বৃহস্পতিবার, ২৫ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা
পজেটিভ বাংলাদেশ

পদ্মা সেতুতে যানবাহন চলবে ২০১৮ সালেই

বেলাল রিজভী, মাদারীপুর

পদ্মা সেতুতে যানবাহন  চলবে ২০১৮ সালেই

দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে বহুল প্রত্যাশিত পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ। দেশের বৃহত্তর দ্বিতলবিশিষ্ট এই সেতু দিয়ে ২০১৮ সালে চলাচল করবে যানবাহন ও ট্রেন এমন কর্মপরিকল্পনা নিয়েই এগোচ্ছে সবকিছু। দিন-রাত কাজ করছেন প্রায় তিন হাজার দেশি-বিদেশি শ্রমিক। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সেতুর নির্মাণকাজ শেষ করতে চলছে এ মহা কর্মযজ্ঞ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছর ১২ ডিসেম্বর দেশের সর্ববৃহৎ এবং বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ এ সেতুর মূল পিলার ও নদীশাসন প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। পদ্মা সেতু নির্মাণে নদীর দুই পারের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে চলছে নানা ধরনের কাজ। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য আলাদা আলাদা প্রতিষ্ঠান নিজেদের কাজ করছে জোরেশোরে। পাইলিং ও অবকাঠামো তৈরির জন্য বড় বড় জাহাজ এবং অত্যাধুনিক নানা যন্ত্রপাতি সাজিয়ে রাখা হয়েছে প্রকল্প এলাকায়। চলছে দুই পারে সেতুর জন্য সংযোগ সড়ক নির্মাণ। শুরু হয়েছে নদীশাসন, মাটি পরীক্ষা ও প্লান্ট তৈরির কাজ। বড় বড় বার্জে ক্রেন বসানো হয়েছে নির্মাণসামগ্রী ওঠানো-নামানোর জন্য। অত্যাধুনিক যন্ত্রের মাধ্যমে মাটি কাটা ও সমান করা হচ্ছে। নদীর পাড়ে ও সড়কের পাশে কাটা হচ্ছে গাছ। নদী খননের কাজ চলছে ড্রেজার দিয়ে। গতি এসেছে সেতুর অ্যাপ্রোচ রোড ও তীর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ এবং নদীশাসনসহ সব কাজে। দ্রুত এগিয়ে চলেছে সবকিছু। সব মিলিয়ে পদ্মাপারে এক নতুন উৎসব চলছে সেতু ঘিরে। প্রকল্প সূত্র জানায়, সেনাবাহিনীর ৯৯ কম্পোজিট ব্রিগেডের তত্ত্বাবধানে নিখুঁতভাবে পরিচালিত হচ্ছে পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ। এর আগে পুনর্বাসন, জমি অধিগ্রহণসহ অনেক কাজই সম্পন্ন হয়ে গেছে। স্বপ্নের সেতুর বাস্তবতার চিত্র দেখে খুশি পদ্মাপারের মানুষ। পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীন সেতু বিভাগ। জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিয়মিত কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছেন। মূল সেতু নির্মাণ করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানি লিমিটেড। দুই পাশের সংযোগ সড়কের কাজ করছে যৌথভাবে দেশি প্রতিষ্ঠান আবদুল মোনেম লি. ও মালয়েশীয় প্রতিষ্ঠান এইচসিএম কনস্ট্রাকশন। সংযোগ সড়ক ও সার্ভিস এরিয়ার তদারককারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর স্পেশাল ওয়ার্কস অর্গানাইজেশন। সরেজমিন প্রকল্প এলাকাজুড়ে দেখা গেছে, সেতু নির্মাণের জন্য চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ করপোরেশন, নদীশাসনের জন্য সিনোহাইড্রোসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের লোকজন কর্মব্যস্ত দিন পার করছেন। কাওড়াকান্দি ঘাট থেকে কিছু দূরে পদ্মার তীরে দেখা গেল ভারী যন্ত্রপাতি সারি সারি সাজানো। স্থানে স্থানে নির্মাণ করা হচ্ছে স্থাপনা। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের নির্দেশে কেউ কেউ ইট ভাঙছেন। কেউ ভবন বানাচ্ছেন। চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানি নিজেরাই নিয়ে এসেছেন মাটি পরীক্ষার জন্য ভাসমান ক্রেন, টাগবোট, অ্যাঙ্কার (নোঙর) বোটসহ বিভিন্ন যন্ত্র। মাটি পরীক্ষার জন্য পরীক্ষাগার স্থাপন করা হয়েছে। ৬.১৫ কিমি পিলারের ওপর স্টিল দিয়ে স্থাপন করা হবে রেলপথ। রেলপথের ওপরের অংশে রড-সিমেন্ট দিয়ে তৈরি করা হবে পাকা রাস্তা। সেখান দিয়ে চলবে যানবাহন। মূল সেতুর ৪০টি পিলারে ৬টি করে ২৪০ এবং দুই পারের দুটিতে ১২টি করে ২৪টি— এই ২৬৬টি পাইল করা হবে। চীনের নানটোংয়ের স্টিল কাটার ফ্যাব্রিকেট ওয়ার্কশপে পদ্মা সেতুর ৯০ মিটার দীর্ঘ কয়েকটি পরীক্ষামূলক পাইল তৈরি করা হচ্ছে। অন্যদিকে সেতুর নির্মাণকাজের জন্য মাওয়ার পাশে কুমারভোগ গ্রামে প্রায় ১ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইল ফ্যাব্রিকেশন ওয়ার্কশপের নির্মাণকাজ চলছে বলেও জানা গেছে। কুমারভোগেই তৈরি হবে সেতুর পাইল। পাইলের জন্য স্টিলের প্লেট আনা হবে চীন থেকে। মালামাল নিয়ে বড় বড় জাহাজ ওয়ার্কশপের পাশে ভেড়ানোর সুবিধার্থে সেখানে জেটি নির্মাণ চলছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সেতু নির্মাণকাজের পাশাপাশি মাওয়া অংশে সাড়ে ৩ কিলোমিটার ও জাজিরা অংশে ১২ কিলোমিটার সেতু সংযোগ সড়ক তৈরির কাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে। প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, এ সেতুর দৈর্ঘ্য হবে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। প্রস্থ ২১ দশমিক ১ মিটার। মূল সেতুর পিলার বসবে ৪০টি। প্রতিটি পিলার ৩৩৯ ফুট গভীরে বসবে। স্প্যান থাকবে ১৫০টি। ভায়াডাক্টসহ সেতুর দৈর্ঘ্য হচ্ছে ৯ দশমিক ৩ কিলোমিটার। সংযোগ সড়ক মোট ১২ কিলোমিটার।

