মঙ্গলবার, ৯ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

আমার মা-ই ছিলেন বাবার বড় প্রেরণা

————————— শেখ হাসিনা

নিজস্ব প্রতিবেদক

জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী মহীয়সী নারী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছার স্মৃতিচারণ করে তার জ্যেষ্ঠ কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমার মা-ই ছিলেন বাবার বড় প্রেরণা। এই মহীয়সী নারীর দূরদর্শিতাই বাংলার স্বাধীনতার পথ খুলে দিয়েছিল। আওয়ামী লীগের তৎকালীন অনেক নেতার আপত্তি সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর সার্বক্ষণিক এই ছায়াসঙ্গী বেগম মুজিবই তাকে (বঙ্গবন্ধু) আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে প্যারোলে মুক্তি নিয়ে পাকিস্তানের সামরিক সরকারের সঙ্গে বৈঠকে বসতে নিষেধ করে বাংলার স্বাধীনতার পথ খুলে দিয়েছিলেন। গতকাল সকালে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ৮৬তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা আরও বলেন, আমার মা একটি টাকাও খরচ করতেন না, জমিয়ে রাখতেন। পরে সেসব টাকা বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দেন। বঙ্গবন্ধু তার রাজনৈতিক কার্যক্রম, আন্দোলন-সংগ্রাম আর মানুষের কল্যাণে সেসব অর্থ কাজে লাগিয়েছেন। আমার মা নেপথ্যে থেকে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অনুপ্রেরণা ও সাহস দিয়েছেন। রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক বাংলাদেশ শিশু একাডেমির চেয়ারম্যান সেলিনা হোসেন, নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি রেবেকা মোমেন এমপি এবং জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান মমতাজ বেগম, নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসিমা বেগম বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠানে বেগম মুজিবের ওপর নির্মিত একটি প্রামাণ্যচিত্রও প্রদর্শন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আগস্ট মাস, শোকের মাস। আর এ মাসেই আমার ছোট ভাই শেখ রাসেলও জন্মগ্রহণ করেছিল। আবার এই মাসেই আমার পরিবারের সদস্যদের ঘাতকরা গুলি করে হত্যা করে। মায়ের স্মৃতিচারণ করে ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের বড় সন্তান শেখ হাসিনা বলেন, জীবনে যত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ আমার আব্বা (বঙ্গবন্ধু) করেছেন প্রতিটি কাজে আমার মা ছায়ার মতো তাকে (বঙ্গবন্ধু) সাহায্য করে গেছেন। কখনো এ ব্যাপারে অভিযোগ-অনুযোগ তিনি করেননি। যত কষ্টই হোক আমার বাবাকে কখনই বলেননি যে, তুমি রাজনীতি ছেড়ে দাও বা সংসার কর বা সংসারের খরচ দাও। কোনো দিন জীবনের কোনো প্রয়োজনে বাবাকে কখনো বিরক্ত করেননি। বরং আব্বা যে পদক্ষেপ নিতেন সেটাকেই সমর্থন করতেন তিনি। আমার মা অভাব-অনটন বুঝতে দিতেন না। যেদিন ঘরে অন্য খাবার থাকত না, সেদিন সামান্য চাল-ডালের খিচুড়ি রেঁধে আচা?র দিয়ে খেতে দিতেন আমাদের। ঘরে খাবার না থাকলেও আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের অকাতরে সাহায্য করতেন বাবা। দলের কাজকর্ম, আন্দোলন-সংগ্রামে প্রয়োজনে নিজের সম্পদ দিয়ে সাহায্য করতেন মা। মা-বাবা কখনো আমাদেরকে অভাব বুঝতে দেননি। কৌশলে সেসব অভাব মেটাতেন আর আমাদেরকে ভিন্নভাবে বোঝাতেন। তিনি বলেন, নিজের জন্য কখনো কিছু চাননি মা। অথচ সারা জীবন এই দেশের কল্যাণে, মানুষের কল্যাণে কাজ করে গেছেন। এ দেশকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। আব্বার সঙ্গে থেকেই তিনি স্বপ্ন দেখতেন, এ দেশের মানুষ ভালো থাকবে, সুখে-শান্তিতে বাস করবে। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বাবার পাশে থেকে সে স্বপ্ন পূরণে সহায়তা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, মানুষ মন্ত্রিত্বের জন্য দল ছাড়ে আর বাবা দলের জন্য মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেন। কিন্তু আমার মা সেটি নিয়ে কোনো অনুযোগ করেননি। বরং তার সিদ্ধান্তে সমর্থন দিয়েছেন, উৎসাহ জুগিয়েছেন। বাবা জীবনে বড় বড় ঝুঁকি নিয়েছেন, সব সময় মা প্রেরণা দিয়েছেন। বাবা অধিকাংশ সময় জেলে থাকতেন আর আন্দোলন-সংগ্রামে নেতা-কর্মী ও ছাত্রদের পরামর্শ-নির্দেশনা দিতেন মা। রাজনৈতিকভাবে অনেক সচেতন ছিলেন তিনি। তিনি বলেন, বঙ্গমাতাই বোধ হয় সবচেয়ে আগে জানতেন, এই দেশ একদিন স্বাধীন হবে। এজন্য তিনি কোনো দিন করাচিতে যাননি, যেতেও চাননি। এভাবেই স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে আটকাবস্থা থেকে ক্যান্টনমেন্টে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সামরিক সরকার। ৬ মাস পর্যন্ত তার কোনো হদিস ছিল না। আমরা জানতেও পারিনি তিনি বেঁচে আছেন কিনা। এরপর কোর্টেই বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দেখার সুযোগ হয়। তখন পাকিস্তান সরকার আম্মাকে ভয় দেখায়, বঙ্গবন্ধু প্যারোলে মুক্তি না নিলে তিনি বিধবা হবেন। মা সোজা বলে দিলেন, কোনো প্যারোলে মুক্তি হবে না। নিঃশর্ত মুক্তি না দিলে কোনো মুক্তি হবে না। তিনি বলেন, আমি মায়ের সিদ্ধান্তের কথা কোর্টে যখন বঙ্গবন্ধুকে জানালাম তখন অনেক আওয়ামী লীগ নেতাকেও দেখেছি তারা বলেছেন, তুমি কেমন মেয়ে? বাবার মুক্তি চাও না? আম্মাকে বলেছে— ভাবী আপনি কিন্তু বিধবা হবেন। আমার মা তখন কঠিন স্বরেই বলেছেন, প্যারোলে মুক্তি নিলে মামলার আর ৩৪ জন আসামির কী হবে।... বঙ্গবন্ধু প্যারোলের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। গণঅভ্যুত্থানে পাকিস্তান সরকার আব্বাকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্বের কারণে কখনই বাবাকে এক নাগাড়ে দুই বছর কারাগারের বাইরে থাকতে দেখেননি বলে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, বিশেষ করে ছাত্রলীগকে তিনি (বঙ্গবন্ধু) নিজের হাতেই গড়ে তুলতেন। ছাত্রলীগকে সব সময় পরামর্শ দেওয়া, তাদের যা কিছু দরকার তিনিই দেখতেন। সংগঠন চালানোর প্রয়োজনে গহনা থেকে শুরু করে ঘরের ফ্রিজ পর্যন্ত আম্মা বিক্রি করেছেন।

