শুক্রবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

বেপরোয়া জাল নোট চক্র মলম পার্টিও তত্পর

দুই কোটি টাকার নোট ও সরঞ্জাম উদ্ধার

আলী আজম

রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে বেপরোয়া হয়ে উঠছে জাল টাকার সিন্ডিকেট। সারা দেশে মোটা দাগে ২১টি সিন্ডিকেট চিহ্নিত করা গেলেও তা ভাঙতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ঈদ সামনে রেখে জাল নোটের বিস্তার ঠেকাতে এবং সরবরাহকারী চক্রের মূলোৎপাটনে চিরুনি অভিযানে নেমেছে বাংলাদেশ ব্যাংক, র‌্যাব, পুলিশ ও বাংলাদেশ ফিনানশিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।

প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও জাল টাকাসহ ধরা পড়ছে সিন্ডিকেটের সদস্যরা। কিন্তু জাল টাকার উৎপাদন না কমায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে সরকার। এদিকে ঈদ মৌসুমের ভয়ঙ্কর চক্র মলম পার্টিও সক্রিয় হয়ে উঠেছে।

পুলিশ ও র‌্যাব বলছে, জাল নোটের সিন্ডিকেট কোরবানির পশুর হাটকে কেন্দ্র করে এখন সক্রিয় হয়ে উঠেছে। গোয়েন্দাদের কাছে খবর রয়েছে, রাজধানীসহ দেশের বড় বড় কোরবানি পশুর হাটের আশপাশে আস্তানা গেড়েছে এরা। অন্তত ১০ কোটি টাকার জাল নোট ছাড়ার পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছে তারা। সম্প্রতি ঢাকার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে দুই কোটি টাকারও বেশি জাল নোট ও তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেফতার হয়েছে জালিয়াত ও মলম চক্রের একাধিক সদস্য।

জানা গেছে, বুধবার ঢাকার রামপুরা, শ্যামপুর ও কেরানীগঞ্জ থেকে কোটি টাকার জাল নোট ও জালিয়াতির সরঞ্জামসহ পাঁচজনকে আটক করেছে র‌্যাব। এদের মধ্যে আবদুর রশিদ নামে অগ্রণী ব্যাংকের চাকরিচ্যুত এক কর্মকর্তা রয়েছেন। আটক অন্যরা হলেন—ফাতেমা বেগম, রুবিনা বেগম, দুলাল ও সারোয়ার হোসেন। র‌্যাব বলছে, প্রতি বছর দুই ঈদ সামনে রেখে জাল টাকার সংঘবদ্ধ কিছু চক্র সক্রিয় হয়ে ওঠে। পরে এসব চক্র জাল টাকা তৈরি করে নির্দিষ্ট কয়েকজন সদস্য দিয়ে আসল টাকার ভেতর জাল টাকা দিয়ে সহজ-সরল মানুষকে নিঃস্ব করে। দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর এ চক্রের পাঁচ সদস্য র‌্যাবের জালে ধরা পড়ে।

র‌্যাব-১ অধিনায়ক লে. কর্নেল তুহিন মোহাম্মদ মাসুদ জানান, বুধবার রাতে রামপুরার দক্ষিণ বনশ্রী এলাকার ১০/৪ নম্বর রোডের এফ/৭৭ নম্বর বাসায় অভিযান চালানো হয়। বাসার বেডরুমে একটি ছোটখাটো টাকশাল ও জাল টাকা তৈরির কারখানা পাওয়া যায়। এ সময় ফাতেমা ও রুবিনাকে আটক করা হয়। পরে ওই বাসা থেকে ৭৮ লাখ টাকা, জাল টাকার সফটওয়্যার থাকা একটি ল্যাপটপ, দুটি প্রিন্টারসহ জাল টাকা তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়।

ফাতেমা ও রুবিনার তথ্যমতে, শ্যামপুরের খন্দকার রোড থেকে আবদুর রশিদ ও দুলালকে এবং কেরানীগঞ্জের কবুতরপাড়া থেকে সারোয়ারকে আটক করা হয়। এ সময় আবদুর রশিদ ও দুলালের বাসা থেকে ২৩ লাখ জাল টাকা এবং সারোয়ারের কাছ থেকে ২ লাখ জাল আর ২৩ হাজার ৮০০ আসল টাকাসহ জাল টাকা তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়।

র‌্যাব-১ অধিনায়ক জানান, আটক ব্যক্তিরা দীর্ঘদিন ধরে জাল নোট তৈরি করে আসছে। তারা বিভিন্ন জায়গা থেকে তৈরির কাঁচামাল সংগ্রহ করে জাল নোট ছাপছে। ঈদুল আজহা সামনে রেখে বিপুল পরিমাণ জাল নোট ছেপেছে তারা। ইতিমধ্যে তারা কোটি টাকার বেশি জাল নোট বাজারে ছেড়েছে। জাল টাকাগুলোর নিরাপত্তাসুতা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি ছাপাসহ অমসৃণ রেখাগুলো এত নিখুঁতভাবে করা হয়েছে যে, তা ধরা প্রায় অসম্ভব।

