শুক্রবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

স্থানীয়দের ক্যাম্পাসে পরিণত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়

গড়ে উঠেছে সংঘবদ্ধ চক্র, সবকিছুই জিম্মি

আকতারুজ্জামান

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগ। ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়া নবীন শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিতে যান এক শিক্ষক। নতুনদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। এরপর শিক্ষার্থীদের কাছে নিজ জেলার ব্যাপারে জানতে চান। এবার চোখ কপালে উঠে যায় শিক্ষকের। জানতে পারেন, বিভাগে নতুন ভর্তি হওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের ৭০ শতাংশেরও বেশি শিক্ষার্থী পার্শ্ববর্তী জেলা কুষ্টিয়া আর ঝিনাইদহের। রাগে-ক্ষোভে ক্লাস না নিয়েই শ্রেণিকক্ষ থেকে বেরিয়ে যান বিভাগের এই সিনিয়র শিক্ষক। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিকাংশ বিভাগের প্রায় ৬০-৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহ জেলার। আইন বিভাগের ২০০৬-০৭ শিক্ষাবর্ষের প্রায় ৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ছিলেন ঝিনাইদহ ও কুষ্টিয়া জেলার। বিভাগটির ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের ৯৯ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৪০ জন ঝিনাইদহের এবং ২৮ জন কুষ্টিয়া জেলার। বাংলা বিভাগে ৯২ জনের মধ্যে ৪০ জন ঝিনাইদহ এবং ২২ জন কুষ্টিয়ার, গণিত বিভাগের ৫২ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৮ জন কুষ্টিয়ার এবং ১৪ জন ঝিনাইদহের। একই চিত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ বিভাগে বিভিন্ন শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনিয়র শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হওয়ার কয়েকটি কারণ পাওয়া গেছে। তাদের মতে ভর্তির ক্ষেত্রে বিভাগের থেকে দু-এক দিন আগে নোটিস দেওয়া হয় ফলে দূরের শিক্ষর্থীরা আসতে পারে না। এ ছাড়া একটি চক্র দূরের শিক্ষার্থীদের ভয়ভীতি দেখিয়ে ভর্তি হওয়া থেকে বিরত রাখে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারী স্থানীয়। ভর্তি পরীক্ষা চলাকালীন প্রতিবছরই সংঘবদ্ধ জালিয়াত চক্র ও ছাত্রলীগের আশ্রয়ে একটি অসাধু ছাত্রদের গ্রুপ বাইরে থেকে পরীক্ষার প্রশ্ন সমাধান করে দেয়। এতে স্থানীয় কিছু ভর্তিচ্ছু বরাবরই সুবিধা পায়। বিগত কয়েক বছরেই প্রশাসনের হাতে তারা হাতেনাতে ধরা পড়লেও উল্লেখযোগ্য কোনো ব্যবস্থার আওতায় আসেনি তারা। এসবও স্থানীয় ক্যাম্পাসে পরিণত হওয়ারও অন্যতম কারণ।

শুধু ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় নয়, দেশের উচ্চশিক্ষার অনেক বিদ্যাপীঠেরই এমন হাল! বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সারা বিশ্বের শিক্ষার্থীদের সম্মিলন হওয়ার কথা, অথচ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ আসনই দখল করে থাকে আশপাশের কয়েকটি জেলার ছাত্র-ছাত্রীরা। এতে একদিকে যেমন শিক্ষার্থীরা সারা দেশের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংস্কৃতির বিনিময় ঘটাতে পারেন না, অপরদিকে কর্মজীবনে স্থানীয় ধ্যান-ধারণায় বাইরের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে সমর্থ হন না। অভিযোগ রয়েছে, তুলনামূলক পরে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়া, প্রশ্নফাঁস, অপেক্ষমাণ তালিকা থেকে ভর্তিতে অস্বচ্ছতা, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, রাজনৈতিক তদবিরে ভর্তি, সংরক্ষিত কোটায় ভুয়া সার্টিফিকেটধারীদের ভর্তি হওয়াই এভাবে ক্যাম্পাসগুলো স্থানীয় ক্যাম্পাসে পরিণত হওয়ার অন্যতম কারণ। অবশ্য অনেক ক্যাম্পাসে বছরজুড়ে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, তুচ্ছ কারণে ক্যাম্পাস বন্ধ হওয়ার কারণেও অনেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় মাড়াতে চান না।

