রবিবার, ৩১ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

ভ্যাট ফাঁকিতে বেপরোয়া ছয় লাখ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান

রুহুল আমিন রাসেল

সারা দেশে ভ্যাট ফাঁকিতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে প্রায় ৬ লাখ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। তাদের ধরতে অসহায় হয়ে পড়েছে ভ্যাট গোয়েন্দা। প্রতিষ্ঠানটিতে নেই দক্ষ জনবল। কাঠামোতে ১৩২ জনবল থাকলেও বাস্তবে আছে অর্ধেকের কম। সে কারণে রাজধানীতে সীমাবদ্ধ অভিযানে সরব হলেও, ঢাকার বাইরে সারা দেশে নিষ্ক্রিয় ভ্যাট গোয়েন্দারা। ফলে জনগণের দেওয়া ভ্যাট লুটেপুটে খাচ্ছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। তাতে রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। তাই রাজস্ব ফাঁকি বন্ধে সারা দেশে নিয়মিত অভিযান চালাতে ১ হাজার ৩৬০ জনবল কাঠামোর ১৩টি আঞ্চলিক কার্যালয় গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদফতর।

সেবা খাতে ভ্যাট ফাঁকির প্রবণতা অনেক বেশি উল্লেখ করে এই প্রস্তাবে বলা হয়, ভ্যাট গোয়েন্দার বেশির ভাগ অভিযান ঢাকাকেন্দ্রিক। ফলে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের প্রতিষ্ঠান থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। শুধু ঢাকার একটি কার্যালয়ের মাধ্যমে সারা দেশে অভিযান পরিচালনা সম্ভব নয়। যদিও ভ্যাট গোয়েন্দার অধিক্ষেত্র সমগ্র বাংলাদেশ। কিন্তু সে তুলনায় জনবল ও অবকাঠামোগত ব্যবস্থা অপ্রতুল। এই বিশাল পরিসরে কাজ করার জন্য প্রয়োজন দক্ষ জনবল ও অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আঞ্চলিক কার্যালয় স্থাপন। এমন প্রেক্ষাপটে দেশের কর রাজস্ব আদায়ে নিয়োজিত সরকারি প্রতিষ্ঠান ‘জাতীয় রাজস্ব বোর্ড’—এনবিআরে গত ১০ জুলাই ওই প্রস্তাব প্রেরণ করেছে ‘মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর’। পরে আরেক পত্রে ১৯ জুলাই সারা দেশে ১৩টি আঞ্চলিক কার্যালয় গঠনে ভ্যাট গোয়েন্দার প্রস্তাবের ওপর প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে রাজস্ব প্রশাসনের বিভিন্ন দফতরের মতামত চেয়েছে এনবিআর।

এ প্রসঙ্গে ভ্যাট নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দেশে কমবেশি সবাই চেষ্টা করে ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করার। আমরাও চেষ্টা করি সুশাসন নিশ্চিত করার। কিন্তু লোকবলের অভাবে অনেক সময় তা পারছি না। লোকবল থাকলে সারা দেশে কাজ করা যেত।’ তিনি বলেন, ‘কাঠামোতে ১৩২ জন থাকলেও বাস্তবে নেই অর্ধেকও। কিন্তু ১৩২ জন প্রয়োজনের তুলনায় কিছুই না। লোকবল আর গাড়ি না থাকলে কীভাবে অভিযান চালাব।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখন প্রয়োজন নিয়মিত তদারকি। নইলে আগের পরিস্থিতিতে ফিরে যাবে। জনবল চেয়ে প্রস্তাব এনবিআরে পাঠিয়েছি। দেখা যাক কী হয়। তবে এখন যা আছে, তা দিয়েই কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।’ ভ্যাট নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক মাসুদুল কবির স্বাক্ষরিত ওই প্রস্তাবে আরও বলা হয় : নতুন ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২-এর আলোকে ভ্যাট গোয়েন্দার প্রস্তাবিত অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী পদের সংখ্যা ১ হাজার ৩৬০। নতুন ভ্যাট আইন অডিটনির্ভর। তাই ভ্যাট গোয়েন্দার অধিক্ষেত্র ও কর্মপরিধি বিবেচনায় বর্তমানের জনবল কাঠামো অত্যন্ত কম এবং দুর্বল। এই দফতরের একটি মাত্র কার্যালয় আছে ঢাকায়। কোনো আঞ্চলিক কার্যালয় নেই। কাঠামোতে ১৩২ জনবল থাকার বিপরীতে পদস্থ আছেন মাত্র ৬০ জন। এই অপ্রতুল ও দুর্বল জনবল কাঠামো দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা সম্ভব নয়। কাজেই নিরীক্ষা গোয়েন্দা ও তদন্ত তত্পরতা বাড়ানোর লক্ষ্যে এবং রাজস্ব ফাঁকি ও অনিয়ম বন্ধে এই দফতরের সাংগঠনিক কাঠামো এবং আঞ্চলিক কার্যালয় স্থাপন অত্যন্ত জরুরি। এতে সরকারের রাজস্ব বহুলাংশে বাড়বে।

