মঙ্গলবার, ৩০ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

অডিটের নামে ওপেন সিক্রেট ঘুষ-বাণিজ্য

রুহুল আমিন রাসেল

সরকারি প্রতিষ্ঠানের নাম মহা হিসাব নিয়ন্ত্রকের (সিজিএ) কার্যালয়, যেখানে অডিটের নামে অডিটর, কর্মকর্তা-কর্মচারী আর পিয়নের সবাইকে পকেটে পকেটে কম-বেশি ঘুষ দিতে হয়। অনিয়ম, দুর্নীতি ও ঘুষ-বাণিজ্যের এই স্বর্গরাজ্যে রাজনৈতিক চাপেও পাস হয় অবৈধ বিল। সারা দেশের অডিটরদের পদায়ন-বদলিতে আর্থিক লেনদেন ও স্বজনপ্রীতির পাহাড়সম অভিযোগের শেষ নেই ঘুষখেকো সিজিএ কার্যালয়ের বিরুদ্ধে।

অভিযোগ রয়েছে, অডিটররা ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি ও ঘুষ-বাণিজ্য করছেন। পাশাপাশি রাজনৈতিক চাপের কারণে অবৈধ বিল পাস করা হচ্ছে। পদায়ন ও বদলির জন্য আর্থিক লেনদেন ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগও রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। সিজিএ কার্যালয়ে যেসব ক্ষেত্রে ঘুষ দিতে হয় সেগুলো হলো— কোনো বিল, প্রকল্প ও ঠিকাদারি কাজের বিল, নিয়োগ, পদায়ন ও বদলি, বিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, বিল দিতে দেরি হবে, অন্য কাজে ব্যস্ত আছি, বিলের সঙ্গে প্রয়োজনীয় কাগজ সরবরাহ করা হয়নি, কাটাকাটি হয়েছে, লেখা স্পষ্ট নয়, সই নাই, দাঁড়ি, কমা, ফুলস্টপ, সেমিকোলন দেওয়া হয়নি, কর্তৃপক্ষের সই নাই, তারিখ ঠিক নাই, বিভিন্ন নিয়ম-কানুন দেখিয়ে বিল ফেলে রাখা বা আপত্তি তুলে বিল ফিরিয়ে দেওয়া, সব আপত্তি একসঙ্গে না দিয়ে বার বার হয়রানি, সার্ভিস রেকর্ডে সমস্যা রয়েছে— এমন অসংখ্য অজুহাত দেখিয়ে অডিটররা ঘুষ-বাণিজ্য চালিয়ে আসছেন। এ প্রসঙ্গে অফিস অব দ্য কন্ট্রোলার জেনারেল অব অ্যাকাউন্টসের মহা হিসাব নিয়ন্ত্রক (সিজিএ) মো. আমির খসরু গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সারা দেশে ৫৩৫টি সিজিএ কার্যালয়ের লোকবল সংকট চলমান। প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান জবাবদিহিতায় মোটামুটি সন্তোষ প্রকাশ করে তিনি বলেন, এখানে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য যে কোনো অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সুশাসনের ১০০ নম্বরের মধ্যে সিজিএ কত পেতে পারে, এমন প্রশ্নের জবাবে সংস্থাটির প্রধান বলেন, ‘আমি নিজে কোনো নম্বর দেব না। তবে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আমরা সচেতন। ঘুষ, দুর্নীতি বা অনিয়মে বিলম্ব হয়, বাইরের মানুষের এ ধারণাটি সঠিক নয় দাবি করে আমির খসরু বলেন, মাত্র ১০ কর্মদিবসে প্রি-অডিট শেষ করা হয়। তবে সিজিএ কার্যালয়গুলোর অটোমেশন শেষ হলে দ্রুত আয়-ব্যয়ের হিসাব পাওয়া যাবে। এ ক্ষেত্রে সিজিএ প্রযুক্তিনির্ভর প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠছে বলেও দাবি করেন তিনি। তথ্যমতে, মূলত হিসাবরক্ষণ অফিস সরকারি ব্যয়ের দুর্নীতি ও অপচয়ের বিরুদ্ধে নিয়ন্ত্রণ কৌশল ও প্রহরী হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশে সরকারি প্রতিষ্ঠানের হিসাবরক্ষণের দায়িত্ব পালন করে ‘হিসাব মহা নিয়ন্ত্রক (সিজিএ) অফিস’। যে কোনো সরকারি বিল বা অর্থছাড় অনুমোদন করার আগে, এতে কোনো ধরনের প্রশাসনিক, আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতি হচ্ছে কিনা তা যাচাই করা এই সিজিএ কার্যালয়ের দায়িত্ব।

জানা গেছে, সিজিএ কার্যালয়ে হিসাবরক্ষণ স্বয়ংক্রিয় (অটোমেটেড) করার মতো বহু ইতিবাচক পরিবর্তন করা হলেও জনবলের ঘাটতি, কর্মদক্ষতার ঘাটতি, আইনগত সীমাবদ্ধতা, মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ, অফিস স্থাপনা ও অন্যান্য লজিস্টিক সুবিধার ঘাটতিসহ বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনিয়ম বিরাজমান থাকায় প্রতিষ্ঠানটি প্রত্যাশিত পর্যায়ের দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সঙ্গে কার্যক্রম পরিচালনা করতে সক্ষম হচ্ছে না। ফলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত কয়েক বছরে সিজিএ অফিসে হিসাবরক্ষণ পদ্ধতির অটোমেশনসহ বিভিন্ন রকম ইতিবাচক পরিবর্তন সাধিত হলেও ঘুষ-বাণিজ্য চলছে আগের মতোই। এর সঙ্গে জনবলের অভাব, কর্মদক্ষতার অভাব, আইনগত সীমাবদ্ধতা, কার্যক্রমে মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ, স্থাপনা ও লজিস্টিক সুবিধার অভাব তো লেগেই আছে। অন্যদিকে বিভিন্ন ধরনের বিল পাস করাতে ঘুষ, হয়রানি, ইচ্ছা করে বিল হারিয়ে ফেলা, হিসাবের প্রতিবেদন তৈরিতে অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম আর দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে দেশের সিজিএ কার্যালয়গুলো। দুর্নীতিবিরোধী জার্মানিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সিজিএ কার্যালয়ে কাজ করানোর জন্য চার হাজার থেকে শুরু করে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। বিভিন্ন অডিট, নিয়োগ, পদায়ন ও বদলিসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি রয়েছে। আছে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতাও। এগুলো হলো— প্রয়োজনীয় ও দক্ষ জনবলের অভাব, হিসাবের প্রতিবেদন সময়মতো সম্পন্ন না করা, হিসাবরক্ষণ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাব, নিয়োগ, পদোন্নতি ও অর্গানোগ্রামে সমস্যা, অডিট ও হিসাবের পৃথক্করণ এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে সমস্যা। এসব সমস্যার কারণে রাষ্ট্রীয় ব্যয় বাড়ছে। আর্থিক বিবরণে সঠিক চিত্র না পাওয়ায় পরবর্তী বাজেটে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যাচ্ছে না। ফলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।

সর্বশেষ খবর