বুধবার, ১৭ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

জঙ্গি আস্তানা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

হামিদের হাত কেটে যাত্রা শুরু শিবিরের

মুহাম্মদ সেলিম, চট্টগ্রাম

জঙ্গি আস্তানা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

আশির দশকে জাতীয় ছাত্রসমাজ নেতা হামিদের হাতের কবজি কেটে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) রক্তের হোলি খেলা শুরু করে ছাত্রশিবির। এরপর দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে ক্যাম্পাসে চলে শিবিরের একচ্ছত্র আধিপত্য। প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির পাশাপাশি ক্যাম্পাসে উত্থান ঘটে জঙ্গিবাদের। অনেকটা ওপেন সিক্রেট চলতে থাকে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), হিযবুত তাহ্রীর, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি), হরকাতুল জিহাদসহ (হুজি) বিভিন্ন উগ্রপন্থি সংগঠনের কার্যক্রম। ফলে একসময় জঙ্গিবাদের উর্বর ভূমিতে পরিণত হয় দেশের অন্যতম এ বিদ্যাপীঠ। কালের বিবর্তনে ‘জঙ্গি সৃষ্টির কারখানায়’ পরিণত হওয়া চবি থেকেই বের হচ্ছে একের পর এক দুর্ধর্ষ জঙ্গি। গত কয়েক বছরে দেশের বিভিন্ন এলাকায় জঙ্গিসংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গ্রেফতার হন চবি শিক্ষক থেকে শুরু করে ছাত্রসহ কমপক্ষে ৩০ জন। গুলশান হামলার মাস্টারমাইন্ড নুরুল ইসলাম মারজানও ছিলেন চবি শিক্ষার্থী। চবি ভিসি প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘দীর্ঘ সময় চবি উগ্রপন্থি মৌলবাদীদের দখলে ছিল। তখন প্রকাশ্যে চলত উগ্রপন্থি সংগঠনের কার্যক্রম। ফলে কিছু শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহায়তায় শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। ভবিষ্যতে যাতে কোনো শিক্ষার্থী জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়তে না পারে এজন্য নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। গঠন করা হয়েছে “জঙ্গি ও সন্ত্রাস প্রতিরোধ সেল”। শিক্ষক-কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠন করা হয়েছে আলাদা আরও একটি শক্তিশালী কমিটি।’

জেলা বিশেষ শাখার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রেজাউল মাসুদ বলেন, ‘শুধু শুলশান হামলার মাস্টারমাইন্ড নুরুল ইসলাম মারজান নয়, ধারণা করছি চবির আরও ছাত্রের জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। বিষয়টি আমরা খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি।’ চবি ছাত্রলীগের সভাপতি আলমগীর টিপু বলেন, ‘২০১৪ সালের আগ পর্যন্ত চবি জামায়াত-শিবিরের দখলে ছিল। অনেকটা প্রকাশ্যে চলত উগ্রপন্থিদের কার্যক্রম। বর্তমানে তারা ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত হয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় জঙ্গি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে।’ জানা যায়, গত কয়েক বছরে দেশের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে জঙ্গিসংশ্লিষ্টতার অভিযোগে চবির কমপক্ষে ৩০ শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এদের অধিকাংশই একসময় শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। কেউ কেউ শিবিরের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। গুলশানে জঙ্গি হামলার মাস্টারমাইন্ড নুরুল ইসলাম মারজানও চবির আরবি বিভাগের ছাত্র ছিলেন। তিনি গত বছর একবার গ্রেফতার হন পুলিশের হাতে। চবিতে লেখাপড়াকালীন মারজান শিবিরের সাথী ছিলেন। এর আগে গত বছর ২৬ ডিসেম্বর নগরীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে নাইমুর রহমান নয়ন, ফয়সাল মাহমুদ ও শওকত রাসেল নামে তিন চবি শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করে চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। পরে তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বিপুল বোমা ও অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। ১০ আগস্ট নগরীর দেবপাহাড় এলাকা থেকে ইয়াসির ইকবাল নামে চবির এক ছাত্রকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ইয়াসির চবি ও চুয়েটের হিযবুত তাহ্রীরের একজন সংগঠক। গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে ইয়াসির পুলিশকে জানান, চবিতে হিযুবত তাহ্রীরের শতাধিক সক্রিয় কর্মী রয়েছেন। তাদের মধ্যে ১০ জনের বেশি চট্টগ্রাম বিভাগ ও জেলার বিভিন্ন ইউনিটের দায়িত্ব পালন করছেন। একই বছরের ২ মার্চ বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যার অন্যতম সন্দেহভাজন উগ্রপন্থি ব্লগার শফিউর রহমান ফারাবীকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। ফারাবীও চবির পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী ছিলেন। ফারাবী একসময় শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন।

চবি ছিল মিনি ক্যান্টনমেন্ট : তিন দশকেরও বেশি সময় চবিতে একক নিয়ন্ত্রণ ছিল ছাত্রশিবিরের। এ সময় কথায় কথায় প্রতিপক্ষ দলের কর্মীদের ওপর হামলা ও খুনের ঘটনা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। হল দখল, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি সবই নিয়ন্ত্রণ করত শিবির। বিশ্ববিদ্যালয় ও আশপাশ এলাকা তখন ‘মিনি ক্যান্টনমেন্ট’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ২০০৯ সালে দেশে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে খর্ব হতে থাকে চবিতে শিবিরের রাজত্ব। ২০১৪ সালে ক্যাম্পাস নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি চলে যায় ছাত্রলীগের হাতে। ১৯৮৮ সালে তৎকালীন জাতীয় ছাত্রসমাজ নেতা হামিদের হাতের কবজি কেটে চবিতে রক্তের হোলি খেলা শুরু করে ছাত্রশিবির। এরপর দীর্ঘ সময়ে তাদের হাতে খুন হন প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের ১৫ জনের বেশি নেতা-কর্মী। হামলার শিকার হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেন অর্ধশতাধিক। ২০০১ সালের ২৯ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের তৎকালীন সিনিয়র সহ-সভাপতি আলী মর্তুজাকে প্রকাশ্যে হত্যা করে শিবির ক্যাডাররা। ১৯৯৮ সালের আগস্টে হত্যা করা হয় ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসা মেধাবী শিক্ষার্থী আইয়ুব আলীকে। একই বছর হত্যা করা হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী মুশফিককে। ১৯৯৭ সালের সেপ্টেম্বরে চবি রেলস্টেশন এলাকায় তাদের হাতে খুন হন ছাত্রলীগ কর্মী আমিনুল ইসলাম বকুল। একই বছর নগরীর বটতলী রেলস্টেশনে খুন হন ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী সঞ্জয় তলাপাত্র। ১৯৯৪ সালে ৬ নভেম্বর রগ কেটে খুন করা হয় চবি ছাত্রদলের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক নুরুল হুদা মুছাকে। ১৯৯০ সালে শিবিরবিরোধী আন্দোলনে হামলা চালিয়ে তৎকালীন ছাত্রমৈত্রীর সভাপতি ফারুকুজ্জামান ফারুককে হত্যা করে শিবির।

সর্বশেষ খবর