বুধবার, ১৭ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

চোরাচালানে ফ্রিস্টাইল অসহায় কাস্টমস

রুহুল আমিন রাসেল

জনবল সংকটের তীব্রতায় কাস্টমস অসহায় হয়ে পড়ায় সীমান্তে চোরাচালানিরা এখন ফ্রিস্টাইলে কাজ করছে বলে জানা গেছে। তবে অস্ত্র, গোলাবারুদ ও মাদক চোরাচালান প্রতিরোধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো সীমান্তে কড়া নজরদারি রাখছে। তা সত্ত্বেও জলে-স্থলে ও আকাশপথে বেপরোয়া হয়ে পড়েছে চোরাকারবারিরা। কাস্টমসের দাবি— সীমিত শক্তি-সামর্থ্য দিয়ে বিপুল পরিমাণে সোনাসহ চোরাকারবারিদের অবৈধ পণ্য জব্দ করছে তারা। আর বিজিবির তথ্য-উপাত্তে দেখা গেছে, চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে বিপুল পরিমাণে মাদকসহ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সমুদ্রবন্দর, স্থলবন্দর ও বিমানবন্দরে কাস্টমসের সর্বোচ্চ ও সার্বক্ষণিক নজরদারি রয়েছে। একই সঙ্গে সীমান্তসহ অন্যান্য যেসব এলাকায় কাস্টমসের লোকবলের উপস্থিতি নেই, সেখানে কাস্টমস আইনের অধীনে বিজিবিকে ক্ষমতায়িত করা হয়েছে। এ ছাড়া এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন চোরাচালানবিরোধী কেন্দ্রীয় টাস্কফোর্স সক্রিয় রয়েছে। ফলে চোরাচালান আগের চেয়ে এখন অনেকটা নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। তবে শুল্ক গোয়েন্দাকে আরও ক্ষমতায়িত করার মধ্য দিয়েও অনেক সফলতা আসতে পারে। দেশের সীমান্ত রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ—বিজিবির ওয়েবসাইটে চলতি বছরের প্রথম সাত মাসের (জানুয়ারি থেকে জুলাই) পর্যন্ত সর্বশেষ তথ্য-উপাত্তে দেখা গেছে, এই সময়ে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রের গোলাবারুদ ও গান পাউডার ছাড়াও প্রায় ৩৪ লাখ ১৪ হাজার ইয়াবা ট্যাবলেট, প্রায় ৩ লাখ সেনেগ্রা, এনেগ্রা ও ভায়াগ্রা ট্যাবলেট, ১ লাখ ২৩ হাজার বোতল ফেনসিডিল, ৩২ হাজার বোতল বিয়ার, ১ লাখ ৭ হাজার লিটার বিদেশি মদ, ১০ হাজার কেজির অধিক গাঁজা, ৩ হাজার লিটারের বেশি দেশি মদ, ১১ কেজি হেরোইন ও ৪ হাজার ৬৭৩টি নেশা জাতীয় ইনজেকশন আটক করে বিজিবি। অন্যদিকে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর পরিচালিত গত জুলাই মাসে চোরাচালানবিরোধী আলোচিত অভিযান অপারেশন আইরিনেও বিপুল পরিমাণে অবৈধ পণ্য আটক করা হয়। সংস্থাটির তথ্যমতে, অবৈধ অস্ত্র, গোলাবারুদ, বিস্ফোরক, মাদক ও নিরাপত্তা ঝুঁকির হুমকি মোকাবিলায় গত ৮ থেকে ২৩ জুলাইয়ের অপারেশনে দেশের বিভিন্ন বিমানবন্দর ও স্থলবন্দর থেকে বিভিন্ন ধরনের অবৈধ পণ্য জব্দ করা হয়েছে। এর মধ্যে বেনাপোল স্থলবন্দরে বিদেশ থেকে আসা দুই বাংলাদেশির কাছ থেকে ১৮ হাজার ৭৫০ মার্কিন ডলার মূল্যের বিভিন্ন মুদ্রা, শাহজালাল বিমানবন্দরে দুবাই থেকে আসা ৩০ কেজি ওজনের একটি পার্সেল থেকে ৭ হাজার ৪০০ পিস ভায়াগ্রা, হংকং থেকে আসা পোস্টাল পার্সেল থেকে ৮৯০ পিস পুরনো কম্পিউটার র‌্যাম ও চীন থেকে আসা নেটওয়ার্ক সংযুক্ত কম্পিউটার রাইডার, চীন থেকে আসা পার্সেল থেকে বোমা তৈরির কাজে ব্যবহারযোগ্য সন্দেহে আড়াই কেজি ওজনের সার্কিট বোর্ড এবং স্প্রিং ও বৈদ্যুতিক