রবিবার, ২১ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

মানব পাচারের খপ্পরে নিঃস্ব মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশিরা

প্রবাসের পথে পথে ৪

শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ্, মালয়েশিয়া থেকে ফিরে

মানব পাচারের খপ্পরে নিঃস্ব মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশিরা

সাগর কিংবা বিমান—কোনো পথেই মালয়েশিয়ায় মানব পাচার যেন বন্ধ নেই। অনেকটা ফ্রিস্টাইলে মানব পাচার হচ্ছে মালয়েশিয়ায়। আর এসব অবৈধ অভিবাসীরা মালয়েশিয়ায় কাজ পেলেও পাচারকারীর খপ্পরে পড়ে এখন নিঃস্ব অনেকেই। কেউবা লোক মারফত ভিসা পারমিট করে বৈধ হয়েছেন। কিন্তু সমস্যা শুধু অবৈধ বা ভিসা ছাড়া বাংলাদেশি শ্রমিকদের। আর এই অবৈধ শ্রমিকদের চিহ্নিত করে একটি মানব পাচার চক্র বিভিন্নভাবে হয়রানি করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান করে এসব মানব পাচারকারী চক্র বাংলাদেশিদের করে বেড়াচ্ছেন নানা হয়রানি। অবৈধতার সুযোগ নিয়ে ভিসা পারমিট ও পাসপোর্ট করে দেওয়ার কথা বলে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। আর এতে প্রতারিত হচ্ছেন মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত বিভিন্ন পেশার প্রবাসী বাংলাদেশিরা। জাল ভিসা, ভুয়া পারমিট বানিয়ে প্রতারণার জাল পেতেছে ওই চক্রটি। চক্রের সদস্যরা সারা দিনই মালয়েশিয়ার বাংলা টাউন, চায়না টাউন, হানিফ মার্কেট, জিএম প্লাজা, কেএলসি টাওয়ার বা আশপাশ এলাকায় ঘোরাঘুরি করে বাংলাদেশিদের প্রতারণার জালে আটকায়। আর এসব চক্রের মিষ্টি কথায় আকৃষ্ট হয়ে জালে ধরা দেন শত শত বাংলাদেশি। এমনই একটি পাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব খুইয়েছেন গাজীপুরের কাপাসিয়ার উত্তর খামের এলাকার মো. ছানাউল্লাহ। শুধু সর্বস্ব খুইয়েছেন তা নয়, জেল খেটে জীবন মরণাপন্ন বানিয়ে এখন দেশে এসে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। দীর্ঘ সাত মাসের জেলজীবনে ইলেকট্রিক শকও দিয়েছে মালয়েশিয়া কারাগার। শুধু ছানাউল্লাহ নন, অনেক বাংলাদেশি শ্রমিকের ভাগ্যে ঘটেছে এমন মর্মান্তিক ঘটনা। গত কয়েক দিন মালয়েশিয়ায় বেসরকারি একটি সেমিনারে যোগ দিয়ে বাংলাদেশি প্রবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য। ভুক্তভোগী ছানাউল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এস এম সহিদ নামের মানব পাচারকারীর মাধ্যমে গত বছরের কোরবানি ঈদের সময় কাজের সন্ধানে মালয়েশিয়া আসি। কিন্তু এখানে আসার পর জানতে পারি আমাকে পিসি (অন্যজনের পাসপোর্টে ছবি লাগিয়ে) ভিসা দিয়ে আনা হয়েছে। বৈধভাবে আসার টাকা খরচ করে হয়েছি অবৈধ। পাচারকারী এস এম সহিদ আমার আত্মীয় হওয়ার পরও এমনটা করেছেন। কিন্তু চুপি চুপি মাস দুয়েক কাজ করার পর ধরা পড়ি মালয়েশিয়ান পুলিশের হাতে। পরে সাত মাস জেল খাটতে হয়। মালয়েশিয়ার জেলজীবন কতটা ভয়ানক ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। জেলে থাকার সময় আমাকে রতান দিয়েছে। রতান হচ্ছে পিঠের মেরুদণ্ডের ঠিক নিচের অংশে ইলেকট্রিক শক দেওয়া। এই শক দেওয়ার পর ওই ব্যক্তি বেঁচে থাকলে বাকি জীবনে কাজ করার সব শক্তি হারিয়ে ফেলেন। অনেক চিকিৎসা করিয়েও শরীরের কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না।’

