শুক্রবার, ৫ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

বেহাল গুলশান বনানী উত্তরা

অরক্ষিত আবাসিক এলাকা, বেআইনি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ছড়াছড়ি

নিজস্ব প্রতিবেদক

বেহাল গুলশান বনানী উত্তরা

রাজধানীর গুলশান, বনানী থেকে উত্তরা মডেল টাউন পর্যন্ত এলাকার ‘আবাসিক চেহারা’ হারিয়ে যাচ্ছে। ধানমন্ডি আর নিকুঞ্জ আবাসিক এলাকাও এখন পরিণত হয়েছে পুরোপুরি বাণিজ্যিক এলাকায়। সেখানে কোনটা আবাসিক আর কোনটা বাণিজ্যিক বা শিল্প এলাকা, তা বুঝে ওঠা কঠিন হয়ে পড়েছে। আবাসিক ভবনেরই নিচতলা কারখানা কিংবা ওয়ার্কশপ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। দোতলা, তিনতলা ও চারতলাকে বানানো হয়েছে মার্কেট। এরও ওপরের তলাসমূহ ব্যবহূত হচ্ছে আবাসিক ফ্ল্যাট হিসেবে। একই স্থানে শিল্প-বাণিজ্য-আবাসিকের সহাবস্থান চলছে। সব মিলিয়ে সৃষ্টি হয়েছে অস্বস্তিকর পরিবেশ।

গুলশানে রয়েছে অর্ধশতাধিক স্কুল ও কলেজ, অন্তত দেড় ডজন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রায় ২০টি ব্যাংক, শপিং মল, কমিউনিটি সেন্টার, শতাধিক ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিক। এ ছাড়া চাইনিজ ও ফাস্টফুডের দোকান, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ও অন্যান্য দোকান অসংখ্য। সব মিলিয়ে গুলশান আরও কয়েক বছর আগেই পুরোপুরি বাণিজ্যিক এলাকায় পরিণত হয়েছে। বাণিজ্যিক এলাকার যাবতীয় ধকল সহ্য করেই বসবাস করতে হচ্ছে বাসিন্দাদের। অবিরাম হইচই, রাস্তাজুড়ে পার্কিং, গভীর রাত পর্যন্ত বিপুল মানুষের আনাগোনা মিলিয়ে বিশ্রী বেহাল দশার সৃষ্টি হয়েছে গুলশান-বনানী জুড়ে। জানা গেছে, বিভিন্ন সময় রাজউক থেকে আবাসিক ভবন নির্মাণের নামে প্লট বরাদ্দ নিয়ে সংশ্লিষ্টরা অনাবাসিক ও বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করে আসছেন। বরাদ্দের চুক্তিপত্র লঙ্ঘন করে আবাসিক প্লটে কেউ কেউ শিল্প-কারখানা গড়ে তোলেন। চুক্তিভঙ্গের অভিযোগে রাজউক দফায় দফায় প্লট মালিকদের নোটিস দিয়েছে। বাণিজ্যিক স্থাপনাসমূহ ভেঙে ফেলার জন্য পাঠানো হয়েছে চরমপত্র। ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার অবস্থা আরও শোচনীয়। সেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকের এত বেশি ছড়াছড়ি যে অলিগলি সর্বত্র যানবাহন ভিড়ে আটকে থাকে। ভোর থেকে শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত সীমাহীন ভিড়ে বেসামাল হয়ে পড়ে ধানমন্ডি। রাজউক সূত্র জানায়, সেখানে চূড়ান্ত নোটিসের পর ২০ জন প্লটমালিক তাদের অবৈধ স্থাপনা ভেঙে ফেলতে বাধ্য হন এবং বাণিজ্যিক ব্যবহার বন্ধ করেন। কিন্তু বেশির ভাগ প্লটমালিক রাজউকের চরমপত্রকে তোয়াক্কা করেননি। অন্যদিকে গুলশান-বনানীর প্লটমালিকদের উদ্দেশে রাজউক অভিনব প্রস্তাবপত্র পাঠিয়ে বলেছে, গুলশান-বনানী আবাসিক এলাকায় শুটিং ক্লাব, গুলশান-২ নম্বর গোলচত্বর, বনানীর কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ, গুলশান-বনানী ব্রিজ থেকে বারিধারা ব্রিজ পর্যন্ত উভয় পাশের প্রথম প্লটসমূহ কাঠাপ্রতি আট লাখ টাকা জমা দিয়ে ‘বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের’ জন্য অনুমোদনের সুযোগ রয়েছে। এয়ারপোর্ট রোডের উভয় পাশের প্লটগুলো বাণিজ্যিকভাবে রূপান্তরের জন্য কাঠাপ্রতি ফি ধরা হয়েছে চার লাখ টাকা। ফি জমার পরও এসব এলাকায় আটতলার বেশি উঁচু ভবন নির্মাণ করা যাবে না বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। চূড়ান্ত নোটিসে দুই মাস সময়সীমার মধ্যে অননুমোদিত ভবনসমূহ ভেঙে ফেলা ও বাণিজ্যিক ব্যবহার বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়। অন্যথায় অবৈধভাবে নির্মিত ভবনসমূহ ভেঙে প্লট বরাদ্দ বাতিল করার ঘোষণা দেয় রাজউক। কিন্তু এরপর পেরিয়ে গেছে আট বছর। রাজউকের এসব হুমকি, নোটিস, ঘোষণাকে মোটেও পাত্তা দেননি প্লটমালিকরা। বরং বনানী থেকে উত্তরা পর্যন্ত আবাসিক ভবন অবৈধ বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের বিস্তৃতি ঘটেছে। এ ক্ষেত্রে রাজউকের নোটিস-নির্দেশের বিরুদ্ধে একাধিক প্লটমালিক মামলার আশ্রয় নিয়েছেন। কেউ কেউ আবার আবেদন-নিবেদনের মাধ্যমে সময়ক্ষেপণ করছেন। এ সুযোগে অননুমোদিত ভবন নির্মাণকারী প্লটমালিকদের সঙ্গে এস্টেট বিভাগের কতিপয় কর্মকর্তার গোপন যোগসাজশ গড়ে ওঠায় আট বছরেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বরং একের পর এক আবাসিক ভবন পরিণত হয়েছে বাণিজ্যিক ভবনে।

