সংসদ অধিবেশনে হাজিরা দেওয়ার ক্ষেত্রে এমপিদের উদাসীনতা নতুন কিছু নয়। সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাগুলোতে এমপিদের গড় হাজিরার বিষয়টি দিন দিন প্রকট হয়ে উঠেছে। কমিটি সদস্য হিসেবে প্রতি সভায় হাজিরার জন্য সম্মানী, কমিটি ভাতার পাশাপাশি বিমানের টিকিট দিয়েও সংসদীয় কমিটির সভায় পাওয়া যাচ্ছে না এমপিদের। এ নিয়ে একাধিক কমিটি সভাপতিকে ক্ষোভ প্রকাশ করতেও দেখা গেছে। চলতি সংসদে কোরামের অভাবে সংসদীয় কমিটির সভা মুলতবি করার নজিরও স্থাপিত হয়েছে। এক-তৃতীয়াংশ সদস্যের উপস্থিতি সংসদীয় কমিটিগুলোর বৈঠকের কোরাম হওয়ার বিধান থাকলেও দশ সদস্যের কমিটি সভায় ৩ জনের অভাবে এ কোরাম সংকট হয়। অধিকাংশ সভায় অনুপস্থিতির হার অর্ধেক। ৩ থেকে ৫ জন সদস্য নিয়েই অনুষ্ঠিত হচ্ছে সভা। দশম সংসদ প্রায় তিন বছরে ১১টি অধিবেশনে মিলিত হলেও অনেক কমিটি সভা করতে পেরেছে মাত্র ৫টি। প্রতি মাসে একটি করে সভা করার কথা; কিন্তু ডাবল ফিগারে পৌঁছতে পারেনি হাফডজন কমিটি। তবে আগস্ট মাস পর্যন্ত ৫৪টি কমিটি সভা করে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে সংসদের সরকারি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি। অনেক কমিটি সভাপতির অফিস খোলা হয় কালেভদ্রে। কমিটির সভাপতিরা মন্ত্রীর মর্যাদা, পিএস, পিএ, গানম্যান, এমএলএসএসসহ সংসদ ভবনে অফিস ও আনুষঙ্গিক সুবিধা পাওয়ার পরও অনেক সভাপতির উদাসীনতায় এমপিরা বিরক্ত। সংসদ সচিবালয়ে সরেজমিন অনুসন্ধান করে এসব তথ্য পাওয়া যায়। সংসদীয় কমিটি একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। সংবিধানের ৭৬ অনুচ্ছেদ জাতীয় সংসদকে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি গঠনের ক্ষমতা প্রদান করেছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির মাধ্যমে প্রশাসনের কর্মকাণ্ডের ওপর নিরীক্ষা চালাতে গিয়ে জনপ্রতিনিধিরা রাষ্ট্র পরিচালনার বাস্তব চিত্র সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পান। কমিটির কাজের আওতায় রয়েছে, আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত প্রস্তাব পরীক্ষা-নিরীক্ষা, সরকারের নির্বাহী বিভাগের কর্মকাণ্ড সমীক্ষা, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম সম্পর্কে তদন্ত পরিচালনা বা আইন প্রয়োগের বিষয় পর্যালোচনা করা। হিসাব ও সরকারি ব্যয়ের বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে গিয়ে আর্থিক কমিটিগুলো সরকারের আর্থিক ক্ষমতা সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে কিনা তা নিরূপণ করতে পারে। একই সঙ্গে অনুমোদিত রীতিনীতি অনুযায়ী সরকারি অর্থ ব্যয় হয়েছে কিনা তাও যাচাই করে প্রশাসনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চত করতে পারে। এ ছাড়া সাংবিধানিকভাবে সংসদীয় কমিটি বা কমিটির ওপর এমন ক্ষমতা ন্যস্ত রয়েছে যে ক্ষমতাবলে সেই কমিটি বা কমিটিসমূহ নির্দিষ্ট কোনো ঘটনা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় প্রমাণাদি হাজির করতে বা সাক্ষীদের কমিটির সামনে সশরীরে উপস্থিত হতে বাধ্য করতে পারে। সংসদ সচিবালয় সূত্রে জানা যায়, সপ্তম সংসদ গঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলোর প্রধান ছিলেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা। কিন্তু সপ্তম সংসদের পঞ্চম অধিবেশনে কার্যপ্রণালি বিধিতে সংশোধনী এনে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সবগুলোতেই মন্ত্রীদের পরিবর্তে সংসদ সদস্যকে চেয়ারম্যান করার বিধান যুক্ত হয়। নির্বাহী বিভাগের কাছ থেকে কার্যকরভাবে জবাবদিহিতা আদায়ে কমিটিগুলোকে কার্যকর ও সক্রিয় করার লক্ষ্যেই এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সংসদীয় কমিটির সভাপতি পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদা ও সংসদ ভবনে অফিসসহ আনুষঙ্গিক সুবিধাদি পান। কমিটি সদস্যরাও পান অতিরিক্ত সুবিধা ও প্রতি