বুধবার, ২৪ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসন সংকট চরমে

গাদাগাদি করে থাকতে হয় গণরুমে। নিয়ন্ত্রণ ছাত্রনেতাদের হাতে

আকতারুজ্জামান

দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আবাসন সংকট চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। এই বিদ্যাপীঠগুলোর বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই আবাসন সুবিধা থেকে বঞ্চিত। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা শেষ করতে হচ্ছে হল জীবনের স্বাদ না পেয়েই। সম্পূর্ণ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীও আবাসন সুবিধা পাচ্ছেন না। অনেককেই গাদাগাদি করে থাকতে হয় গণরুমে। এ ছাড়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসনের কোনো ব্যবস্থাই নেই। বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়েই হলের আসন নিয়ন্ত্রিত হয় ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনগুলোর মাধ্যমে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈধভাবে শিক্ষার্থীরা আবাসনের সুযোগ পেলেও হলে উঠতে হয় ছাত্র নেতাদের অনুগ্রহে। হলে ওঠার পর বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ার চাপ তো রয়েছেই। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ (২০১৪) প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ৩৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বাদে) ২ লাখ ৩১ হাজার ৬৯০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে আবাসন সুবিধা রয়েছে মাত্র ৮০ হাজার ৩১৪ জন শিক্ষার্থীর। প্রতিবেদন অনুযায়ী শতকরা ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থীই আবাসন সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৮টি আবাসিক হল ও দুটি ছাত্রাবাস রয়েছে। এক বছর আগে এক হাজার আসন বিশিষ্ট ‘বিজয় একাত্তর’ চালু হয়েছে। প্রায় ১৫-২০ হাজার শিক্ষার্থীর আবাসন ব্যবস্থা হলেও বাকি অর্ধেক শিক্ষার্থীর জন্য কোনো আবাসনের ব্যবস্থা নেই। প্রতি বছর শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়লেও বাড়ছে না আসন সংখ্যা। ফলে এর প্রভাব পড়ছে পড়াশোনা থেকে শুরু করে সামগ্রিক জীবনযাত্রায়। জানা গেছে, আবাসন সমস্যার কারণে কোনো কোনো হলের অবস্থা উদ্বাস্তু শিবিরের পরিবেশকেও হার মানায়। গণরুমগুলোতে আটজনের বিপরীতে থাকছে অন্তত ২০-৩০ জন। অনেকেই রাত কাটায় হলের বারান্দায় এবং মসজিদে। হলগুলোতে ধারণক্ষমতার প্রায় দ্বিগুণ শিক্ষার্থী বসবাস করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী শহীদুল্লাহ হলে ১ হাজার ২২৫ জন, ফজলুল হক মুসলিম হলে ৭৬৬, জগন্নাথ হলে ১ হাজার ৭২২, সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ৮০৫, জহুরুল হক হলে ১ হাজার ৩২৫, সূর্যসেন হলে ১ হাজার ৭৪, হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হলে ৫৪২, কবি জসীমউদ্?দীন হলে ৭৬৯, স্যার এফ রহমান হলে ৬০২, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে ৭০৩, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে ৯৩৪, অমর একুশে হলে ৬১০, রোকেয়া হলে ১ হাজার ৬০০, শামসুন্নাহার হলে ১ হাজার ৩৫০, কুয়েত মৈত্রী হলে ২ হাজার ৬১, স্যার পিজে হার্টগ ইন্টারন্যাশনাল হলে ১১৯, বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে ১ হাজার ১৫০ জন এবং নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী ছাত্রী নিবাসে ১৬০ জন শিক্ষার্থী আবাসিক সুবিধা পাচ্ছে। সূর্যসেন হলে অন্তত ১২টি, এ এফ রহমান হলে ৫টি, জহুরুল হক হলে ১০টি, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে ৮টি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে ৯টি, জসীমউদ্দীন হলে ১১টি, মুহসীন হলে ১৩টি, রোকেয়া হলে ২টি, কুয়েত  মৈত্রী হলে ৪টি এবং ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে ৩টি গণরুম রয়েছে। এসব রুমে গাদাগাদি করে থাকছেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, হল প্রশাসনের তদারকির অভাবে সিট বণ্টনে নানা বৈষম্যের শিকার হতে হয় তাদের। অনেক হলে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নেতারা সিট নিয়ে নানা বাণিজ্য করছে। অনেক নেতা হলে সিট ভাড়াও দিয়ে থাকেন। এ ছাড়া সিট বণ্টনকে ব্যবহার করা হচ্ছে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে। একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সংকট তীব্র আকার ধারণ করছে। সর্বমোট ১৩টি হল থাকলেও প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরা হলে আসন পায় দ্বিতীয় বা তৃতীয় বর্ষে। আসন পাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত গণরুমে থাকতে হয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ২০ হাজার শিক্ষার্থী থাকলেও আবাসন সুবিধা নেই। ১১ বছরে প্রশাসন আবাসনের কোনো ব্যবস্থা করতে পারেনি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের জন্য ১১টি ও ছাত্রীদের জন্য ৬টি হল রয়েছে। তবে প্রায় দ্বিগুণ শিক্ষার্থী হলগুলোতে অবস্থান করছে। প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষে হলের ডরমেটরিতে অবস্থান করতে হয়। প্রতি ডরমেটরির গণরুমে প্রায় ৮০ জন ছাত্রী থাকেন। তৃতীয় বর্ষের আগে হলে আসন বরাদ্দ পান না ছাত্রীরা। শেষ বর্ষের আগে সিঙ্গেল রুম বরাদ্দ না পাওয়ার নিয়ম থাকলেও ছাত্রলীগ নেতাদের গার্লফ্রেন্ড হওয়ার সুবাদে প্রথম বর্ষেই অনেক ছাত্রীই সিঙ্গেল রুম বাগিয়ে নেন বলে অভিযোগ আছে। আর ছাত্ররা আসন বরাদ্দ পাওয়ার পরও হলে উঠতে হয় ছাত্রলীগের হাত ধরেই। হলে ওঠার পর বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রোগ্রামে যোগ দেওয়ার চাপ থাকে শিক্ষার্থীদের। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রাশেদুল ইসলাম রঞ্জু বলেন, দলীয় প্রভাব খাটিয়ে যদি হলে সিট নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায় তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০ হাজার ছাত্রছাত্রীর মধ্যে মাত্র ২৪ শতাংশ শিক্ষার্থীর আবাসনের সুযোগ রয়েছে। ৫টি হলে ২ হাজার ২১৪ শিক্ষার্থীর আবাসনের সুযোগ রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, এসব হলে সিট বরাদ্দ দেওয়ার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হলেও ছাত্রলীগের সুপারিশ ছাড়া কেউ সিট পায় না।

 ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ১৫ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য ছাত্রদের ৪টি ও ছাত্রীদের জন্য তিনটি আবাসিক হল রয়েছে। ছাত্রীদের প্রতি হলে গণরুমে ৩৫ থেকে ৪০ জন্য ছাত্রী থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধাতালিকা ধরে সিট বরাদ্দ দেওয়া হলেও হলে উঠতে হয় ছাত্রলীগ বা শিবিরের ‘হাত ধরে’। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের দুটি ও ছাত্রীদের একটি হল রয়েছে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংখ্যা প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার। ইউজিসির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০ হাজার ৬৬ শিক্ষার্থীর জন্য ৩ হাজার ১৭২টি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ২৫ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য ৪ হাজার ৬৩৯টি, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫ হাজার ৪০৯ শিক্ষার্থীর জন্য প্রায় দেড় হাজার, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫ হাজার ১৮ শিক্ষার্থীর জন্য ১ হাজার ৬১৯টি, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আড়াই হাজারের বেশি শিক্ষার্থীর জন্য ৮৬৬টি, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩ হাজার ২৫৪ শিক্ষার্থীর জন্য ১ হাজার ১১৪টি, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ হাজার ৮৯৮ শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ৭৯৮ জন, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ হাজার ১৯৫ জন শিক্ষার্থীর জন্য মাত্র ৪২৮ জন, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ হাজার ১২৩ শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ২১৫ জনের, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ হাজার ৬৭ শিক্ষার্থীর মধ্যে সাড়ে ৭ শত শিক্ষার্থীর জন্য আবাসন সুবিধা রয়েছে। (প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন ঢাবি প্রতিবেদক ফরহাদ উদ্দিন, রাবি প্রতিনিধি জয়শ্রী ভাদুড়ী, শাবিপ্রবি প্রতিনিধি আসাদুজ্জামান নয়ন)।

সর্বশেষ খবর