পুরোপুরিই বাণিজ্যিক এলাকা : গুলশান-বনানীর অভিজাত আবাসিক এলাকার অলিগলির শত শত বাসাবাড়িতে গড়ে উঠেছে অবৈধ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে কয়েকটি ব্র্যান্ড কোম্পানির প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। আছে ডিপার্টমেন্টাল স্টোর পিকিউএসের বিলাসবহুল দোকান। ব্যাংকের শাখা আছে বাড়ি বাড়ি। অনেক বাড়ির গ্যারেজও পরিণত হয়েছে কনফেকশনারিতে। এ এলাকার বাসাবাড়ি ভাড়া করে তৈরি হচ্ছে ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, কমিউনিটি সেন্টার, রেডিমেড গার্মেন্টের দোকান। এমনকি কুরিয়ার সার্ভিসের অফিসও রয়েছে বেশ কয়েকটি। মডেল টাউন ছাড়াও মহাখালী, আরজতপাড়া ও নাখালপাড়ার অলিগলির বাড়িগুলো পর্যন্ত পরিণত হয়েছে বাণিজ্যিক ভবনে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন মালিক বলেন, বাসাবাড়ি ভাড়া করে দোকান দিলে ভাড়া তুলনামূলকভাবে কম পড়ে। বিদ্যুৎ বিল, গ্যাসের বিলসহ অন্য সব ক্ষেত্রেই আবাসিক বিল পরিশোধ করে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বা শিল্প-কারখানা চালানো সম্ভব হয়। অন্যদিকে বাসাবাড়ির মালিকদের বক্তব্য হচ্ছে, বাসাবাড়ি বাণিজ্যিকভাবে ভাড়া দিলে বেশি ভাড়া পাওয়া যায়। এ প্রক্রিয়ায় উত্তরার ৩, ৬, ৭ ও ৫ নম্বর সেক্টরে দোকানপাট গড়ে উঠেছে প্রায় প্রতিটি সড়কের বাসাবাড়িতে।

