শনিবার, ৬ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

শিশুরা যখন অপরাধে

মাহবুব মমতাজী

শিশুরা যখন অপরাধে

অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে শিশুরা। প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় বস্তির শিশুদের দিয়ে মাদকদ্রব্য আনা-নেওয়া করে অসাধু ব্যবসায়ীরা। অল্প বয়সে অর্থ উপার্জনে জড়িয়ে পড়া শিশুরাই একসময় ছিনতাই, চুরি ও সন্ত্রাস কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে আরও বড় মাপের অপরাধী হয়ে ওঠে। শিশুর অপরাধী হয়ে ওঠার জন্য মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত হওয়া আর খারাপ সঙ্গকে দায়ী করছেন সমাজবিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, শিশু-কিশোরদের স্বাভাবিক বিকাশের পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ব সরকারকেই গ্রহণ করতে হবে। একই সঙ্গে পারিবারিক সচেতনতা বাড়াতে বেসরকারি সংস্থাগুলোর উদ্যোগ বাড়াতে হবে। পুরান ঢাকার ফরিদাবাদ এলাকার দোকান ব্যবসায়ীরা জানান, গত ৯ জুলাই কথাকাটাকাটির এক পর্যায়ে মো. পাপ্পু নামের এক যুবকের ছুরিকাঘাতে নিহত হন তারই প্রতিবেশী যুবক শাহেদ। পাপ্পুর বড় হয়ে ওঠা ঢালকানগর বস্তি এলাকায়। সেখানে ছোটকালে তাকে দিয়েই স্থানীয় প্রভাবশালীরা মাদক সরবরাহ, বেচাকেনা করাত। পড়ালেখা ছেড়ে টাকা রোজগারের দিকে অল্প বয়সেই ঝুঁকে পড়ে সে। শাহেদের নিহত হওয়ার পরই পুলিশের হেফাজতে রয়েছে পাপ্পু। অনুসন্ধানে জানা যায়, ফরিদাবাদের বাংলাদেশ ব্যাংক কলোনির চারদিক দিয়ে ঢালকানগর, গ্লাস ফ্যাক্টরি, হরিচরণ রায় রোডের দুই পাশে গড়ে উঠেছে খুপরি ঘর। এসব ঘর নিম্ন আয়ের মানুষের সাধ্যের মধ্যকার আবাস। ব্যাংক কলোনির আইজি গেট নামের ফটক দিয়ে ঢুকতেই হাতের বামে চোখে পড়বে লোহার গেট। তার ওপারে স্বল্পপরিসর নিয়ে গড়ে উঠেছে একটি বস্তি। এখানে ৩০-৩৫টি ঘর। প্রত্যেকের ঘরে না থাকলেও বেশির ভাগ পরিবারে ১০ বছরের নিচে বয়সী শিশু রয়েছে। এ বস্তির প্রবেশমুখের তিনটি পয়েন্টেই তিন যুবক প্রায় সময়ই দাঁড়িয়ে থাকে। যাদের কাজ হলো অপরিচিত মুখের গতিবিধি লক্ষ্য রাখা। কিছু কিছু ঘরের বাইরের অংশে বস্তির চেহারা কিন্তু ভিতরে রয়েছে বিলাসী আসবাবপত্র। এ ধরনের ঘরগুলোয় চলে মাদকের আড্ডা, বেচাকেনা। এসব ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় শিশুদের। কারণ যে কোনো ধরনের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা গোয়েন্দা সন্দেহের বাইরে থাকে তারা। এ বস্তি থেকেই মাদক সরবরাহ করা হয় গেন্ডারিয়ার ঘুণ্টিঘর এলাকায়। এ রুটের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে ঢালকানগরের হরিচরণ রায় রোডের এক ভিক্ষুক, যার কাজ সারা দিন সেখানে বসে ভিক্ষা করা। ক্রেতাকে নিরাপদে মাদকের আখড়া চেনানো। কেউ কেউ কখনো ভিক্ষার ছলে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছায় অসাধুদের পার্সেল। বস্তির এক বাসিন্দা শামসুদ্দিনের (ছদ্মনাম) সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, এ বস্তিটি গেন্ডারিয়া ও শ্যামপুর দুই থানার মধ্যে পড়েছে। বস্তিতে অবাধে মদ, গাঁজা, ফেনসিডিল ও ইয়াবা পাওয়া যায়। কিন্তু তার একটি যথাযথ লাইন আছে। যে কারও কাছে গেলে পাওয়া যাবে না। এসব কাজে কোনো ঝামেলা যাতে না হয় সেজন্য শ্যামপুর ও গেন্ডারিয়া থানায় দিনে তিন লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়।