এ ব্যাপারে ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমাদের সব বিশ্ববিদ্যালয় সমান মানের হয়ে ওঠেনি। শিক্ষার্থীদের কাছে আকর্ষণীয়ও হয়ে উঠতে পারেনি। এ কারণে সারা দেশের শিক্ষার্থী বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছে না। এ ছাড়া কিছু এলাকার শিক্ষার্থী আশপাশের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা নিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানীয় শিক্ষার্থী বেশি হওয়ার এটিও অন্যতম কারণ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়েও স্থানীয় শিক্ষার্থীদের মাত্রাতিরিক্ত আধিক্য রয়েছে। ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হওয়া লোকপ্রশাসন বিভাগে মোট শিক্ষার্থী রয়েছে ৬৩ জন। সম্পতি ৫৫ জন শিক্ষার্থীর উপস্থিতিতে বিভাগটিতে জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, এখানে রংপুর বিভাগের ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে ৪৩ জন। এরমধ্যে রংপুর জেলার ছাত্র রয়েছে ১৩ জন। এ ছাড়া বিভাগটিতে ঢাকা বিভাগের মাত্র একজন, খুলনা বিভাগের একজন, বরিশাল বিভাগের একজন ও রাজশাহী বিভাগের দুজন ছাত্র রয়েছে। চট্টগ্রাম বিভাগের কোনো শিক্ষার্থীই ছিল না বিভাগটির এ সেশনে। সূত্রমতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬০ শতাংশের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন রংপুর ও আশপাশের কয়েকটি জেলার। সবমিলে স্থানীয় ক্যাম্পাসের বৃত্তেই বন্দী এ উচ্চশিক্ষার বিদ্যাপীঠ।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও (শাবিপ্রবি) আশঙ্কাজনকহারে বাড়ছে সিলেটী শিক্ষার্থীদের সংখ্যা। গত পাঁচ বছরে তুলনামূলকভাবে সিলেট অঞ্চলের শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে শাবিপ্রবিতে ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীর ৩০ ভাগেরও বেশি শিক্ষার্থী সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের। সমাজবিজ্ঞান অনুষদের আটটি বিভাগে সিলেট অঞ্চলের শিক্ষার্থী শতকরা ৬৫ থেকে ৮০ ভাগ। ফলে দিন দিন প্রতিযোগিতা কমছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে, বাড়ছে বিভিন্ন আঞ্চলিক সংগঠনের দৌরাত্ম্য। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক শিক্ষক জানান, বিভিন্ন প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সমন্বিত পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলে এ বিশ্ববিদ্যালয় স্থানীয় ক্যাম্পাসের বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হবে।

জানা গেছে, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়েও স্থানীয় শিক্ষার্থীদের আধিক্য রয়েছে। একটি সূত্র জানায়, ইংরেজি বিভাগের ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৩০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী রয়েছে বরিশাল জেলার। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কবি নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও পার্শ্ববর্তী জেলার শিক্ষার্থীদের আধিক্য রয়েছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. মো. আখতার হোসেন বলেন, দেশের অনেক শিক্ষার্থী আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ইত্যাদির কারণে কাছের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার আগ্রহ দেখায়। এটিই অন্যতম কারণ। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, কেন্দ্রীয়ভাবে ভর্তি পরীক্ষা নিতে পারলে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে সারা দেশের শিক্ষার্থীদের সম্মিলন ঘটত। শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতা, পরিচালনায় দক্ষ প্রশাসক, রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা-সহিংস পরিবেশ এড়াতে পারলে ভালো মানের শিক্ষার্থীরা সব বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ গ্রহণে উদ্বুদ্ধ হবে।

সর্বশেষ খবর