একটা সময় ছয় দফা না আট দফা হবে তা নিয়ে মতবিরোধে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা আট দফার পক্ষে চলে গিয়েছিলেন বলে জানিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, ছয় দফা থেকে একচুল এদিক-ওদিক যাবে না এইটেই ছিল তার (বেগম মুজিব) সিদ্ধান্ত— এটা আব্বা বলে দিয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের নেতারা উঠেপড়ে লাগলেন। আট দফা খুবই ভালো, আট দফা মানতে হবে। তখন তার মায়ের ছয় দফার পক্ষে অবস্থানের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, মা বলেছিলেন, শুধু এটুকুই বুঝি ছয় দফাই হচ্ছে বাংলার মানুষের মুক্তির সনদ। এটা উনি (বঙ্গবন্ধু) বলে গেছেন। এইটেই মানি। এর বাইরে কিছু মানি না। বঙ্গবন্ধু জেলে থাকার সময় সেখান থেকে দলের জন্য কীভাবে নির্দেশ নিয়ে আসতেন সে স্মৃতিচারণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার মায়ের স্মরণশক্তি ছিল অসাধারণ। আমরা মাঝে মাঝে বলতাম তুমি তো টেপরেকর্ডার। আমাদের শিখিয়ে নিয়ে যেতেন কারাগারে গিয়ে কী করতে হবে। একটু হৈচৈ করা। এর মাঝে বাইরের সমস্ত রিপোর্ট আব্বাকে দেওয়া এবং আব্বার নির্দেশটা নিয়ে আসা। এরপর সেটা ছাত্রদের জানানো। স্লোগান থেকে শুরু করে বলতে গেলে সবকিছুই তিনিই (বঙ্গবন্ধু) কারাগার থেকে নির্দেশ দিয়ে দিতেন। সেইভাবেই কিন্তু মা ছাত্রলীগকে কাজে লাগাতেন। শেখ হাসিনা বলেন, আমার আব্বা যখন মন্ত্রী, এমপি, এমএলএ ছিলেন, করাচিতে যেতেন, আমার মা কিন্তু জীবনে এক দিনও করাচিতে যাননি। কোনো দিন যেতে চাননি। তিনি বলেন, তার (বঙ্গমাতা) যে দূরদর্শিতা রাজনীতিতে সেটাই কিন্তু আমাদের স্বাধীনতার পথ খুলে দিয়েছে। কারণ সেদিন বঙ্গবন্ধু যদি প্যারোলে যেতেন তাহলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। সাতই মার্চের ভাষণেও মায়ের ভূমিকার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোনো কোনো নেতা বললেন এখনই বলে দিতে হবে আজ থেকে স্বাধীন। কেউ বললেন এটা করতে হবে, ওটা করতে হবে। কেউ কেউ এসে বলেলেন এটাই করতে হবে, না হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। অমুক হবে, তমুক হবে। এ রকম বস্তাকে বস্তা কাগজ আর পরামর্শ। শেখ হাসিনা বলেন, আব্বাকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় যেতে হলে ‘নিজের ঘরে কিছুক্ষণ নিজের মতো’ থাকতে পরামর্শ দিতেন আম্মা। ৭ মার্চ ভাষণ দিতে যাওয়ার আগে বঙ্গবন্ধুকে আম্মা বললেন, সারা জীবন তুমি সংগ্রাম করেছ, জেল-জুলুম অত্যাচার সহ্য করেছ, তুমিই জানো এ দেশের মানুষ কী চায়, যেটা তোমার থেকে বেশি কেউ জানে না। কাজেই তোমার মনে যে কথা আসবে তুমি সেই কথাই বলবে। কারও কথা তোমার শুনতে হবে না। ঠিক তাই এই সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ। হাতে কোনো কাগজও ছিল না। কিছুই ছিল না।

সর্বশেষ খবর