বুধবার, ২৭ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা
সাফল্য

মোজাফ্ফরের বাঁশি দেশ ছেড়ে বিদেশে

মাহবুবুর রহমান, শ্রীপুর (গাজীপুর)

মোজাফ্ফরের বাঁশি দেশ ছেড়ে বিদেশে

ঝরনা কলম মেরামতে  মোজাফ্ফরের নামডাক ছিল হাটে হাটে। এ কলমের ব্যবহার সময়ের পরিক্রমায় কমতে থাকে। মোজাফ্ফর তখন পরিবর্তন করেন পেশা। যুক্ত হন বাঁশি তৈরি পেশায়। এভাবে তিনি বাঁশি তৈরি করছেন ৪৬ বছর ধরে। এখন তার বাঁশি দেশের বাজার থেকে ছড়িয়ে পড়েছে বিদেশের বাজারে। বাঁশির এ কারিগরের পুরো নাম মোজাফ্ফর মণ্ডল (৬০)। তিনি গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার বরমী ইউনিয়নের গাড়ারন গ্রামের মৃত হাজী রেয়াজ উদ্দিন মণ্ডলের ছেলে। প্রতি বছর তিনি প্রায় ২০ হাজার বাঁশি বিক্রি করেন। সেট বিক্রি করেন কমপক্ষে ৪০টি। সংগীতের ব্যাকরণ অনুযায়ী ২৬টি বিভিন্ন ধরনের বাঁশি দিয়ে তৈরি হয় এক-একটি সেট। মোজাফ্ফর জানান, বর্তমানে তিনি ভারত, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর, ফ্রান্স ও অস্ট্রেলিয়ায় বাঁশি রপ্তানি করেন। রপ্তানি প্রক্রিয়ার কাগজপত্রও সংরক্ষণ করেছেন। বাঁশি তৈরির কাঁচামাল : মোজাফ্ফরের কাছ থেকে জানা গেছে, বাঁশি তৈরির জন্য মলি বাঁশ প্রধান উপকরণ। প্রথম দিকে এলাকা থেকে বাঁশ সংগ্রহ করে তিনি বাঁশি তৈরি শুরু করেন। কিন্তু এলাকায় মলি বাঁশের উৎপাদন কম হওয়ায় সংকটে পড়েন। ২০০০ সালে গ্রাহকদের কাছ থেকে মলি বাঁশের খবর পান। তারপর চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকা থেকে মলি বাঁশ সংগ্রহ করেন। বছরের সেপ্টেম্বর ও মার্চে চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকা থেকে মলি বাঁশ সংগ্রহ করেন। দুবারে ৬ হাজার বাঁশ সংগ্রহ করতে হয়। চিকন বাঁশ ৩৫ ও মোটা বাঁশ ৫৫ টাকায় কেনেন। একটি বাঁশে সর্বোচ্চ চারটি বাঁশি হয়। ফাটা, আঁকাবাঁকা ও পোকা খাওয়া বাঁশ বাছাইয়ে বাদ পড়ে। যে কারণে বাঁশি তৈরিতে আগ্রহ : মোজাফ্ফর মণ্ডল বলেন, ১৯৬৯ সালের দিকে তিনি নেশা থেকে বাঁশি বাজাতেন। বন্ধুবান্ধব ও প্রতিবেশীরা তাকে বাঁশি বানানোর অনুরোধ করতেন। গ্রামের মলি বাঁশ দিয়ে কোনোরকম বিনিময় ছাড়াই বাঁশি তৈরি করে দিতেন। তার বাঁশি এলাকার বাঁশি শিল্পীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। দিন দিন দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে বাঁশি তৈরির অনুরোধ আসে। প্রথম দিকে ২০-৫০ টাকায় একটি বাঁশি তৈরি করে দিতেন। ১৯৭১ সালের দিকে তিনি ব্যবসায়িক লক্ষ্যে বাঁশি তৈরি ও বাজারজাত শুরু করেন। সুরের স্কেল : মোজাফ্ফর বলেন, একটি বাঁশে সুরের স্কেলে তার ধারণক্ষমতা কত একজন কারিগরকে তা বুঝতে হবে। বাঁশের কাটা পাইপগুলো কোনটি কত স্কেলের তা বুঝে একটি সেট করতে হবে। তারপর হাওয়াই চুলায় লোহার রড গরম করে ছিদ্র করতে হবে। একটি বাঁশিতে ৭টি ছিদ্র করা হয়। যেখান দিয়ে ফুঁ দেওয়া হয় সে ছিদ্রটিকে তিনি ব্যালেন্সিং ছিদ্র বলেন। বাকি ছিদ্রগুলো সুরের স্কেলের স্বরবর্ণ। ছিদ্র তৈরির পর একেকটি পাইপ বার্নিশ করা হয়। এরপর হারমোনিয়াম ও মেশিনের সাহায্যে টিউনিং করে বাঁশি বাজানোর উপযোগী করা হয়। সব শেষে বাঁশি প্যাকেটজাত করা হয়। তৈরির প্রক্রিয়া : সংগৃহীত বাঁশ প্রথমে রোদে ও পরে ছায়ায় শুকিয়ে নিতে হয়। বাঁশ শুকাতে সময় লাগে কমপক্ষে দুই মাস। শুকনো বাঁশ কেটে ভিন্ন ভিন্ন ২৬ প্রকারের সাইজ করতে হয়। প্রতি সেটে ২৬টি বাঁশি থাকে। বিক্রি : এক সেট বাঁশি মানভেদে ৫ থেকে ৭ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে শিল্পীরা তার বাড়িতে এসে বাঁশি ক্রয় করেন। শিল্পীরাই তার বাঁশির মূল ক্রেতা। তাদের কাছেই খুচরা এবং পাইকারি দরে বাঁশি বিক্রি করা হয়। ক্রেতার ভাষ্য : বগুড়া জেলার মধ্য চেলোপাড়া এলাকার সুর-তরঙ্গ স্টোরের রমেশ দাস জানান, মোজাফ্ফরের কাছে তিনি বছরে কমপক্ষে পাঁচ সেট বাঁশির অর্ডার দেন। তিনি এভাবে ১০ বছর ধরে বাঁশি সংগ্রহ করছেন। কুড়িগ্রাম জেলার ঘোষপাড়া রোড এলাকার সুমন মিউজিক্যাল হাউসের জহুরুল হক বলেন, মোজাফ্ফরের কাছ থেকে তিনি বছরে দেড় থেকে ২০০ বাঁশি সংগ্রহ করেন। তিন বছর ধরে মোজাফ্ফর তাকে বাঁশি সরবরাহ করছেন। রংপুর জেলার নিউক্রস রোডের সপ্তসুর স্টোরের মালিক জয়ন্ত সরকার জানান, বছরে তিনি মোজাফ্ফরের কাছ থেকে ২০০ বাঁশি সংগ্রহ করেন। তার এলাকায় মোজাফ্ফরের বাঁশির খুব চাহিদা। রপ্তানি : ২০১৩ সালের মার্চে তিউনিসিয়ায় ১ লাখ ৯০ হাজার বাঁশি রপ্তানি করেন মোজাফ্ফর। এ ছাড়া চাহিদা অনুযায়ী সিঙ্গাপুর, ফ্রান্স, ভারত, পাকিস্তান ও অস্ট্রেলিয়ায় বাঁশি রপ্তানি করেন। সহযোগী কারিগর : মোজাফ্ফর জানান, তার প্রধান সহযোগী স্ত্রী সলিমন নেছা। বাঁশি তৈরির সব কৌশল তার জানা। সলিমন নেছা জানান, বিয়ের পর থেকেই স্বামীকে সহযোগিতা করতে গিয়ে বাঁশি তৈরি শিখেছেন। বাঁশির তৈরিতে আরও চার কারিগর শাহজাহান শেখ, রায়হান বেপারি, শান্ত বেপারি ও রুহুল বেপারি কাজ করেন। মোজাফ্ফরের দাম্পত্য জীবন : দাম্পত্য জীবনে তাদের দুই ছেলে ও দুই কন্যা সন্তান রয়েছে। বাঁশি তৈরি করেই তিনি জীবিকা নির্বাহ করেন। সন্তানদের বিয়ে দিয়েছেন। বাড়ি করেছেন। বেশ সুখেই আছেন তিনি।

সর্বশেষ খবর