সভায় উপস্থিতির জন্য আলাদা সম্মানী, কমিটি ভাতা ও যাতায়াত ভাতা। সংসদের কমিটি শাখা জানায়, দশম সংসদে ৫০টি সংসদীয় স্থায়ী কমিটি রয়েছে। এর মধ্যে ৩৯টি কমিটি মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত। সরকারি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি, সরকারি প্রতিষ্ঠান কমিটি, সরকারি প্রতিশ্রুতি কমিটি, সংসদের বিশেষ অধিকার কমিটি, এমপিদের সুযোগ সুবিধা অধিকার সংক্রান্ত সংসদ কমিটি, জনগণের অধিকার সংক্রান্ত পিটিশন কমিটিসহ অপরাপর ১১টি কমিটি রয়েছে। কার্যউপদেষ্টা কমিটি, কার্যপ্রণালি-বিধি সম্পর্কিত কমিটিসহ চারটি মৌলিক কমিটির সভাপতির পদ অলঙ্কৃত করেছেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। এসব কমিটি প্রয়োজন সাপেক্ষে সভা করে থাকে। মাসে মাসে সভার হিসাবের মধ্যে এসব কমিটি গণ্য নয়। স্থায়ী কমিটিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সভা করেছে সরকারি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি। আগস্ট মাস পর্যন্ত এ কমিটি সভা করেছে ৫৪টি। অধিকাংশ সভায় অনুপস্থিতির হার অর্ধেকের বেশি। জুলাই মাসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী অনুমিত হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভা হয়েছে ৫টি। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত কমিটি ১৪টি, জনপ্রশাসন, কৃষি, মত্স্য মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত কমিটি ১৬টি করে, ধর্ম ২০টি, জ্বালানি ২২টি, পরিবেশ বন-২৪টি, প্রাথমিক গণশিক্ষা ২৮টি সভা করতে পেরেছে। দশম সংসদের সংসদীয় কমিটিগুলো এ পর্যন্ত মোট সভা করেছে ৮২১টি। এ সময়ে সংসদীয় উপকমিটি গঠিত হয়েছে ৫৩টি। এসব উপকমিটি সভা করেছে ১৪১টি। সংসদের হিসাব শাখা জানায়, একজন এমপি নির্ধারিত ১০টি অর্থনৈতিক কোডের বিপরীতে মাসিক পারিতোষিক ও ভাতা পান ১ লাখ ৭৩ হাজার ৫০০ টাকা। এর মধ্য থেকে যারা এমপি হোস্টেলে থাকেন তাদের ফ্ল্যাট ভাড়া বাবদ কাটা হয় ৪০০ টাকা। এ ছাড়া কমিটি সভায় উপস্থিত হওয়ার জন্য এমপিরা সম্মানী ভাতা পান এক হাজার টাকা। সভার আগের দুই দিন ও পরের দুই দিনের জন্য কমিটি ভাতা পায় ৮২৫ টাকা হারে ৩ হাজার ৩০০ টাকা। কমিটি সভায় যোগদানের জন্য পান বিমানের টিকিটের দেড়গুণ ভ্রমণ ভাতা। এর বাইরেও ভ্রমণ ভাতা পান এমপিরা। সংসদের কমিটি শাখা থেকে জানা যায়, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যরা সংসদ কর্তৃক নিযুক্ত হয়ে থাকেন। স্পিকার, সংসদ নেতা, বিরোধীদলীয় নেতা তাদের মনোনয়ন দেন। কার্যউপদেষ্টা কমিটি, পিটিশন কমিটি, হাউস কমিটি, লাইব্রেরি সম্পর্কিত কমিটির সদস্যদের মনোনয়ন দেন স্পিকার । ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদে ১৪টি সংসদীয় কমিটি গঠিত হয়েছিল। দ্বিতীয় সংসদে সংসদীয় কমিটি ছিল ৫১টি। স্বল্প মেয়াদি তৃতীয় সংসদে সংসদীয় কমিটি ছিল ৬টি। চতুর্থ সংসদে সংসদীয় কমিটি ছিল ৪৮টি। পঞ্চম সংসদের সংসদীয় কমিটি ছিল ৫৩টি। সপ্তম সংসদে সংসদীয় কমিটি ছিল ৪৮টি। অষ্টম সংসদে সংসদীয় কমিটি ছিল ৪৮। নবম সংসদে সংসদীয় কমিটি ছিল ৪৮টি এবং চলতি দশম সংসদে সংসদীয় কমিটি গঠিত হয়েছে ৫০টি। কমিটিতে ৮ থেকে ১০ জন সদস্য রয়েছেন। সংবিধান বিশেষজ্ঞরা সংসদীয় কমিটির সক্ষমতার বিষয়ে কতগুলো বিষয় চিহ্নিত করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নির্বাহীদের অনীহা, বিচার বিভাগীয় বিষয়ে নির্বাহী নিয়ন্ত্রণ, অনিয়মিত কমিটি সভা, অপর্যাপ্ত উপস্থিতি, সংসদের কার্যপ্রণালি বিধির সুষ্ঠু প্রয়োগের অভাব, কমিটি সদস্যদের দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি, লজিস্টিক সহায়তার স্বল্পতা ইত্যাদি। সংসদীয় কমিটিগুলোর অর্থপূর্ণ কর্মকাণ্ড নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় দক্ষতা নির্মাণ, কমিটি কাঠামোতে সমঝোতা প্রতিষ্ঠা এবং কমিটি প্রক্রিয়ায় জনমত ও সিভিল সমাজের সংশ্লিষ্টতা বিশেষভাবে জরুরি বলে তারা উল্লেখ করেন।