শুক্রবার, ১৯ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

জঙ্গি ইস্যুতে সিঙ্গাপুরে বিব্রত বাংলাদেশিরা

প্রবাসের পথে পথে ২

শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ, সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে

জঙ্গি ইস্যুতে সিঙ্গাপুরে বিব্রত বাংলাদেশিরা

বাংলাদেশি শ্রমিকদের প্রথম পছন্দের দেশ সিঙ্গাপুর। আর এই সিঙ্গাপুরে যাওয়ার জন্য দেশের হাজার হাজার বেকার যুবক উন্মুখ হয়ে আছে। যে যেভাবে পারছে, সে সেভাবে কাজের সন্ধানে যাচ্ছে স্বপ্নের সিঙ্গাপুর। বাংলাদেশের তুলনায় অনেক ছোট এই  সিঙ্গাপুরে কর্মযজ্ঞের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। আর সিঙ্গাপুরেও বাংলাদেশি শ্রমিকের চাহিদা ব্যাপক। স্বপ্নের এই সিঙ্গাপুরে কাজের সন্ধান করতে বাংলাদেশি বেকার যুবকরা মাসের পর মাস প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ করার উপযুক্ত হয়ে সিঙ্গাপুরে যাচ্ছে; যাতে ওই দেশে কোনো ধরনের সমস্যায় পড়তে না হয়। আর সেই স্বপ্নের সিঙ্গাপুরে এখন বাংলাদেশি মানে সমস্যা। বাংলাদেশি মানেই হয়রানি। হয়রানির শেষ নেই বাংলাদেশিদের। বাংলাদেশি মানে জঙ্গিসংশ্লিষ্টতা— এমন মনোভাব দেখা দিয়েছে সিঙ্গাপুর সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে। বিশেষ করে গত এপ্রিলে আট বাংলাদেশিকে আটক করার পর ছয়জনকে জঙ্গিবাদে মদদ দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করে সে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আর এ ঘটনায় ১২ জুলাই সিঙ্গাপুর আদালত বাংলাদেশে সশস্ত্র জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ড চালাতে অস্ত্র কেনার টাকা জোগানোর দায়ে চার বাংলাদেশিকে দুই থেকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে। তারা হলেন মিজানুর রহমান (৩১), রুবেল মিয়া (২৬), মো. জাবেদ কায়সার হাজী নুরুল ইসলাম সওদাগর (৩০) ও ইসমাইল হাওলাদার সোহেল (২৯)। চারজনই ৩১ মে সিঙ্গাপুরের আদালতে জঙ্গি কর্মকাণ্ডে সহায়তার জন্য কয়েক হাজার মার্কিন ডলার সংগ্রহ ও তা সরবরাহের কথা স্বীকার করেন। আর এই দলের নেতা হলেন মিজানুর রহমান। তাকে আদালত পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে। এ ছাড়া সোহেলকে দুই বছর ও বাকি দুজনকে সিঙ্গাপুরে ৩০ মাসের সাজা খাটতে হবে।

পুলিশের তথ্যানুযায়ী, জাবেদের কাছে জঙ্গি কর্মকাণ্ডের জন্য সংগ্রহ করা ১ হাজার ৩৬০ মার্কিন ডলার ছিল, যার মধ্যে ১ হাজার ৬০ ডলার সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন রুবেল। ওই দলের সবাই নিজেরাও ৬০ থেকে ৫০০ ডলার পর্যন্ত চাঁদা দিয়েছেন বলে জানা গেছে।

