শুক্রবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

চামড়া নিয়ে চতুর্মুখী সংকট

মৌসুমি ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত

নিজস্ব প্রতিবেদক

চামড়া নিয়ে চতুর্মুখী সংকট

কোরবানির চামড়া নিয়ে চতুর্মুখী সংকটে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। মৌসুমি ব্যবসায়ী যারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ করেছেন, তাদের অভিযোগ, গতবারের মতো এবারও চামড়া কিনে মাথায় হাত পড়েছে। যে দরে কিনেছেন, সেই দরে বিক্রি করতে পারছেন না। মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আড়তদাররা যে চামড়া কিনে থাকেন, তাদের অভিযোগ, ট্যানারি মালিকরা এবার চামড়ার দাম গতবারের চেয়ে কমিয়ে নির্ধারণ করেছেন। ফলে লোকসানের ভয়ে তারাও বেশি দামে চামড়া কিনতে পারছেন না। আবার ঢাকার পোস্তা ও হাজারীবাগের চামড়া ব্যবসায়ীরা বলছেন, লবণের সংকট ও মূল্য বৃদ্ধির কারণে প্রতি পিস চামড়ায় তাদের এক-তৃতীয়াংশ ব্যয় বেড়েছে। ফলে তারাও চামড়া কিনে ভবিষ্যতে কতটা লাভের মুখ দেখবেন এ নিয়ে শঙ্কায় আছেন। উপরন্তু তাদের হাতে গতবারের কেনা প্রায় আরও ৩০ শতাংশ চামড়া মজুদ রয়ে গেছে।

মাথায় হাত মৌসুমি ব্যবসায়ীদের : দেশের বিভিন্ন জেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চড়া দামে কোরবানির পশুর চামড়া ক্রয় করে এবার বিপাকে পড়েছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। এ বছর ঢাকায় কোরবানির গরুর লবণযুক্ত কাঁচা চামড়ার মূল্য প্রতি বর্গফুট ৫০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৪০ টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রতিযোগিতায় নেমে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা বর্গফুটের হিসাব না করে অধিক দামে চামড়া সংগ্রহ করেন। সিলেটের মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী রুবেল আহমদ ও আকরাম হোসেন জানান, বর্গফুটের হিসাব না বুঝে এবার তারা ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা দিয়ে প্রতি পিস চামড়া সংগ্রহ করেছিলেন। এই আকারের চামড়া তারা গতবার ১৫০০ থেকে ১৮০০ টাকা দিয়ে কিনেছিলেন। কিন্তু এ বছর আড়তদাররা প্রতি পিস চামড়া ৩০০ থেকে ৫০০ টাকার বেশি দিয়ে কিনতে চাইছেন না। এতে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের পথে বসার উপক্রম হয়েছে। বরিশাল নগরীর ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের চা-দোকানি কবির হোসেন। বাড়তি কিছু আয়ের আশায় আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধারদেনা করে মঙ্গলবার ঈদুল আজহার দিন আট পিস গরুর চামড়া কিনেন। সব মিলিয়ে তার প্রতি পিস চামড়ার গড় ক্রয়মূল্য দাঁড়ায় ১ হাজার ২২৫ টাকা করে। কিন্তু ওই দিন বিকালে নগরীর পদ্মাবতী আড়তে চামড়ার আড়তদাররা ওই চামড়ার মূল্য বলেছেন গড়ে ৯০০ টাকা করে। এতে মাথায় হাত উঠেছে কবিরের। কোরবানির চামড়া সংরক্ষণ নিয়ে এবার বেকায়দায় পড়েছেন রাজশাহীর ব্যবসায়ীরাও। লবণের দাম বেড়ে যাওয়া এবং দেরিতে আড়তে নিয়ে আসায় চামড়া নষ্টের শঙ্কাও করছেন তারা। দুই দিন ধরে রাজশাহীর আড়তগুলোতে শুরু হয়েছে চামড়া সংরক্ষণের কাজ। তবে দাম নিয়ে শঙ্কায় আছেন রাজশাহীর সবচেয়ে বড় বেলপুকুর আড়তের ব্যবসায়ীরা। পুঠিয়ার বেলপুকুরের চামড়া ব্যবসায়ী বদিউজ্জামান জানান, সংরক্ষণ করতে এবার ব্যবসায়ীদের গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা। গত বছরের তুলনায় লবণের খরচ বেড়েছে দ্বিগুণ। দেরিতে আড়তে নিয়ে আসায় অনেক চামড়া নষ্ট হয়ে গেছে। একই অবস্থা দেখা গেছে দেশের অন্য জেলা ও বিভাগীয় শহরগুলোতে। ঈদের দিন দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে প্রতিটি ছাগলের চামড়া বিক্রি হয়েছে ১০ থেকে ১৫ টাকায়। গরুর চামড়ার দাম পড়েছে ৩০০ থেকে ১ হাজার টাকায়। এতে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত পড়েছে। মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চামড়া সংগ্রহ করেন এমন এক আড়তদার সিলেটের কামাল আহমদ জানান, মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ট্যানারি মালিকদের বেঁধে দেওয়া মূল্য বিবেচনা না করে তাদের মনগড়া দাম দিয়ে চামড়া কিনেছেন। তাই তাদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। এ ছাড়া ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চামড়া কেনার পর এগুলো থেকে মাংসের টুকরো অপসারণ করে লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করে ঢাকায় পরিবহন করতেও তাদের অনেক খরচ হয়েছে বলে জানান ওই আড়তদার।

