শুক্রবার, ২৯ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে বন্যা পরিস্থিতি

প্রতিদিন ডুবছে নতুন নতুন এলাকা ► পানি আরও বেড়েছে পদ্মা-যমুনার

প্রতিদিন ডেস্ক

ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে বন্যা পরিস্থিতি

বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইছে জামালপুরের যমুনা নদীর পানি। ঝুঁকির মধ্যে মহাসড়ক —বাংলাদেশ প্রতিদিন

দেশের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি অব্যাহত রয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় তিস্তার পানি কমলেও পদ্মা ও যমুনার পানি আরও বেড়েছে। ফলে নতুন নতুন অনেক এলাকা ডুবে গেছে। সেই সঙ্গে পানিবন্দী মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর—

জামালপুর : বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে ২৮ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে যমুনার পানি। ২৪ ঘণ্টায় পানি ১৬ সেন্টিমিটার বেড়ে গতকাল সকালে বিপদসীমার ১১৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে। ১৯৮৮ সালের  বন্যায় বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে যমুনার পানি বিপদসীমার ১১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল। এই পয়েন্টে সেটাই ছিল সর্বোচ্চ রেকর্ড।

অব্যাহত পানি বৃদ্ধির ফলে পানি ঢুকেছে নতুন নতুন গ্রামে। জেলার ৭ উপজেলার মধ্যে ৬টিই এখন বন্যাকবলিত। দেওয়ানগঞ্জ, ইসলামপুর, মেলান্দহ, মাদারগঞ্জ, সরিষাবাড়ী ও বকশীগঞ্জ উপজেলার ৪০টি ইউনিয়নের প্রায় আড়াই লাখ মানুষ এখন পানিবন্দী অবস্থায় আছে। দুর্গত এলাকায় বিশুদ্ধ পানি, খাবার, গোখাদ্যের সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। ছড়িয়ে পড়ছে পানিবাহিত রোগ। গতকাল সন্ধ্যায় ইসলামপুরের গামারিয়া এলাকায় বন্যার পানিতে পড়ে সোলায়মান নামে ৮ বছরের এক শিশু মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। মাদারগঞ্জ (জামালপুর) : যমুনার পানি বিপদসীমার ১১৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মাদারগঞ্জ যমুনা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। এলাকাবাসী স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে বাঁধ রক্ষার চেষ্টা করছে। গত দুই দিনে পৌরসভাসহ ৭টি ইউনিয়নের ৮০ ভাগ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ৩৪টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। উপজেলার বিভিন্ন সড়ক পানিতে ডুবে ও ভেঙে সদরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। নীলফামারী : তিস্তার পানি কমায় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। বর্তমানে তিস্তার পানি নীলফামারীর ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ৩০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে চরগ্রামগুলোতে পানি কিছুটা কমলেও এখনো পানিবন্দী রয়েছে প্রায় ২০ হাজার মানুষ।

