শুক্রবার, ২৯ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা
প্রকৃতি

অস্তিত্ব সংকটে সুন্দরবনের বাঘ

মোস্তফা কাজল

অস্তিত্ব সংকটে সুন্দরবনের বাঘ

অস্তিত্ব সংকটে সুন্দরবনের বাঘ। এ বনের বাঘের স্বাভাবিক জীবনচক্রের জন্য যে স্বাদু পানি, শিকার ও গহিন জঙ্গল ছাড়াও নিরুপদ্রব প্রজনন ব্যবস্থা থাকা দরকার তার কোনোটিই যথেষ্ট নয়।

এসব কারণে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে না। নতুন করে যুক্ত হয়েছে বাঘের শাবক পাচার, পিটিয়ে ও গুলি করে বাঘ হত্যার ঘটনা। কয়েক বছর আগে সাতক্ষীরার বন থেকে চুরি করা তিনটি ব্যাঘ্র শাবক ঢাকায় ধরা পড়ার পর নিশ্চিত হওয়া গেছে, একটি পাচার চক্র শুধু বয়সী বাঘ হত্যা করে চামড়া বিক্রি করে থাকে তাই নয়। তারা শাবকও দেশে-বিদেশে পাচার করে আসছে। বাঘ বাঁচাতেই বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১৩টি দেশ একসঙ্গে প্রতি বছর ২৯ এপ্রিল বিশ্ব বাঘ দিবস পালন করে থাকে। এবার দিনটি ছুটির দিন হওয়ায় ২ আগস্ট পালন করা হবে এ দিবসের কার্যক্রম। প্রধান বন সংরক্ষক মো. ইউনুস আলী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাঘ সুন্দরবনের অমূল্য সম্পদ। এ সম্পদকে রক্ষা করতে বনের অর্ধেক এলাকাকে শিগগির অভয়ারণ্য ঘোষণা করার প্রক্রিয়া চলছে। অভয়ারণ্য ঘোষণার পর ওই এলাকায় পর্যটকসহ সবার প্রবেশের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আসছে। এ ছাড়া বাঘ রক্ষায় সুন্দরবনের জন্য স্বতন্ত্র ফোর্স গঠনের পাশাপাশি টহল কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। বাঘ বিশেষজ্ঞ ড. আবদুল ওয়াদুদ বলেন, সুন্দরবনে বাঘের জীবনচক্র স্বাভাবিক থাকলে এর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। কিন্তু সর্বশেষ ২০১৫ সালের বাঘশুমারিতেও এর সংখ্যা ১০৬ এর বেশি পাওয়া যায়নি। এর আগে দফায় দফায় সংখ্যা কমবেশি হলেও বাঘের সংখ্যা বাড়ছে না। এ জন্য ক্যাপটিভ বাঘ শাবক লালন-পালনের ওপর জোর দেন তিনি। বাঘ বিশেষজ্ঞ ও উপ-প্রধান বন সংরক্ষক ড. তপন কুমার দে বলেন, সুন্দরবনে পুরুষ বাঘের সংখ্যা বেশি হলেও বাঘিনীর সংখ্যা কম। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর বাঘিনী একবারে দুই থেকে চারটি বাচ্চা দেয়। একেকটি বাঘিনী সচরাচর দুবার বাচ্চা ধারণ করে থাকে। এর স্বাভাবিক প্রজনন প্রক্রিয়া ও নিরুপদ্রব আবাসন নিশ্চিত করা গেলে বাঘের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেতে পারত। সুন্দরবনের ভারতীয় এলাকায় নিরাপদ প্রজনন ব্যবস্থা থাকায় সেখানে বাঘের সংখ্যা বাড়ছে। জানা গেছে, বাঘিনী বাচ্চা দেওয়ার পর শাবকের ওপর নজর পড়ে বাঘের। যে কোনোভাবে বাচ্চাগুলো খেয়ে ফেলার জন্য সবসময়ই তত্পর থাকে বাঘ। জানা যায়, জন্ম দেওয়ার পর থেকে বাঘিনী শিকার ধরা ছাড়াও স্বাভাবিক চলাফেরা সম্পূর্ণ বন্ধ করে বাচ্চাগুলোকে নিয়ে নিরাপদ জায়গায় লুকিয়ে থাকে। এ সময় বাঘিনী চারদিকে নির্ঘুম দৃষ্টি রাখে। বাচ্চাগুলো চলাফেরার যোগ্য হয়ে ওঠা পর্যন্ত এ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করে বাঘিনী। তবে সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জ থেকে তিনটি ব্যাঘ্র শাবক কীভাবে পাচারকারীরা অপহরণ করেছিল তা ভাবিয়ে তুলেছে সবাইকে। এ ছাড়াও মিষ্টি পানির অভাবে সুন্দরবনের নদ-নদীর লবণাক্ত পানি খেয়ে বাঘ আক্রান্ত হচ্ছে জন্ডিস ও লিভার সিরোসিসসহ নানা রোগে। এ কারণে অসুস্থ ও দুর্বল হয়ে পড়া বাঘ-বাঘিনী আহার হিসেবে মানুষের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছে। এ কারণে লোকালয়ে এসে তারা মারাও পড়ছে। এ কারণেও বাঘের সংখ্যা ক্রমে হ্রাস পাচ্ছে। বন বিভাগের দেওয়া তথ্যমতে, ২০০০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সুন্দরবন অঞ্চলে ৩৯টি বাঘ হত্যার ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া আটক হয় চারটি। বাঘ নিয়ে গবেষণাকারীরা বলেন, সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য বদলে যাওয়ায় বাঘের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ছে। পরিবর্তিত পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ এলাকার সুন্দরবনের বাঘ স্থান পরিবর্তন করে থাকে। বনে গভীর জঙ্গল না থাকায় বাঘ তার নিরাপদ আবাসন হারিয়েছে। বিশ্লেষকরা বলেন, বাঘ সচরাচর নিঃশব্দ এলাকা পছন্দ করে। অথচ সুন্দরবনে নানা ধরনের শব্দ বিশেষ করে পটকাবাজি এবং মানুষের পদচারণা বাঘের জীবনকে বিপন্ন করে তোলে। এ ছাড়া ১৯৮৮-এর ঘূর্ণিঝড়, ২০০৭-এর সিডর ও ২০০৯-এর আইলার মতো প্রলয়ঙ্করী দুর্যোগের মুহূর্তেও জীবন হয়ে পড়েছিল বিপন্ন। এ সময় অনেক বাঘের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। বাঘের শিকার হিসেবে বনে যে শূকর দরকার, তা যথেষ্ট নয়। অপরদিকে বয়সী বাঘের পক্ষে দ্রুতগতির হরিণ ধরা খুবই কঠিন। মিষ্টিপানি আর শিকারের সন্ধানে বাঘ লোকালয়ে চলে আসে। লোকালয়ে আসার পর তার পরিণতি হয় নিশ্চিত গণপিটুনি অথবা গুলিতে মৃত্যু। নানা কারণে বাঘ দৈহিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ায় প্রজনন ক্ষমতাও হারাচ্ছে।

সর্বশেষ খবর