পুলিশ বলছে, এ চার বাংলাদেশির সবাই সিঙ্গাপুরে গিয়ে জঙ্গিবাদে জড়িয়েছেন। এদের মধ্যে মিজানুর এস-পাসধারী মাঝারি পর্যায়ের দক্ষ কর্মী। বাকিরা সবাই ওয়ার্ক পারমিটধারী আধাদক্ষ শ্রমিক হিসেবে সিঙ্গাপুরে ছিলেন। আর এ ঘটনার পর থেকেই নাকি সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশি শ্রমিকদের প্রতি কড়া নজরদারি চলছে। এদিকে সিঙ্গাপুরে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সেমিনারে যোগ দিতে যান কাপাসিয়ার দোলন পারভেজ। তিনি বলেন, সিঙ্গাপুরে বিমান থেকে নেমে ইমিগ্রেশনে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশি পাসপোর্ট দেখে আলাদা করে অন্য একটি কক্ষে নিয়ে যায়। আর ওই কক্ষে একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকেন ইমিগ্রেশনের দায়িত্বরত পুলিশ। দীর্ঘ দেড় ঘণ্টা জেরা করে ইমিগ্রেশন ত্যাগ করেন ওই পাসপোর্টধারী। ১১ আগস্ট বিকালে ইন্দোনেশিয়ার বাতাম সেন্টার থেকে নৌপথে সিঙ্গাপুরের হারবার ফ্রন্ট আন্তর্জাতিক নৌ-টার্মিনাল দিয়ে প্রবেশের সময় দেখা যায়, একে একে শুধু বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীদের আলাদা করে একটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ওই কক্ষে পাসপোর্টগুলো নতুন করে অ্যান্ট্রি করে স্ক্যান করে নানা প্রশ্ন করা হচ্ছে। কেন আসছ সিঙ্গাপুর, নৌপথে কেন প্রবেশ করেছ, কতদিন থাকবা, কোন হোটেলে উঠবা, অন্য কোনো দেশে যাবা কিনা ইত্যাদি প্রশ্ন করা হয়। সঠিকভাবে উত্তর দিতে পারলে রক্ষা। নচেৎ ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার গ্রিন সিগন্যালের। সিঙ্গাপুরে ভ্রমণকারী চট্টগ্রামের তাজবীহ বলেন, ‘আমি এ পর্যন্ত বহু দেশ ভ্রমণ করেছি। কিন্তু সিঙ্গাপুরে প্রবেশের সময়ই যত ঝক্কি পোহাতে হয়েছে। ইমিগ্রেশনে চেকিংয়ের সময় বাংলাদেশি পাসপোর্ট হওয়ায় নিরাপত্তাকর্মীরা অন্য একটি কক্ষে নিয়ে যান। সেখানে পাসপোর্ট পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে চেক করে দেখেন নিরাপত্তায় দায়িত্বরত কর্মকর্তা। পাসপোর্টের একেকটি পাতা আলাদাভাবে স্ক্যান করে যাচাই করা হয়। অথচ অন্য দেশের পাসপোর্টধারীদের এমন ভোগান্তি পেতে হয় না।’ এদিকে ম্যারিনা বে এলাকায় প্রবাসী ইয়াসিন বলেন, আগে পুরো সিঙ্গাপুরে ঘোরাঘুরি করা গেছে। কিন্তু এখন নানা বাধাবিপত্তি পোহাতে হয়। আর এই বাধাবিপত্তি শুধু বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে। মোস্তফা সেন্টার এলাকায় ঢাকার যাত্রাবাড়ীর ইমরান বলেন, ‘সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশিদের মনোভাব নষ্ট করার উদ্দেশ্যে একটি কুচক্রী মহল জঙ্গিসংশ্লিষ্টতার ঘটনা ঘটিয়েছে। এর পর থেকে আমরা রয়েছি আতঙ্কে।’ লিলট ইন্ডিয়ায় বসবাসকারী ব্যবসায়ী আনোয়ার বলেন, বেহুদা জঙ্গি ইস্যুতে চরম আতঙ্কে দিন কাটছে এখানকার বাংলাদেশি প্রবাসীদের। আর এ আতঙ্ক কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে। পুংগুল এলাকার হোলি কনস্ট্রাকশন প্রা. লি. কোম্পানির স্বত্বাধিকারী মি. লি বলেন, জঙ্গি ইস্যুর কারণে বাংলাদেশি শ্রমিক নিয়োগে ব্যাপক যাচাই-বাছাই করতে হচ্ছে। তবে বাংলাদেশি শ্রমিকরা এমনটা করার কথা নয়। কারণ তারা খুবই দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ করেন। বাংলাদেশিরা কাজের বাইরে কিছুই বোঝেন না। বুলনে এলাকার হোয়াসিং কোম্পানির কর্মকর্তা মি. চোয়াং বলেন, ‘আমাদের কোম্পানিতে শতকরা ৬০ ভাগই বাংলাদেশি শ্রমিক।’ এদিকে আবদুস সাত্তার নামের এক প্রবাসী বলেন, ‘যারা সিঙ্গাপুরে আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে তাদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি। আর যাই হোক এরা দেশের শত্রু।

সর্বশেষ খবর