গুলশান-নিকুঞ্জে ৫০০ প্লট অবৈধ : বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয়সহ ২২টি বিদেশি দূতাবাস এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন কার্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান ও নিকুঞ্জ আবাসিক এলাকায় অবৈধভাবে প্লট ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। রাজউকের সুনির্দিষ্ট নিয়ম ভঙ্গ করে এসব আবাসিক প্লটের অনেকগুলোকে বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করা হলেও এর বিরুদ্ধে আইনি কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। রাজউকের নিয়ম অনুযায়ী আবাসিক প্লটকে বাণিজ্যিক প্লটে রূপান্তর করতে বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে হলে নির্দিষ্ট ফি জমা দিয়ে এবং পূর্বানুমোদন নিয়ে তবেই তা করতে হয়। কিন্তু গুলশান, বনানী, বারিধারার শত শত প্লটে এসব নিয়মের বালাই নেই। এসব এলাকায় আবাসিক প্লটকে বাণিজ্যিকভাবে, আবার বাণিজ্যিক প্লটকে শিল্প-কারখানা হিসেবে ব্যবহার করার এন্তার নজির রয়েছে।

অবৈধভাবে ব্যবহার করা এমন ৫০০ প্লটের সন্ধান পেয়েছে সংসদীয় উপকমিটি। সম্প্রতি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির এই উপকমিটির কাছে রাজউক ওই ৫০০ প্লটের তালিকা দিয়েছে। এর মধ্যে গুলশানে রয়েছে ৪৮৬টি এবং নিকুঞ্জে ১৪টি প্লট। রাজউকের দেওয়া প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, গুলশান ২ নম্বরের ৮৬ নম্বর সড়কের ১৩ কাঠা জমি আবাসিক প্লট হিসেবে বরাদ্দ দেওয়া হলেও তা বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। অতিসম্প্রতি রাজনৈতিক কার্যালয় হিসেবে প্লটটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। নিকুঞ্জ আবাসিক এলাকা-১ ও ২-এর সর্বত্র বাণিজ্যিক ব্যবহারের ছড়াছড়ি লক্ষ্য করা গেছে। প্রতিটি আবাসিক বাড়িঘরের নিচতলায় গড়ে উঠেছে বাণিজ্যিক স্থাপনা। সেখানে হোটেল-রেস্তোরাঁ গজিয়ে উঠেছে তিন শতাধিক। এ ছাড়া পুরোপুরি মার্কেটে পরিণত হয়েছে আরও অর্ধশতাধিক ভবন। আবাসিক প্লটকে গাড়ি মেরামতের গ্যারেজ থেকে শুরু করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের গুদামঘর আকারেও ব্যবহার করা হচ্ছে। একইভাবে বাংলাদেশে অবস্থিত মোট ২২টি দূতাবাসও অবৈধভাবে আবাসিক প্লটে ব্যবহার করা হচ্ছে। যেসব দেশের দূতাবাস অবৈধভাবে ব্যবহার হচ্ছে সেগুলো হলো— সৌদি আরব, ফ্রান্স, নরওয়ে, স্পেন, ভারত, পাকিস্তান, ইতালি, ইরান, কাতার, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, মিয়ানমার, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস, মিসর, যুক্তরাজ্য, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সুইডেন, ইন্দোনেশিয়া, লিবিয়া ও ভুটান। এ ছাড়া জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশন ও নারীবিষয়ক সংস্থার অফিসও ব্যবহার করা হচ্ছে অবৈধভাবে। এ ছাড়া ইসলামী ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক, সাউথ-ইস্ট ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ব্যাংক আল-ফালাহ, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বাপেক্স গবেষণাগার ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন কার্যালয় অবৈধভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

সর্বশেষ খবর