তিনি বলেন, সরকারি একটি ব্যাংকের চাকরিচ্যুত কর্মকর্তা আবদুর রশিদ দুই বছর জেল খাটেন এবং পরবর্তী সময়ে কাঁটাবনে প্রিন্টিং প্রেসের ব্যবসা শুরু করেন। জেলে থাকাকালে ভারতীয় জাল মুদ্রা প্রস্তুতকারী নুরুজ্জামানের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। জেল থেকে বের হলে নুরুজ্জামান তার সঙ্গে পুনরায় দেখা করেন এবং তারা ভারতীয় জাল মুদ্রা তৈরি শুরু করেন। প্রথম দিকে আবদুর রশিদ জাল ভারতীয় মুদ্রার কাগজে নিরাপত্তাছাপ দেওয়ার কাজ করতেন। ধীরে ধীরে দেশীয় মুদ্রার নিরাপত্তাছাপও দেওয়া শুরু করেন তিনি। একটি দুর্ঘটনার পর তিনি প্রিন্টিং প্রেস বিক্রি করে দেন। এ প্রক্রিয়ায় জাল টাকার বড় বড় চক্রের সঙ্গে তার পরিচয় হয় এবং একসময় নিজেই এ ব্যবসায় নেমে পড়েন।

তুহিন মোহাম্মদ মাসুদ জানান, ফাতেমা ও রুবিনা এবং তাদের স্বামী আবদুর রহিমকে আগে জাল টাকা তৈরি ও বাজারজাত করার অপরাধে র‌্যাব একবার গ্রেফতার করেছিল। ওই সময় আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের জেলে পাঠানো হয়। আবদুর রহিমের দুই স্ত্রী জেল থেকে জামিনে মুক্ত হয়ে আবার এ ব্যবসায় নেমে পড়েন। তবে আবদুর রহিম এখনো জেলে থাকলেও এ ব্যাপারে স্ত্রীদের উৎসাহ ও প্রযুক্তির সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন। তারা স্বামী আবদুর রহিমের কাছ থেকে জাল নোট তৈরি করা শিখে স্বামীর অবর্তমানে জাল নোট তৈরি ও বাজারজাত করে আসছেন। নিখুঁত জাল টাকা তৈরির জন্য আবদুর রহিম এ চক্রগুলোর মধ্যে সুপরিচিত।

এদিকে বুধবার রাতে শ্যামপুর থেকে মলম পার্টি চক্রের পাঁচ সদস্যকে আটক করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এরা হলেন সৈয়দ সোলায়মান, মো. মাহফুজ, মো. মাসুদ, গোলাম মোস্তফা ও নওয়াব আলী। এ সময় তাদের কাছ থেকে অজ্ঞান করার কাজে ব্যবহূত ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়। পুলিশ বলছে, তারা ঈদ সামনে রেখে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গরুর হাটসহ বিভিন্ন স্থানে যাত্রীদের কৌশলে পানি, চা, জুসসহ তরলজাতীয় খাবারের সঙ্গে অজ্ঞান করার ট্যাবলেট মিশিয়ে খাওয়াতেন। পরে যাত্রীদের অজ্ঞান করে সঙ্গে থাকা টাকা-পয়সা ও মূল্যবান মালামাল নিয়ে যেতেন।

এর আগে ১ সেপ্টেম্বর রাতে রাজধানী থেকে এক কোটি ১৫ লাখ ৭৭ হাজার জাল টাকা, ৮ হাজার ভারতীয় জাল রুপি ও জাল নোট তৈরির সরঞ্জামসহ ১০ সদস্যকে এবং মলম পার্টির ২১ সদস্যকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ওই সময় ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মো. মনিরুল ইসলাম বলেছিলেন, বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষে আটক ব্যক্তিরা জাল নোট প্রস্তুত ও বিপণন করে থাকে। পশুর হাট সামনে রেখে তারা সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। ইতিমধ্যে চক্রটি দু-তিন কোটি টাকা বাজারে ছেড়েছে বলে জানা গেছে। এদের টার্গেট ছিল ১০ কোটি টাকার জাল নোট বাজারে ছাড়া। এ ছাড়া মলম পার্টির সদস্যরা বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী বাসে যাত্রী বেশে ভ্রমণ করেন এবং যাত্রীদের অজ্ঞান করে সর্বস্ব লুট করে থাকেন।

রাজধানীতে অজ্ঞান পার্টির পাঁচ সদস্য গ্রেফতার : রাজধানীর শ্যামপুরে অভিযান চালিয়ে অজ্ঞান পার্টি চক্রের ৫ সদস্যকে আটক করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এ সময় তাদের কাছ থেকে অজ্ঞান করার কাজে ব্যবহূত ‘নকটিন’ নামক ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা হলেন— সৈয়দ সোলায়মান, মো. মাহফুজ, মো. মাসুদ, গোলাম মোস্তফা ও নওয়াব আলী।

পুলিশ জানায়, বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে শ্যামপুরের শ্মশান ঘাট এলাকায় গোয়েন্দা পুলিশ অভিযান চালিয়ে অজ্ঞান পার্টির পাঁচজনকে গ্রেফতার করে। তারা ঈদকে সামনে রেখে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গরুর হাটসহ শ্যামপুর, যাত্রাবাড়ী, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন ও সায়েদাবাদের যাত্রীদের কৌশলে পানি, চা, জুসসহ বিভিন্ন তরল জাতীয় খাবারের সঙ্গে অজ্ঞান করার ট্যাবলেট মিশিয়ে খাওয়াতো। পরে যাত্রীদের অজ্ঞান করে সঙ্গে থাকা টাকা পয়সা ও মূল্যবান মালামাল নিয়ে যেত।

সর্বশেষ খবর