গাইবান্ধা : ঘাঘট ও ব্রহ্মপুত্রে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় গাইবান্ধায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় ঘাঘট নদের পানি ১৮ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৮৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে এবং ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ২০ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৮০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সাঘাটার ভরতখালীতে সোনাইল বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় সাঘাটার ২০টি গ্রাম নতুনভাবে বন্যাকবলিত হয়েছে। মাছ ধরতে গিয়ে সাঘাটা উপজেলার বাঁশহাটা গ্রামের নুুরুন্নবী মিয়া (৩৫) বন্যার পানিতে ডুবে মারা গেছেন। সুন্দরগঞ্জ : গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে বন্যাদুর্গত মানুষের মাঝে দেখা দিয়েছে গোখাদ্য, ওষুধ ও বিশুদ্ধ পানীয় জলের সংকট। দুর্গত এলাকাগুলো হচ্ছে তারাপুর, বেলকা, হরিপুর, কাপাসিয়া, কঞ্চিবাড়ী ও শ্রীপুর। এসব এলাকায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় চরম দুর্ভোগে জীবনযাপন করছে। বন্যা আশ্রয় কেন্দ্রগুলোয় দুর্গতরা আশ্রয় নিলেও তাদের মাঝে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ বিরাজ করছে। রাজবাড়ী : গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া পয়েন্টে গত ২৪ ঘণ্টায় পদ্মার পানি ১৭ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ৬০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে গোয়ালন্দ উপজেলার কয়েকটি গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। নদীতে তীব্র স্রোতের কারণে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে ব্যাহত হচ্ছে ফেরি চলাচল। এর সঙ্গে ফেরি সংকট ও একটি ঘাট বন্ধ থাকায় দৌলতদিয়ায় নদী পারাপারের অপেক্ষায় আটকা পড়েছে কয়েকশ যানবাহন। দৌলতদিয়া জিরো পয়েন্ট থেকে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত ৪ কিলোমিটার জুড়ে আটকা পড়েছে ৬ শতাধিক যানবাহন। এর মধ্যে যাত্রীবাহী বাসের সংখ্যাই বেশি। শরীয়তপুর : শরীয়তপুরের সুরেশ্বর পয়েন্টে পদ্মার পানি বিপদসীমার ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সদর, নড়িয়া, জাজিরা ও ভেদরগঞ্জ উপজেলার ১৮টি ইউনিয়নের বেশির ভাগ (শতাধিক) গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এসব ইউনিয়নের বেশির ভাগ রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বেশ কিছু হাটবাজারে পানি ঢুকে পড়েছে। পদ্মার পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে স্রোত বৃদ্ধি পাওয়ায় পালের চর, বড়কান্দি, ঘরিসার ও কেদারপুর ইউনিয়নে ভাঙনের কারণে বিলীন হচ্ছে একের পর এক সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা। পীরগঞ্জ (ঠাকুরগাঁও) : ভাঙনের মুখে পড়েছে টাঙ্গন নদপাড়ের ৫০০ একরের থুমনিয়া ও ২০০ একরের সাগুনী শালবন। সরেজমিনে দেখা যায়, সাগুনী শালবনের দক্ষিণাংশে ও থুমনিয়া শালবনের উত্তর-পশ্চিমাংশে ফাটল দেখা দিয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা ইউসুফ আলী বলেন, ভাঙন রোধে শিগগিরই ব্যবস্থা না নিলে শালবনটির গাছপালা ও জায়গা একসময় টাঙ্গন নদে বিলীন হয়ে যাবে। লালমনিরহাট : প্রবল বন্যার কারণে মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে সীমান্তবর্তী অনেক ভারতীয় বাংলাদেশ অভ্যন্তরে চলে আসছেন। গতকাল সরেজমিন সদর উপজেলার মোঘলহাট ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী গ্রাম চওড়াটারীতে গিয়ে দেখা যায়, বাংলাদেশিদের ঘরবাড়িতে আশ্রয় নিয়ে আছে ভারতের শত শত পুরুষ-মহিলা। তাদের সঙ্গে শিশু সন্তানসহ গবাদিপশুও রয়েছে। ভারতীয় নাগরিকরা জানান, মঙ্গলবার মধ্যরাতে তাদের জারিধরলা নদী উত্তাল হয়ে ওঠে। এ সময় অনেক গবাদিপশু পানিতে ভেসে যায়। তখন তারা জীবন বাঁচাতে ভেলা ও নৌকায় করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এসে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। ভারতের কোচবিহার জেলার জারিধরলা গ্রামের আবদুর রহিমের বৃদ্ধা স্ত্রী ফিরোজা বেগম এই প্রতিনিধিকে বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ আশ্রয় না দিলে পানিতে মরে ভেসে যেতে হতো।’ বৃদ্ধ আবদুর রহিম বলেন, ‘সীমান্তবর্তী চারটি ভারতীয় গ্রাম জারিধরলা, দরিবোস, বাদুড়কুটি ও নগড়টারী গ্রামের প্রায় ৩ হাজার মানুষ বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। বাংলাদেশের মানুষের সহযোগিতার কারণেই সবাই সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে বেঁচে আছেন।’ মোঘলহাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান জানান, বন্যায় নাকাল হয়ে অনেক ভারতীয় মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে তার ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় আশ্রয় নিয়েছেন। সিরাজগঞ্জ : যমুনার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ৭০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। কাঁচা-পাকা রাস্তাঘাট, হাট-বাজার তলিয়ে যাওয়ায় মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। বন্যা কবলিত মানুষেরা নৌকা ও ভেলা ছাড়া ঘর হতে বের হতে পারছেন না। কিছু কিছু পরিবার ওয়াপদা বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। কিছু এলাকায় সরকারি ত্রাণ পৌঁছালেও অধিকাংশ স্থানে কিছুই পৌঁছেনি। এ অবস্থায় পানিবন্দি মানুষেরা চরম দুরাবস্থার মধ্যে জীবনযাপন করছেন।

লালমনিরহাটে আশ্রয় নিয়েছেন তিন হাজার ভারতীয় : ভারতে প্রবল বন্যার কবলে পড়ে ভারতের তিন হাজারের বেশি নাগরিক সীমান্ত পেরিয়ে লালমনিরহাটে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। দিশাহারা এই মানুষগুলো জীবন বাঁচাতে মঙ্গলবার মধ্যরাতে আসা শুরু করেন।

গতকাল সরেজমিনে সদর উপজেলার মোঘলহাট ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী গ্রাম চওড়াটারীতে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে বাংলাদেশিদের ঘরবাড়িতে আশ্রয় নিয়ে আছেন ভারতীয় শত শত পুরুষ ও মহিলা। তাদের সঙ্গে শিশু সন্তানসহ গবাদিপশুও রয়েছে। এই ভারতীয়দের অনেকেই জানান, মঙ্গলবার মধ্যরাতে তাদের জারিধরলা নদী উত্তাল হয়ে ওঠে। এ সময় অনেক গবাদিপশু পানিতে ভেসে যায়। তখন জীবন বাঁচাতে তারা কোনো কিছু না ভেবে ভেলা ও নৌকায় করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এসে আশ্রয় নেন। সেই রাতে অনেককেই স্থানীয় মোঘলহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে থাকার ব্যবস্থা করা হয়। সেখানে স্থানসংকুলান না হওয়ায় স্থানীয়রা তাদের বাড়িতে তাদের আশ্রয় দিয়েছেন। ভারতের কোচবিহার জেলার জারিধরলা গ্রামের আবদুর রহিমের বৃদ্ধা স্ত্রী ফিরোজা বেগম এই প্রতিনিধিকে জানান, বাংলাদেশের মানুষ তাদের আশ্রয় না দিলে তারা পানিতে মরে ভেসে যেতেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের যারা আশ্রয় দিয়েছেন তারাও গরিব মানুষ। কিন্তু অনেক কষ্ট হলেও তারা আমাদের তিন বেলা খাবার খেতে দিচ্ছেন।’ এক বৃদ্ধ আবদুর রহিম বলেন, সীমান্তবর্তী চারটি ভারতীয় গ্রাম জারিধরলা, দরিবোস, বাদুড়কুটি ও নগড়টারী গ্রামের ৩ হাজারের বেশি মানুষ বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষের সহযোগিতার কারণেই আজ আমরা সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে বেঁচে আছি।’

মোঘলহাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান জানান, বন্যায় নাকাল হয়ে অনেক ভারতীয় মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে তার ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় আশ্রয় নিয়ে আছেন।

সর্বশেষ খবর