ভ্যাট গোয়েন্দা বলেছে, ঢাকাস্থ কার্যালয়ের এত কম জনবল ও অপ্রতুল লজিস্টিক সাপোর্ট (কারিগরি সহায়তা) নিয়ে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা ও নিরীক্ষা কার্যক্রম গ্রহণ করা প্রায় অসম্ভব। অনেক ক্ষেত্রে একটি প্রতিষ্ঠানে অভিযানের পরপরই যে নিরীক্ষার প্রয়োজন দেখা দেয়, তা বিশাল কর্মযজ্ঞ এবং তাতে একাধিক কর্মকর্তা যুক্ত করতে হয়।

সংস্থাটির ওই প্রস্তাবে আরও বলা হয়, বর্তমানে সারা দেশে ভ্যাট নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ ৭০ হাজার হলেও নিয়মিত দাখিল পত্র পেশকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ৪১ হাজার। তাই রাজস্ব ফাঁকি রোধ ও নিরীক্ষার মাধ্যমে অনিয়ম থামাতে আঞ্চলিক কার্যালয় স্থাপনের বিকল্প নেই। বিগত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অভিযান পরিচালনার ফলে ৩৭ শতাংশ থেকে বেড়ে রাজস্ব পৌঁছেছে ৩২৫ শতাংশে। এমন প্রেক্ষাপটে সারা দেশে বিস্তৃত আকারে অডিট, গোয়েন্দা ও তদন্ত কার্যক্রম বাড়াতে ভ্যাট গোয়েন্দার ঢাকা (উত্তর, পূর্ব, দক্ষিণ ও পশ্চিম), চট্টগ্রাম, খুলনা, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, বরিশাল, রংপুর, সিলেট, যশোর ও কুমিল্লায় আঞ্চলিক কার্যালয় স্থাপন জরুরি। জানা গেছে, সারা দেশে ২৫ লাখ দোকান থাকলেও ভ্যাট দেন মাত্র ৬০ হাজার দোকান মালিক। বাকিরা বরাবরই ফাঁকি দিয়ে আসছেন। এনবিআর হিসাবযন্ত্রে পণ্য বিক্রি বা ভ্যাট আদায়ে তেমন সাড়া দেননি দোকান মালিকরা। বরং ভ্যাট আদায়ে ব্যবসায়ীরা রাজস্ব প্রশাসনকে অসহযোগিতা করছেন।

তথ্যমতে, দোকান বা বিক্রয়প্রতিষ্ঠানে পণ্য বিক্রিতে হিসাবযন্ত্র হিসেবে ইসিআর ও পিওএস ব্যবহার করা হয়। এ দুই যন্ত্রের মাধ্যমে দোকানে প্রতিদিন কত টাকা বিক্রি ও কত টাকা ভ্যাট আদায় করা হয়েছে, তার হিসাব রাখা হয়। কিন্তু দেশের অধিকাংশ দোকান মালিকই তাদের প্রতিষ্ঠানে হিসাবযন্ত্রের ব্যবহার করেন না। কেউ কেউ ব্যবহার করলেও, ভ্যাট ফাঁকি দিতে গিয়ে রাজস্ব প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কখনো কখনো বলেন তার ইসিআর মেশিনটি নষ্ট। ফলে ২০০৯ সালে ১১টি খাতে ইসিআর ও পিওএস ব্যবহার চালু করা হলেও তাতে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আসছেন দোকান মালিকরা। দোকান মালিকদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির তথ্যমতে, সারা দেশে বিভিন্ন মার্কেট ও শপিং মল পর্যায়ে ২৫ লাখ দোকান আছে। এর মধ্যে ৮ লাখ ৫৮টি দোকানের ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন বা ভ্যাট নিবন্ধন নম্বর আছে। নিবন্ধিত সব দোকানের মধ্যে ৩ লাখ নিয়মিত ভ্যাট পরিশোধ করে। তবে দোকান মালিক সমিতির এ তথ্যের সত্যতা নেই বলে এনবিআর সূত্রে জানা গেছে। দেশে মাত্র ৬০ হাজার প্রতিষ্ঠান মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) দেয় জানিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গত বছর ভ্যাট দিবসের অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, বর্তমানে যারা মূসক দেওয়ার উপযুক্ত, তারা এর ধারেকাছেও আসেন না। অথচ ৩-৪ লাখ প্রতিষ্ঠান এখন মূসক দিতে সক্ষম। কিন্তু এরা মূসক দেয় না।

সর্বশেষ খবর