শিরোনাম
রবিবার, ২১ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

খালেদাকে খোলা চিঠি জাফরুল্লাহর

দলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও ‘জনগণের সনদ’ তৈরির পরামর্শ

নিজস্ব প্রতিবেদক

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে খোলা চিঠি দিয়েছেন। ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে, খোলা চিঠি-২’ শিরোনামের এই চিঠিতে তিনি বিএনপির ভিতরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও ‘জনগণের সনদ’ তৈরি করে আন্দোলন গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছেন। খোলা চিঠিতে জাফরুল্লাহ বেগম জিয়ার সঙ্গে পরিচয়, বিএনপির সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, কমিটি গঠন ও এর চুলচেরা বিশ্লেষণ, সরকারবিরোধী আন্দোলন, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ইত্যাদি তুলে ধরেছেন। সাংবাদিকদের কাছে ইমেইলে পাঠানো এই খোলা চিঠিতে ‘আপনার হাতে বেশি সময় নেই’ বেগম জিয়াকে এমন সতর্কবার্তা দিয়ে জাফরুল্লাহ বলেছেন, ২০ দলের বাইরের বিরোধী দলসমূহকে একত্রিত করে বাংলাদেশে জবাবদিহিতামূলক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সুসংহত করার জন্য আপনার হাতে সময় আছে বড়জোর নয় মাস। সম্ভবত এই সময়ের মধ্যে আপনার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলায় রাজনীতির আলোকে বিচারের রায় বেরোবে। এই কয়েক মাস পরিশ্রম করলে জনগণের রায় আপনার পক্ষে আসার সম্ভাবনা সমধিক। ১৫ আগস্ট জন্মদিন পালন না করে বেগম জিয়া প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন মন্তব্য করে জাফরুল্লাহ বলেন, দেশের সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনা করে ১৫ আগস্ট আপনার জন্মদিন অনুষ্ঠান বাতিল করে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দেখিয়েছেন। এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কী মন্তব্য করেছেন তাতে কিছু যায় আসে না। আপনি জিতেছেন। বিএনপির ভুল নিয়ে লিখতে গিয়ে এই মুক্তিযোদ্ধা লেখেন, ৩৮ বছরের বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলের সাড়ে চার মাস পরে জাতীয় নির্বাহী কমিটি ঘোষণা, কমিটির বড় সাইজ বা ক্রমানুক্রমে বয়োজ্যেষ্ঠতার হিসাব না মানা কিংবা পর্যাপ্ত নারী নেত্রীর স্থান না হওয়া অথবা নবীন-তরুণদের সংখ্যাধিক্য ভুল কাজ নয়। ভুলটা হয়েছে অন্য জায়গায়। আপনার দলের কিছু চাটুকার দায়িত্ব পালনে অনিচ্ছুক, সরকারের দমননীতিতে ভীতসন্ত্রস্ত সিনিয়র নেতৃবৃন্দ যারা সম্ভবত হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর তৈলের প্রাসঙ্গিকতা ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম করে দলের মহাসচিব থেকে শুরু করে পুরো জাতীয় কমিটির মনোনয়নের দায়িত্ব আপনার ওপর চাপিয়ে দিয়ে আপনাকে আপাতদৃষ্টিতে বিশ্বাস ও সম্মান প্রদর্শন মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা তাদের দলের প্রতি আনুগত্যের অভাব ও দায়িত্ব এড়ানোর প্রচেষ্টা মাত্র এবং আপনাকে সবার চোখে আপনার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার প্রমাণের সূক্ষ্ম প্রক্রিয়া। এসব নেতা প্রকৃতপক্ষে ভীত মেষ শাবক সমতুল্য। বিভিন্ন অজুহাতে তারা আপনাকে আন্দোলনের পথে না নিয়ে গুলশানের দুই বাড়িতে অন্তরীণ করে রেখেছেন। তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, আপনার স্থায়ী কমিটির নেতাদের উচিত ছিল আপনাকে অযথা তেল না দিয়ে, গঠনতন্ত্রের নির্ধারিত বিষয়সমূহ আপনার সামনে তুলে ধরা এবং গঠনতন্ত্র মোতাবেক আপনার ক্ষমতা সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য দেওয়া। তিনি বলেন, জিয়াউর রহমান বিএনপি সৃষ্টির পেছনে ২৯টি লক্ষ্য ও আদর্শ অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন, যার ১৭টি গঠনতন্ত্রে রয়েছে। কোথাও বলা হয়নি বা লেখা হয়নি যে, চেয়ারপারসন একলা সব কমিটির সদস্য মনোনয়ন দেবেন। একলা দু-তিন জন কাছের মানুষের কানকথা শুনে এত বড় একটা জাতীয় কমিটি গঠন করার পরও সবার মন রক্ষা করতে পারেননি। যার কারণে যুগ্ম মহাসচিব সাতজনের মধ্যে একজন মহিলাও নেই, আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক সম্পাদকের ক্ষেত্রে সাতজনের মধ্যে একজনও মহিলা নেত্রী নেই। ধর্ম বিষয়ে তিনজন সহসম্পাদকের যৌক্তিকতা নিয়েও তিনি প্রশ্ন তোলেন। একই সঙ্গে তিনি বলেন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলে ১৫ জন উপদেষ্টা থাকার কথা, তাই বলে কি অতিরিক্ত ৫৮ জন উপদেষ্টা! অধ্যাপক এমাজউদ্দীনকে খালেদা জিয়ার প্রধান উপদেষ্টা করলে বিএনপির লাভ হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। খালেদা জিয়ার সবচেয়ে বড় ভুল চিহ্নিত করতে গিয়ে বিএনপিপন্থি এই বুদ্ধিজীবী বলেন, আপনি (খালেদা জিয়া) সবচেয়ে বড় ভুল করেছেন, আপনার গঠনতন্ত্রের নির্দেশ মোতাবেক ইউনিয়ন, উপজেলা, পৌরসভা ও মহানগর কমিটি, নারী দল, ছাত্রদল ও অন্যান্য অঙ্গসংগঠনে দুই বছর পরপর যথাযথভাবে নির্বাচন করে উৎসাহী কর্মীদের বিভিন্ন পদে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ না দেওয়া। ঘরকুনো কর্মীরা সন্ধ্যায় আপনার গুলশান অফিসে ভিড় করবে, কিন্তু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আপনার ডাকে মাঠে নামবে না। এরা সুখের পায়রা এবং কতক বয়োবৃদ্ধ। বিএনপি জাতীয় কমিটিতে পরিবারতন্ত্র জিন্দাবাদ— ১০ নেতার স্ত্রী, ১১ নেতার ছেলে, ৬ ভাইবোন স্থান পেয়েছেন অথচ শিষ্টাচার বজায় রেখে যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও আপনি ছেলের বউকে জাতীয় স্থায়ী কমিটিতে স্থান দেননি। স্থায়ী কমিটিতে কমপক্ষে চারজন মহিলা রেখে গঠনতন্ত্র সংশোধন করে সেখানে প্রয়োজনে ২৫ জন করলে আপত্তি কোথায়? সদস্যরা পার্টির অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের ভিত্তিতে দু-তিন বছরের জন্য নির্বাচিত হবেন, মনোনীত নন। চেয়ারপারসনের মনোনয়নে আসবেন তিন-চার জন মাত্র। জাতীয় কমিটিতে ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধী আবদুল আলীম ও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর স্থান অযৌক্তিক ও ভুল সিদ্ধান্ত। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে তো কোনো দলীয় রাজনীতিতে নেই। খালেদা জিয়াকে তার করণীর কী তা বাতলে দিয়ে জাফরুল্লাহ বলেন, জরুরি ভিত্তিতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ঘোষণা ও গঠণতন্ত্রের সংশোধন প্রয়োজন। এই নিমিত্ত অধ্যাপক এমাজউদ্দীন, দিলারা চৌধুরী, আসিফ নজরুল, মাহবুব উল্লাহ প্রমুখকে দিয়ে কমিটি করে দিন, সময় দিন ১৫ দিন। তাদের সুপারিশসমূহ আলোচনা করুন জাতীয় কাউন্সিল ও স্থায়ী কমিটির জরুরি মিটিংয়ে। পরপরই ইউনিয়ন, উপজেলা ও মহানগর কমিটিসমূহ এবং ছাত্রদল, নারী দল ও শ্রমিক দলে নির্বাচন দিন। ২৫ বছরের অধিক বয়সী কেউ ছাত্রদলের নেতৃত্বে থাকবে না। পার্টিতে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করুন। তিনি আরও বলেন, দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, সিনিয়র নেতা, ছাত্রদল, যুবদল ও মহিলা নেত্রীদের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করে ‘জনগণের সনদ’ স্থির করা। জনগণের সদস্যদের রূপরেখার খসড়া দুই মাসের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা করে চূড়ান্ত করুন। এই সনদের মধ্যে রয়েছে সামরিক বাহিনীর দরে সকল শ্রমিক ও দরিদ্র পরিবারদের রেশন সুবিধা প্রদান, প্রতিটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রে শুরুতে দুজন এবং ২০২৫ সালের মধ্যে চারজন গ্র্যাজুয়েট ডাক্তারের সার্বক্ষণিক অবস্থান নিশ্চিতকরণ।  গণভোটের মাধ্যমে জনগণের মতামত নিয়ে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে সারা বাংলাদেশকে ১০টি প্রদেশ বা ১৭টি স্টেটে ভাগ করে নির্বাচিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি। কোনো রাজনৈতিক কর্মী সরাসরি খুনে জড়িত না হলে, অভিযুক্ত রাজনৈতিক কর্মী এক মাসের মধ্যে জামিন পাবে। ভারতীয় সংস্কৃতি ও বাণিজ্যিক আগ্রাসন থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশাপাশি পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করা হবে প্রতিবেশী ভারত থেকে, নতুবা কোনো ট্রানজিট নয়। ‘হাতে সময় নেই’ অংশে তিনি অন্যান্য বিরোধী দলকে একত্র করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, অচিরে জাতীয় নির্বাচনের লক্ষ্যে সম্মিলিত বিরোধী দল হিসেবে অংশগ্রহণের আকাঙ্ক্ষায় বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, ড. কামাল হোসেন, অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী, নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না, বাসদের খালেকুজ্জামান, জাসদের আ স ম আবদুর রব প্রমুখকে সঙ্গে নিয়ে এক মাসের মধ্যে প্রথম জনসভায় অংশগ্রহণের ঘোষণা দিন। বিএনপির বর্তমান জোটের নেতারা তো থাকছেনই, আপনি জেলে থাকলেও সম্মিলিত বিরোধী দলের বিজয় সুনিশ্চিত। কেন্দ্রিকতা নয়, নির্বাচিত স্থানীয় সরকারই লক্ষ্য।

সর্বশেষ খবর