এর মধ্যে মাওয়া অংশে রয়েছে ১ দশমিক ৫ কিলোমিটার ও জাজিরায় ১০ দশমিক ৫ কিলোমিটার। সংযোগ সড়কের সঙ্গে টোল প্লাজা, পুলিশ স্টেশন, পাওয়ার প্লান্টসহ অন্য সুযোগ-সুবিধা থাকবে। প্রকল্পটিতে পরিবেশ ব্যবস্থাপনায় ৩ কোটি ৩১ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। কয়েক লাখ বৃক্ষ রোপণ করা হয়েছে। এখানে সার্বক্ষণিক বিদ্যুতের জন্য স্থাপন করা হয়েছে বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র। সার্ভিস এরিয়াতেই থাকবে টোল প্লাজা ও পুলিশ স্টেশন। পদ্মা সেতুর কাজে বাংলাদেশ ছাড়াও কোরিয়া, চীন, নেপাল ও নিউজিল্যান্ড থেকে জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়। সেতুর নিরাপত্তার জন্য নির্মিত হচ্ছে মাওয়া-জাজিরা সেনানিবাস। জাজিরায় আছেন সেনাবাহিনীর ৮০০ ও মাওয়ায় ৩০০ কর্মকর্তা ও সদস্য। পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে সর্বপ্রথম ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে প্রাথমিক সম্ভাব্যতা যাচাই করে সরকার। ২০০৩ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে জাপান উন্নয়ন সংস্থার (জাইকা) অর্থায়নে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। ২০০৯ সালে এসে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে পূর্ণাঙ্গ ডিজাইন ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়। এরপর নানা নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন থেকে সরে যায়। পরে দেশীয় অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৩ সালে পুরোদমে কাজ শুরু করে সরকার। অন্যদিকে এ সেতুর দুই পারে ১৬০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের প্রকল্প রয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের। শিবচরের বাখরেরকান্দি গ্রামের হাকিম মাতুব্বর বলেন, ‘সেতুর জন্য নিজের ভিটাবাড়ি হারিয়েছি। এর পরও আমাদের কাছে ভালো লাগছে যে সেতুটি নির্মিত হলে এখানে বিভিন্ন কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে।’ সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ১৭ আগস্ট পদ্মা সেতুর কাজ পরিদর্শনে এসে জানান, সেতুর ৩৭ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এ পর্যন্ত ৩৭টি পাইলিং বসানো হয়েছে। ডিসেম্বরে পদ্মা সেতুর পিলারের ওপর দুটি স্প্যান বসানো হবে। এর পরই সেতুর দৃশ্যমান কাজ দেখা যাবে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। ২০১৮ সালের মধ্যে এ সেতু নির্মাণ শেষে যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। মন্ত্রী বলেন, পদ্মা সেতু আর স্বপ্ন নয়। অনেক সেতুতে দেখা যায় সেতু হয়েছে অ্যাপ্রোচ হয়নি। কিন্তু এ সেতু নির্মাণের আগেই অ্যাপ্রোচসহ সামগ্রিক কাজ শেষ হবে। তাই এ সেতুর কাজ যেদিন শেষ হবে, সেদিনই গাড়ি চলতে পারবে। আর একই সঙ্গে শেষ হবে রেল ও সড়ক সেতু নির্মাণ।

সর্বশেষ খবর