লবণ সংকট, দামও বেশি : ঢাকার চামড়া ব্যবসায়ীরা জানান, চামড়া সংরক্ষণের জন্য গতবার যে লবণের (৭৪ কেজি) বস্তা ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকায় কিনেছেন, এবার তা কিনতে তিন থেকে চারগুণ বেশি দাম পড়ছে। ঈদের এক সপ্তাহ আগে প্রতি বস্তা লবণ ছিল ১৫০০ টাকা, যা ঈদের দিন দুই হাজার টাকা এবং ঈদের পরদিন বৃহস্পতিবার ১৭০০ থেকে ১৮০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। এবারের কাঁচা চামড়ার বাজার নিয়ে এই অস্থিতিশীল অবস্থার কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হাজি মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বলেন, চারটি কারণে এবার কাঁচা চামড়ার বাজারে কিছুটা অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। প্রথমত, লবণের সংকট রয়েছে, দামও বেশি পড়ছে। ফলে গতবারের তুলনায় চামড়া সংরক্ষণে ব্যয় বেড়েছে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। আবার আন্তর্জাতিক চামড়ার বাজারে মন্দা রয়েছে। হাজারীবাগ থেকে সাভারে চামড়াশিল্প স্থানান্তরের প্রক্রিয়া চলমান থাকার কারণেও অনেক ট্যানারি মালিক গতবারের কেনা চামড়ার মূল্য পরিশোধ করেননি। ফলে এবার চামড়া কেনায় তহবিল সংকট রয়েছে। এ ছাড়া আগের বছরের ঈদে কেনা চামড়ার প্রায় ৩০ শতাংশ তাদের কাছে মজুদ রয়ে গেছে। চতুর্মুখী এ সংকট থাকা সত্ত্বেও চামড়ার যে দাম ঘোষণা করা হয়েছিল, এর চেয়ে বেশি দামেই ঢাকায় ভালো মানের চামড়া কেনা হচ্ছে বলে জানান তিনি। দেলোয়ার হোসেন বলেন, মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়ার মান বোঝেন না। সঠিকভাবে চামড়া সংরক্ষণও করতে পারেন না তারা। সে কারণে অনেক ক্ষেত্রে চামড়ার দরের তারতম্য হয়। তবে ভালো মানের চামড়া প্রতি বর্গফুট ৬০ থেকে ৬৫ টাকা, এমনকি এর চেয়ে বেশি দরেও ঢাকায় কেনা হচ্ছে।

সর্বশেষ খবর