে রাখার জন্য ২ কেজি ছানার সঙ্গে এক ছটাক পরিমাণ ময়দা মিশাতে হয়। মিষ্টি-দধির কারিগর নলিত দাস জানান, পুরনোদের দেখাদেখি তিনি এই কাজ শিখেছেন। অন্য কাজ করতে পারেন না। ঘরের মধ্যে ছায়ায় বসে এই কাজ বাইরের অন্যান্য কাজের চেয়ে আরামদায়ক। এই কাজে রোদ-বৃষ্টিতে নামতে হয় না। তবে বেতন কিছুটা কম বলে আক্ষেপ সব কারিগরদের। তার মতো প্রায় ২০০ কারিগর গৌরনদীর বিভিন্ন দধি-মিষ্টির দোকানে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন।

গৌরনদী বাসস্ট্যান্ডের দিলিপ কুমার মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মালিক স্বপন কুমার দাস জানান, গৌরনদীতে বাণিজ্যিকভাবে কবে থেকে দধি-মিষ্টির প্রচলন হয়েছে তা সঠিক করে বলতে পারবেন না। তবে তার ঠাকুর দা কিশোর কালিকান্ত দাসের কাছ থেকে বাবা দিলিপ কুমার দাস এবং পরবর্তীতে বাবা দিলিপ কুমার দাসের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে মিষ্টির ব্যবসা পেয়েছেন তিনি। তাদের মুখে শুনেছেন, গৌরনদীর দধি-মিষ্টির খ্যাতি প্রায় ২০০ বছরের। রাজ বল্লভ ঘোষ এবং নারায়ণ ঘোষ নামে দুজন গৌরনদীতে দধি-মিষ্টির ব্যবসার গোড়াপত্তন করেন। পরবর্তীতে সচীন ঘোষ, সুশীল ঘোষ এবং ননীৃ ঘোষসহ অনেকই এই ব্যবসার হাল ধরেছেন। তাদের দেখাদেখি অনেকেই গৌরনদীতে দধি-মিষ্টির ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছেন।

গৌরনদী বন্দরের বৃহৎ মিষ্টির ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সচীন ঘোষ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের প্রতিষ্ঠাতা সচীন ঘোষের ছেলে সুধাম ঘোষ জানান, সচরাচর তারা দধি এবং শুকনা মিষ্টি, রসগোল্লা, রস মালাই, ক্ষীরপুরি, রসমঞ্জুরী, চমচম, কালোজাম, সন্দেশ ও বালুশাহ্সহ ১২ থেকে ১৪ প্রকারের মিষ্টি তৈরি করেন। এছাড়া ক্রেতার কোনো বিশেষ পছন্দ থাকলে সে অনুযায়ী মিষ্টি তৈরি করেন। প্রতিকেজি ক্ষীরপুরি ৬০০ টাকা, রসমালাই ২৮০ টাকা, রসগোল্লা ১৫০ টাকা, চমচম ও কালোজাম ১৪০টাকা এবং শুকনা মিষ্টি প্রতি কেজি প্রকার ভেদে ১৩০ থেকে ১৬০ টাকা দরে বিক্রি করে থাকেন। প্রতি কেজি দধি বিক্রি করেন ১১০ থেকে ১২০ টাকা।

সর্বশেষ খবর