শিরোনাম
শনিবার, ২০ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

সিঙ্গাপুর প্রবাসীদের দিন কাটে কষ্টে

প্রবাসের পথে পথে ৩

শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ্, সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে

সিঙ্গাপুর প্রবাসীদের দিন কাটে কষ্টে

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অর্থনৈতিক ঊর্ধ্বগতির দেশ সিঙ্গাপুর। আর কাজের সন্ধানে এই সিঙ্গাপুর বাংলাদেশিদের প্রথম প্রছন্দ। বাংলাদেশি বেকার যুবকদের কাছে সিঙ্গাপুর যেন সোনার হরিণ। ছুঁতে পারলেই যেন ভাগ্য বদলে যায়। এই ভাগ্য বদলের দেশ সিঙ্গাপুরে কাজ করছেন হাজার হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক। দেশটির এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে হাজার হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক। কেউ বিল্ডিং কনস্ট্রাকশনে কাজ করেন, আবার কেউ ইলেকট্রিক কাজ করেন। কেউবা আবার কাজ করেন জাহাজশিল্পে। শুধু তা-ই নয়, কেউ কেউ বিভিন্ন দোকানের সেলসম্যান হিসেবেও কাজ করছেন সেখানে। সোনার হরিণ সিঙ্গাপুরে যেতে পারলেই খুলে যায় ভাগ্যের চাকা। আর এমন মনোভাবনা থেকে বাংলাদেশের হাজার হাজার বেকার যুবক পাড়ি জমান সিঙ্গাপুরে। সিঙ্গাপুরে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা রয়েছে ব্যাপক। সেখানে বাংলাদেশি শ্রমিকের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। ম্যারিনা বে, সন্তোসা, জরোং বার্ড পার্ক, মোস্তফা সেন্টার, লিটল ইন্ডিয়া, সিরাংগং, হারবারফ্রন্ট, উডল্যান্ড, ফিরার পার্ক, কেলাং বা পেয়ালিবির—কোথায় নেই বাংলাদেশি শ্রমিক। তবে চাহিদা থাকলেও বড় কষ্টে আছেন এখানকার বাংলাদেশি শ্রমিকরা। প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এমনই নানা কষ্টের কথা। কথা হয় টাঙ্গাইলের কালিহাতী এলাকার মিনহাজের সঙ্গে। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তিনি বলেন, ‘দেশের বাড়িতে বেশ আরাম-আয়েশে দিন কাটাতাম। থাকতাম একা একটা ঘরে। মা-বাবার কাছ থেকে চেয়ে টাকা নিয়ে গঞ্জে গিয়ে এটা-ওটা কিনে খেতাম। মাকে না জানিয়ে ঘর থেকে চাল দিয়ে আইসক্রিমও খেতাম। ঘরের মাচাঙ থেকে কাউকে না বলে পাট নিয়ে বাজারে বিক্রি করে দেখতাম সিনেমা। আরও কত কি করতাম তার কোনো ইয়ত্তা ছিল না। আর এসব করতে গিয়ে মার বকুনি খেতাম প্রতিনিয়ত। আজ সেসব কথা মনে করে বড় কষ্ট লাগে বুকে। এলাকার অন্য ছেলেদের মতো ভাগ্যের চাকা বদলানোর স্বপ্ন দেখি। আর ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে আসি দূরদেশ সিঙ্গাপুরে। ভাগ্যের চাকা হয়তো ঘুরেছে। কিন্তু এ জন্য জীবনে যে কত কষ্ট পোহাতে হয়েছে তা বলে বোঝানো সম্ভব না। দেশ থেকে বাবা-মা বলেন টাকা পাঠাতে। তাদের কথা রাখতে গিয়ে নিজে খেয়ে না খেয়ে টাকা ঠিকই পাঠাই। বিদেশের মাটিতে আমরা বাংলাদেশি শ্রমিকরা কতটা কষ্টে উপার্জন করি তা কেউ জানে না। এর খোঁজও নেয় না কেউ।’ কথাগুলো বলার সময় মিনহাজের দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছিল। মিনহাজ বলেন, সেই কাকডাকা ভোরে ঘুম ভাঙে। চোখে ঘুম রেখে কোনোমতে একটু নাশতা খাই। ঠিক সময়ে কোম্পানির গাড়ি বাসার সামনে চলে আসে। গাড়ির পেছনে বসে ঝিমাতে ঝিমাতে চলে যাই কর্মস্থলে। মাঝখানে দুপুরে ঘণ্টাখানেক সময় পাই। আর তখনই ঝটপট খাবার খেয়ে গাছতলায় শুয়ে একটু নিদ্রা যাই। ঠিক এক ঘণ্টা পর আবার কাজে যোগ দিই। কাজ শেষে প্রায় দিনই রাত সাড়ে ৯টা কিংবা ১০টার দিকে বাসায় এসে একটু রান্না করে দুটো খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। এখানে ঘুমানো যে কত কষ্ট তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। একটি ছোট্ট ঘরে ১০ জন শ্রমিক থাকি। বেডগুলো দোতলা সিস্টেম। এটি কোনোমতে রাত কাটানো ছাড়া কিছুই নয়।’ শুধু মিনহাজ নন, এমন অবস্থা সিঙ্গাপুর প্রবাসী বাংলাদেশি হাজার হাজার শ্রমিকের। সিঙ্গাপুর সরকারের ওয়াটার প্লান্টেশন প্রোগ্রামে বাংলাদেশ প্রতিদিনের পক্ষে যোগ দিয়ে এমন চিত্র সরেজমিন উঠে আসে। ১০ আগস্ট রাত সাড়ে ৯টার দিকে মোস্তফা সেন্টারের সামনে দেখা হয় গাজীপুরের কাপাসিয়ার সাফাইশ্রী গ্রামের আবদুস সোবহানের সঙ্গে। কথা হয় দেশের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। আমাকে কাছে পেয়ে তিনি যেন পুরো বাংলাদেশকে পেয়েছেন। খুশিতে যেন আত্মহারা। গল্পের ফাঁকে সোবহান আমাকে নিয়ে যান তার বাসায়। মোস্তফা সেন্টারের সামনের গলিতেই থাকেন তিনি। বাসায় গিয়ে দেখা যায়, একটি ছোট্ট খুপরিঘর। ভেতরে গাদাগাদি করে দোতলা ছয়টি বেড। কোনোমতে থাকেন ছয়জন। কক্ষে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর জায়গাটুকু নেই। সোবহানের বেডের ওপর থাকেন একই গ্রামের শফিকুল। তিনি ৯ বছর ধরে সিঙ্গাপুরে আছেন। কক্ষের অন্যরাও আছেন দীর্ঘদিন। এ সময় শফিকুল বলেন, ‘ভাই, কী করব। সেই যে কবে আসছি। মা-বাবাকে দেখতে পারি না। মাঝেমধ্যে ফোনে কথা হলেও সরাসরি দেখার সুযোগ নেই।’ পাশের বেডের আশ্রাফ বলেন, ‘এত কষ্ট করে সিঙ্গাপুরে আছি বাড়ির কেউ তা জানে না। গত মাসে ছোট বোন বায়না ধরেছে একটি দামি মোবাইল ফোন দিতে। কিন্তু কোত্থেকে দিই। মাস শেষ হলেই বেতনের টাকা পাঠিয়ে দিতে হয় বাড়ি। এর ওপর দামি মোবাইল ফোন কীভাবে কিনি বলেন। দেশের মানুষ জানে সিঙ্গাপুর মানেই টাকা আর টাকা। কিন্তু এই টাকার জন্য কতটা কষ্ট করতে হয় সে খবর কেউ রাখে না।’ এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশি শ্রমিকদের বেশির ভাগই দৈনিক ১৬ ডলার বেসিকে কাজ করেন। কেউ কেউ এর বেশিও পান। ঊর্ধ্বগতির এ বাজারে ১৬ ডলারে কিছুই হয় না। চলতে-ফিরতে একটু-আধটু কিছু কেনা হলেই চড়া মূল্য দিতে হয়। এখানে ছোট্ট এক বোতল (৫০০ গ্রাম) পানির দাম দুই ডলার। এক বেলা খাবার খেলে সাত-আট ডলারের বেশি খরচ হয়। বাসায় রান্না করে খেলেও খুব একটা খরচ কম হয় না। সিঙ্গাপুরে চাল, ডাল, মাছ, মাংস, তরকারিসহ সব পণ্যের দাম অনেক বেশি।’

সর্বশেষ খবর