তিনি বলেন, শুধু সহিদই নয়, সঙ্গে রয়েছে তার ছোট ভাই মতি রায়হান। মালয়েশিয়ার চক্রটি পরিচালনা করেন মতি। ছানাউল্লাহর মতো এমন শত শত বাংলাদেশি শ্রমিক রয়েছেন, যারা এই প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়ে এখন নিঃস্ব। তেমনি নরসিংদীর মনোহরদীর কোচেরচর এলাকার খোরশেদ। কাপাসিয়ার বারিষাব ইউনিয়নের গাওরাইট এলাকার ইব্রাহিম। ইব্রাহিম বলেন, ‘আমাকেও জাল ভিসা দিয়ে মালয়েশিয়া পাঠায় ওই চক্র। কিন্তু মালয়েশিয়ায় সহিদের ভাই মতি আমাকে রিসিভ করে তার কেএল জসকো সুপার মার্কেট এলাকার বাসায় আটকে রাখেন। পরে বাড়িতে ফোন দিয়ে টাকা দাবি করে। মতি বলেন, টাকা না দিলে তিনি পুলিশে ধরিয়ে দেবেন। অথবা চীনাদের হাতে দিয়ে দেবেন। শুধু এরাই নয়, কাপাসিয়ার কান্দানিয়া গ্রামের মো. বিল্লাল, বারিষাবর পেচুরদিয়ার সামসুদ্দিনের ছেলে মাজহারুল, কান্দানিয়া গ্রামের কাশেম, চাপাত গ্রামের সোহরাব, বরহর গ্রামের রহমানের ছেলে রুহুল আমিন আবদুল্লাহ, রানীগঞ্জ এলাকার বালু ব্যবসায়ী জহিরের ভাগ্নে আলমগীর হোসেন, ফুলবাড়িয়ার ইউনুছ মার্কেট এলাকার মো. শামীম, কান্দানিয়া গ্রামের রাসেল, রাউেকানা গ্রামের সবুজ, পাকিয়াব গ্রামের সোহাগ, রাজেন্দ্রপুরের সোহেল, বড়হরের আবদল্লাহর মতো শত শত বাংলাদেশি রয়েছেন, যারা পাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব হারিয়েছেন। মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত সামসুদ্দিন বলেন, ‘আমি আমার ছেলে মাজহারুলকে সহিদের মাধ্যমে ৫ লাখ টাকা দিয়ে এনেছি। কিন্তু তাকে জাল ভিসা দেওয়া হয়েছে। এ জন্য সহিদকে ফোন দিলে সে নানা হুমকি দিচ্ছে।’ এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু মানব পাচার নয়, এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মালয়েশিয়া থেকে বড় বড় সোনার চোরাচালানও আসছে বাংলাদেশে। আর এই সিন্ডিকেটের মূল নায়ক সহোদর দুই ভাই এস এম সহিদ ও মতি রায়হান। এই চক্রটির সাংকেতিক নাম হলো এস এম। আর এই বাহিনী খোদ রাজধানী ঢাকায় গড়ে তুলেছে মানব পাচার ও সোনা চোরাচালানের সবচেয়ে বড় নেটওয়ার্ক। নিজেরাই গড়ে তুলেছেন এক ভয়াবহ মানব পাচারের সিন্ডিকেট। এদের রয়েছে দেশের ৬৪ জেলাতেই নিজস্ব সিন্ডিকেট। রয়েছে পাড়া-মহল্লায় দালাল। আর এসব দালাল মালয়েশিয়া যেতে আগ্রহীদের এনে জড়ো করেন গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায়। কাপাসিয়া শহরের