তার, দুবাই থেকে আসা ১৫০ কার্টন সিগারেট ও ২০ প্যাক আমদানি নিষিদ্ধ ওষুধ, কোরিয়ার এক কৌটা ট্যাবলেট ও ছয়টি ধারালো ছুরি জব্দ করা হয়। চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ১ দশমিক ২৬ কেজি ওজনের সোনার বার, মংলা বন্দরে চীন থেকে আমদানি করা দুটি কনটেইনার ভর্তি ব্যবহূত ডিসপোজেবল সিরিঞ্জ, নিডল, বোরেট সেট ও অক্সিজেন মার্কস জব্দ করা হয়। চোরাচালানের এমন পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন—এফবিসিসিআই সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, চোরাচালানের মূলোৎপাটনে কেউ ব্যবস্থা নিচ্ছে না। সোনা চোরাচালানের তথ্যে বিস্ময় প্রকাশ করে তিনি বলেন, প্রায় প্রতিদিনই সোনা আটক হচ্ছে। শুধু পাচার করা পণ্য নয়, কারা পাচার করছে এবং তাদের হোতাদের আটক করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আগা এবং গোড়াও ধরতে হবে। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের তথ্য বলছে, গত তিন বছরে তিন টন সোনা উদ্ধার করা হয়েছে, যার মূল্য এক হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। আর আটক করা হয়েছে ১৩০ জনকে। গোয়েন্দা তত্পরতায় আরও প্রায় ৫০০ মণ সোনা চোরাচালান প্রতিরোধ করা হয়েছে। আটক করা সোনা আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি বিভিন্ন দেশের অনলাইন ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে পোস্টাল ও কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবহার করে অবৈধ অস্ত্র, গোলাবারুদ, বিস্ফোরক, মাদক ও নিরাপত্তার ঝুঁকি সংবলিত পণ্য পরিবহন হয়। আসিয়ান ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এ ধরনের আটকের ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। কাস্টমস সূত্র জানায়, সীমান্তে অবাধে চলছে চোরাচালান। আসছে বিস্ফোরক দ্রব্য পটকাসহ নানা পণ্য। চোরাচালান কয়েকগুণ বেড়েছে। চোরাকারবারির সিন্ডিকেটের যোগসাজশে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে অবৈধভাবে আনা শাড়ি, থ্রি-পিস, স্টিল, মাদকসহ বিভিন্ন পণ্য। বাংলাদেশ সরকার বিস্ফোরক জাতীয় দ্রব্য পটকা আমদানি নিষিদ্ধ করলেও এই আদেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চোরাকারবারিরা হাজার হাজার শক্তিশালী পটকা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের বাজার সয়লাব করছে। পটকা থেকে বারুদ বের করে নিয়ে সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন ককটেল তৈরি  করছে। জানা গেছে, বাংলাদেশ-মিয়ানমার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে পরিকল্পিত সীমান্ত সড়ক না থাকায় সীমান্তরক্ষী বিজিবি সদস্যদের সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পুরো এলাকা টহলের আওতায় আনতে পারছে না। ফলত চোরাচালান প্রতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। চোরাইপণ্যের তালিকায় রয়েছে— ডিজেল, অকটেন, চাল, ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী। বিনিময়ে মিয়ানমার থেকে আসছে ইয়াবা, নতুন টিনজাত মাদক ১২ পারসনসহ বিভিন্ন প্রকার মাদক দ্রব্য।

সর্বশেষ খবর