বুধবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

বিশ্ববাজারে নতুন ঠিকানা বাংলাদেশ

ক্রেতার আস্থা বাড়ছে জিন্স খাতে

জিন্নাতুন নূর

আমেরিকান স্বর্ণ শিকারিদের কাছে ১৮৮০ সালের দিকে কাজের সুবিধার্থে ডেনিম নামে জিন্সের ব্যবহার বেশ জনপ্রিয়তা পায়। কারণ এই পোশাকটি সহজে ছিঁড়ে না এবং নষ্টও হয় না। বর্তমান সময়ে এসে আমেরিকার বাইরেও দুনিয়াজুড়ে ফ্যাশন সচেতন মানুষের প্রিয় পোশাকের তালিকায় আছে ডেনিম কাপড়ের তৈরি জিন্স, শার্টসহ অন্যান্য পোশাক। বয়স, শ্রেণি ও পেশাভেদে বিশ্বব্যাপী নারী-পুরুষের কাছে ডেনিমের চাহিদা দিনকে দিন বাড়ছে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও ডেনিম কাপড় ও এই কাপড়ের তৈরি পোশাকের উৎপাদন হচ্ছে। এখন বিশ্ব বাজারে বছরে আট হাজার কোটি ডলারের ডেনিম পণ্যের চাহিদা রয়েছে। আর বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি করা হয় ৩৫০ কোটি ডলারের ডেনিম পণ্য। দেশে ডেনিম নিয়ে আন্তর্জাতিক মানের বড় আসর বাংলাদেশ ডেনিম এক্সপো অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যা এরই মধ্যে বিদেশি ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারস অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) ও বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিল অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)-এর দেওয়া তথ্যে, বাংলাদেশ আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বিশ্বের তৃতীয় ডেনিম উৎপাদক দেশ হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। আর এ জন্য ২০২১ সালের মধ্যে রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭০০ কোটি মার্কিন ডলার। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে বাংলাদেশের ডেনিম পণ্যের সবচেয়ে বড় দুটি বাজার। ওয়ার্ল্ড ডেনিম মার্কেটের ২০১২ সালের হিসাব মতে, ১৯৭০-এর আগে সব ডেনিম কাপড় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদিত হতো। বর্তমানে পৃথিবীতে প্রতি বছর ৩০টি দেশে ৭.৩ বিলিয়ন মিটার ডেনিম উৎপাদিত হচ্ছে। এর  মধ্যে শুধু এশিয়াতেই উৎপাদিত হচ্ছে মোট উৎপাদনের ৭০ শতাংশ ডেনিম। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ২.৫ বিলিয়ন ডলারের ডেনিম রপ্তানি করে। সে বছর বাংলাদেশ ১৮৫ মিলিয়ন মিটার ডেনিমের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে। যার মধ্যে ৪৪ মিলিয়ন মিটার পোশাক শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই রপ্তানি করা হয়। হিসাবে যা মোট ডেনিম বাজারের ২২.৮৮ শতাংশ। আর একই বছর  ইইউতে রপ্তানি করা হয় ১৪১ মিলিয়ন ডলার মূল্যের ডেনিম পোশাক। যা মোট বাজারের ১১.৩৫ শতাংশ। ২০২১ সালের মধ্যে পোশাক খাতে ৫০ বিলিয়ন ডলার পোশাক রপ্তানির যে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে বাংলাদেশ সেখানে শুধু ডেনিম খাত থেকেই ৭০০ কোটি ডলার পোশাক রপ্তানি সম্ভব। বাংলাদেশের পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত, পাকিস্তান ও চীন থেকে ডেনিম পণ্যের বড় একটা অংশ রপ্তানি করা হচ্ছে। ডেনিম অ্যান্ড জিন্স ডটকমের সূত্রমতে, ইইউতে পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তৃতীয়। পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা জানান, বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের পর ডেনিম খাতই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সম্ভাবনাময় খাত। যা খুব দ্রুত বিশ্ব বাজারে বিস্তার লাভ করছে। পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা মনে করছেন, গুণগত মানের জন্য বাংলাদেশের ডেনিম খাত বিদেশি ক্রেতাদের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। তারা