ঝুমকা স্টুডিওতে তারা নিজেরাই বানিয়েছেন একটি মালয়েশিয়াগামী যাত্রীস্থল। তারা গাজীপুর শহরের কোর্ট বিল্ডিং এলাকার হাক্কানী হাউজিং প্রকল্পের একটি ফ্ল্যাটে মালয়েশিয়াগামী যাত্রীদের। এ ছাড়া একাধিক নিজস্ব হলরুমে রাখেন মালয়েশিয়াগামী যাত্রীদের। আর এসব মালয়েশিয়াগামী যাত্রীদের তারা কক্সবাজারের টেকনাফ দিয়ে সাগরপথে কিংবা শাহজালাল বিমানবন্দর দিয়ে বিমানপথে পাচার করেন। এসব পাচারের জন্য নিজেরাই পাসপোর্ট-ভিসা তৈরি করেন তারা। পাসপোর্টে নিজেরাই সিল মেরে ভিসা লাগান। আর এসব ভিসা লাগাতে যেতে হয় না মালয়েশিয়া হাইকমিশন বা সংশ্লিষ্ট কোনো অফিসে। নিজেরাই ভিসা লাগানোর সব সরঞ্জামাদি বানিয়ে নিজেরাই ভিসা লাগান মালয়েশিয়াগামী যাত্রীদের পাসপোর্টে। আর এসব নকল ভিসা লাগানো পাসপোর্ট দেখিয়ে অনায়াসেই মালয়েশিয়াতে পাঠানো হয় হাজার হাজার বাংলাদেশিদের। প্রতি মাসে অন্তত ১৫০-২৫০ জন পাঠিয়ে থাকেন এভাবে। শুধু কী নকল ভিসা-পাসপোর্টই বানান তা নয়। এই সিন্ডিকেট নিজেরা একেকটি পিসি পাসপোর্ট দিয়ে অন্তত শখানেক মালয়েশিয়াগামী যাত্রীদের বিমানবন্দর দিয়ে মালয়েশিয়া পাচার করছেন। আর এসব অবৈধভাবে মানব পাচারের সিন্ডিকেট তৈরি করে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। শুধু কী তাই। মালয়েশিয়াতে এদের রয়েছে কয়েকটি টর্চার সেল। এসব টর্চার সেলে নিয়ে যাত্রীদের আটকে রাখেন দিনের পর দিন। মোটা অঙ্কের টাকা না দেওয়া পর্যন্ত আটক রাখা সাধারণ যাত্রীদেরকে করা হয় নানা ধরনের নির্যাতন। এমনকি এসব মানুষকে দিনের পর দিন না খাইয়েও রাখা হয় টর্চার সেলে। যাও দু-একজন টাকা দিয়ে নির্যাতন থেকে রেহাই পেতেন। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হতো না তাদের। কারণ তাদের পরে মালয়েশিয়ার গভীর জঙ্গলে, পাহাড়ে নিয়ে কাজ করানো হয়। অপরদিকে বাংলাদেশ থেকে সাধারণ মানুষদের ফুসলায়ে নিয়ে গেলেও এসব যাত্রীদের কাছ থেকে পাসপোর্ট-ভিসা কেরে নেয় ওই সিন্ডিকেট। পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়া অচেনা মালয়েশিয়াতে বিপাকে পড়েন মালয়েশিয়াগামী ওই যাত্রীরা। শুধু তাই নয়, মালয়েশিয়া নিয়ে কাজ দেওয়ার কথা থাকলেও কোনো কাজের ব্যবস্থা করে দেয়নি। সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়ে এক অমানবিক জীবনযাপন করতে হচ্ছে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়া হাজার হাজার সাধারণ মানুষের।