এ তথ্য শুধু ব্যাংক কলোনির আইজি গেটের পাশেই মিলবে না। সে এলাকার খানিকটা দূরে গেন্ডারিয়া রেল স্টেশনের উত্তর-পূর্ব কোণে দয়াগঞ্জ রেলওভার ব্রিজের পাশেই চলে অবাধে মাদকের ব্যবসা। একই কাজে জড়িত কিশোররাই আবার ভোরে আশপাশের বাসাবাড়িতে জানালা-দরজা দিয়ে কৌশলে হাতিয়ে নেয় মোবাইল, ল্যাপটপসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র। সন্ধ্যা নামলেই সায়েদাবাদ জনপথ মোড়, যাত্রাবাড়ী ক্রীড়া চক্র মোড়, দয়াগঞ্জ মোড় এবং মীরহাজিরবাগে তাদের মাধ্যমেই চলে ছিনতাই কার্যক্রম। বেশির ভাগ ছিনতাই করা হয় রিকশায়। তাতে ব্যবহার করা হয় মোটরবাইক।

দেখা গেছে, দয়াগঞ্জ রেলওভার ব্রিজের দক্ষিণ দিকে রয়েছে রিকশা-ভ্যানের গ্যারেজ এবং তার পাশেই বিশাল এলাকা জুড়ে রয়েছে টিনশেডের অসংখ্য বাসাবাড়ি। প্রতিটি টিনশেড বাড়ির কেউ না কেউ গাঁজা, হেরোইন বিক্রির সঙ্গে জড়িত। আর রিকশা গ্যারেজের সঙ্গেই রয়েছে সোহেলের মুদি দোকান। সোহেল মাদক ক্রেতার হয়রানি ঠেকাতে থানা পুলিশ ম্যানেজ করে থাকে। একই সঙ্গে সে মুদি দোকানের আড়ালে গাঁজার পুরিয়া বিক্রি করে। এখান থেকেই মাদকদ্রব্য বিক্রিতে যে কোনো ধরনের ঝামেলা এড়াতে যাত্রাবাড়ী থানায় দিন শেষে দুজন পুলিশ কনস্টেবলের মাধ্যমে পাঠানো হয় নির্দিষ্ট পরিমাণের চাঁদা। এখানকার আনুমানিক ৮ থেকে ১৬ বছর বয়সীরা চোরাচালান ও জুয়ার আসরের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহূত হয়ে থাকে। আর এ কাজ করছে এলাকার স্বপন, রিপন, লিটন ও কালা শাহিনের মতো কিশোররা। ফরিদাবাদ, দয়াগঞ্জ ছাড়াও কামরাঙ্গীরচর, কমলাপুর রেল স্টেশনে, কারওয়ান বাজার, মহাখালীর রেললাইন ঘেঁষে গড়ে ওঠা বস্তি এলাকা, মহাখালী কড়াইল বস্তিতেও বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে শিশুরা। শুধু বস্তি এলাকার শিশুরা নয়, রাজধানীর বেশির ভাগ পথশিশুর মাধ্যমেও অপরাধমূলক নানা কর্মকাণ্ড ঘটানো হয়। দেশে ৫ থেকে ১৭ বছরের শিশুর সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি। এর মধ্যে ১৩ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমের সঙ্গে জড়িত। এর ৭০ শতাংশ দারিদ্র্যের কারণে বিভিন্ন কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছে। ছিনতাই, মাদক বহন, খুন-খারাবি, বাসের হেলপারি, ওয়েল্ডিং কারখানায় তাদের অব্যবহার করা হয়। একসময় তারাই সমাজের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। সরকারের গৃহীত বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা, উপবৃত্তি প্রকল্প, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমের পরও শিশুদের অপরাধমূলক কাজ আশানুরূপ কমে আসেনি। শিশুদের সুস্থ স্বাভাবিক বিকাশ নিশ্চিত করতে বিভিন্ন সচেতনতামূলক স্লোগান নিয়ে প্রতি বছর ২০ নভেম্বর পালন করা হয় বিশ্ব শিশু দিবস। এ বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম জানান, ‘মাদক কেনাবেচায় আমাদের শিশুদের ব্যবহার করা হয়। আমাদের সমাজে মাদক কোনোভাইে গ্রহণযোগ্য নয়। আর শিশুদের দিয়ে সরবরাহ করা মানে একসময় তারাও তাতে আসক্ত হবে। এভাবে সেটি সহজলভ্য হয়ে যাবে। পরে এর যা ক্ষতি হবে তা অবর্ণনীয়। যে বয়সে তাদের লেখাপড়া করা দরকার সে বয়সে তারা যদি টাকা-পয়সা আয় করা শুরু করে তাহলে তাদের লেখাপড়া আর হয় না। এজন্য শিশুদের সম্পূর্ণ দায়দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। বিশ্বের অনেক দেশেই এর উদাহরণ রয়েছে। বস্তি এলাকার শিশুদের উন্নয়নে সব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয় ঘটাতে হবে।’

মাসোহারা গ্রহণের অভিযোগ অস্বীকার করে শ্যামপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘আমরা মাদকের বিষয়ে কোনো ধরনের আপস করি না। প্রায়ই আমাদের মাদকবিরোধী অভিযান চলে। এ বিষয়ে আমরা সব সময় সোচ্চার রয়েছি।’

সর্বশেষ খবর