জানান, সাধারণত ক্রেতারা এমন একটি দেশে তাদের অর্ডার দিতে চান যেখানে তারা টানা ১৫ থেকে ২০ বছর ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারবেন। এরই মধ্যে বাংলাদেশও আন্তর্জাতিক ডেনিম বাজারে একটি শক্তিশালী বিক্রেতা দেশ হিসেবে সুনাম অর্জন করেছে। এর বাইরে উন্নতমানের ডেনিম পোশাক তৈরির জন্য বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা নিত্যনতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন, যা এই শিল্পের বিস্তারের জন্য ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ও ডেনিম পোশাক তৈরির সঙ্গে জড়িত স্টারলিং গ্রুপের চেয়ারম্যান সিদ্দিকুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ডেনিম খাত নিয়ে আমাদের সম্ভাবনা প্রচুর। বাংলাদেশে এই শিল্পের ভবিষ্যৎও উজ্জ্ব্বল। দেশে তৈরি ডেনিম পোশাক ও পণ্য এরই মধ্যে বিদেশি ক্রেতাদের আস্থা অর্জন করেছে। এর গুণাগুণ নিয়েও ক্রেতারা সন্তুষ্ট। তিনি বলেন, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ ও পোশাক খাত থেকে ৫০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় অর্জনে ডেনিম রপ্তানি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে বলে আমি মনে করছি। বিটিএমএর তথ্যে, বর্তমানে দেশে ২৫টির বেশি ডেনিম উৎপাদন কারখানা আছে। যা কিনা দেশের ৫৫০টি ডেনিমের তৈরি পোশাক কারখানার ৬০ শতাংশ চাহিদা পূরণে সক্ষম। এসব কারখানার অনেকগুলোই আবার পরিবেশের কম ক্ষতি করে এমন প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। আর বাংলাদেশে ডেনিম শিল্পে বিনিয়োগ করা হয়েছে প্রায় ৯০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ।  জানা যায়, আরও ১৫টির বেশি ডেনিম কারখানা বর্তমানে উৎপাদনে যাওয়ার অপেক্ষায় আছে। তবে দেশের ডেনিম উৎপাদনকারী কারখানাগুলো আমদানিকৃত কাঁচামালের ওপর নির্ভরশীল। প্রতি বছর দেশের কারখানাগুলো ৩৬ কোটি গজ ডেনিম কাপড় উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। আর চাহিদা আছে ৭২ কোটি গজ। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২১ সালের মধ্যে এই চাহিদা ১২০ কোটি গজে দাঁড়াবে। ডেনিম উৎপাদনের সঙ্গে জড়িতরা জানান, বর্তমানে বাংলাদেশে সাধারণ থেকে মিড-হাই লেভেলের ডেনিম পণ্য তৈরি হচ্ছে। আরও উন্নতমানের ডেনিম পণ্যের বাজার ধরতে কারখানাগুলোতে ডেনিমের মানোন্নয়নে আর অ্যান্ড ডি বিভাগ (রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) এবং দক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন। তবে ডেনিম মিলের জন্য গ্যাস সংযোগ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অথচ সরকার নতুন কারখানা ও মিলে গ্যাস সংযোগ বন্ধ রেখেছে। বিজিএমইএ সভাপতি জানান, বর্তমানে ডেনিম শিল্প কারখানা স্থাপনে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে গ্যাস সংযোগ। ডেনিম কারখানা স্থাপনের অর্থই হচ্ছে ডায়িং ও ওয়াশিং সুবিধাদি থাকা। কিন্তু কারখানা স্থাপনের জন্য মালিকরা গ্যাসের সংযোগ পাচ্ছেন না। ডিজেল দিয়ে এই কারখানাগুলো চালানো যায় কিন্তু তাতে খরচ বেশি। ডেনিম শিল্পের প্রসারে বিজিএমইএ সভাপতি সরকারের কাছে গ্যাস সংযোগ প্রদানের জন্য দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তবে ডেনিমের বিশ্ব বাজারে ডেনিম খাত নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান আরও শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে ২০১৪ সাল থেকে শুরু হওয়া বাংলাদেশ ডেনিম এক্সপো। এমনকি এখানে ক্রেতা-বিক্রেতারা সরাসরি ব্যবসায়িক কার্যক্রমের সুযোগ পাচ্ছেন। চলতি বছরের ৮ ও ৯ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এই ডেনিম এক্সপো।

সর্বশেষ খবর