এই সিন্ডিকেট ঢাকার ফকিরাপুল, পল্টন, বাড্ডা, রামপুরা, মতিঝিলসহ বিভিন্ন এলাকার ট্রাভেল এজেন্সি বা মালয়েশিয়া যাওয়া-সংক্রান্ত অফিসগুলোতে এসএম নামে পরিচিত। এসব এলাকার চিহ্নিত কিছু অফিস, খাবারের হোটেল, পানের দোকানে এসএম সাংকেতিক নাম ব্যবহার করে যাত্রীদের কাছ থেকে বিমান ভাড়া নেওয়া থেকে শুরু করে সব লেনদেনই করেন তারা। মাঝে মধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়লে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে নেন। কিন্তু সহিদ বা মতিকে কখনোই পুলিশ ধরে না। তারা বাংলাদেশ বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনের কিছু কর্মকর্তার সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ রাখেন। এই সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে এখন শত শত মালয়েশিয়াগামী সাধারণ মানুষ নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। জমিজমা, সহায়-সম্বল বিক্রি করে রাস্তায় বসেছে অনেক পরিবার। কাপাসিয়ার খোদাদিয়া গ্রামের এক ভুক্তভোগী মালয়েশিয়াগামী যাত্রীর স্বজন (ছদ্মনাম) বলেন, ‘আমার ছোট ভাইকে সহিদের সুন্দর সুন্দর কথায় রাজি হয়ে মালয়েশিয়া পাঠাই। কিন্তু আমার ছোট ভাই এখন মালয়েশিয়ার পাহাড়ে অনেক কষ্টে রয়েছে। আমি বারবার সহিদকে বললেও তিনি এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপই নেননি।’ ১৩ মাস মালয়েশিয়ার বনে-জঙ্গলে থেকে দেশে এসে জুনিয়া গ্রামের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনৈক ব্যক্তি বলেন, ‘আমি নিজে সহিদ ও মতির কথায় মালয়েশিয়ায় গিয়ে ১৩ মাস জেলের চেয়ে ভয়ানক জীবন কাটিয়েছি। পরে কোনোমতে বাড়ি থেকে কিছু টাকা নিয়ে দেশে চলে আসি।’ তিনি বলেন, সহিদ-মতির মালয়েশিয়ায় কয়েকটি টর্চার সেল রয়েছে। সেখানে সাধারণ যাত্রীদের আটকে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করেন তারা। এমনকি মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত বাংলাদেশিদের পুলিশ দিয়ে বিভিন্নভাবে হয়রানি করে সুবিধা আদায় করেন তারা দুই ভাই। গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার বাঘিয়া-খালেরঘাট এলাকার হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান এই সহিদ ও মতি। অর্থের অভাবে পড়াশোনায় প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোতে পারেননি। নিজেরা শীতলক্ষ্যা নদীর ঘাটে নৌকা পারাপার করতেন। অভাব-অনটন লেগেই থাকত এই পরিবারে। এমনকি বাজারে বাজারে কবুতর ও ছাগল বেচাকেনাও করতেন তারা। একসময় এলাকার এক আদম পাচারকারী দালাল ধরে প্রথমে সহিদ মালয়েশিয়ায় যান। পরে সহিদ তার ছোট ভাই মতিকেও মালয়েশিয়া নিয়ে যান। মালয়েশিয়ায় গিয়ে দীর্ঘ সময় ছিলেন এই সহোদর। আর এই মালয়েশিয়া যাত্রাই তাদের জীবনের চাকা পাল্টে দেয়। তারা আওতায় নেন মানব পাচারের ব্যবসা। আর এখন লাখ লাখ টাকা নয়, মাসে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন তারা অসহায় মানুষদের কাছ থেকে। ঢাকা, গাজীপুর, মাওনা, শ্রীপুর, কাপাসিয়ায় রয়েছে তাদের দামি দামি ফ্ল্যাট ও জমি। রাজধানী ঢাকা, গাজীপুর, শ্রীপুর, মাওনা, কাপাসিয়া এলাকায় দামি গাড়িতে চরে দাবড়ে বেড়ান। কয়েক দিন পর পর গাড়ির মডেল পাল্টানো তাদের ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, মতি ইন্দোনেশিয়ায় গড়ে তুলেছেন বিশাল অট্টালিকা। ইন্দোনেশিয়ায় রয়েছে তার গাড়ির ব্যবসা।

সর্বশেষ খবর