রবিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

জোট আছে ঐক্য নেই

জোটের রাজনীতি ভোটের রাজনীতি রাজশাহী

কাজী শাহেদ, রাজশাহী

জোট আছে ঐক্য নেই

রাজশাহীতে জোটের রাজনীতি কাগজে-কলমে আছে ঠিকই কিন্তু বাস্তবে তার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন। ক্ষমতাসীন ১৪-দলীয় জোটের প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির দুই শীর্ষ নেতার মধ্যে শীতল সম্পর্কের কারণে জোটের রাজনীতিতে ঐক্যের বদলে ‘একলা চলো নীতি’ প্রাধান্য পাচ্ছে।

একই অবস্থা ২০-দলীয় জোটে। জামায়াত জোটে আছে কিন্তু বিএনপি তাদের কোনো কর্মসূচিতে জামায়াতকে রাখছে না। আর বাম দল ১৪-দলীয় ও সিপিবি-বাসদ জোটে ঐক্যবদ্ধ হলেও, সারা দেশের মতো রাজশাহীতেও জনগণের মধ্যে তাদের তেমন প্রভাব নেই। রাজশাহী সদর আসনটিতে গত দুই জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন ১৪-দলীয় জোটের মনোনয়ন পান বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা। এমপি হয়ে তিনি সাংগঠনিকভাবে নিজের দলকে শক্তিশালী করতে মাঠে আছেন। তবে খবর নেই ১৪-দলীয় জোটের। বাদশা ও আওয়ামী লীগের লিটনের শীতল সম্পর্কের কারণে এখানে ‘একলা চলো নীতি’তে চলছে ১৪ দল। ফলে আগামীতে জোট ও ভোটের রাজনীতিতে ১৪ দল সংকটে পড়বে বলে মনে করেন তৃণমূলের নেতারা। নগরীতে ১৪ দলের কমিটি থাকলেও জেলায় তা ছিল না। তবে সম্প্রতি ওমর ফারুক চৌধুরী এমপিকে সমন্বয়ক করে জেলা কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিন্তু সেই কমিটিও মাঠে নেই। কমিটিতে অধিকাংশ সদস্যই আওয়ামী লীগের। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ জানান, আগে ১৪ দলের যে কমিটি ছিল তাতে জেলার নেতাদের অংশগ্রহণ ছিল না। ফলে তারা আলাদা কমিটি করেছেন। আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য দলগুলোর ভোট তেমন না থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হিসেবে তারা কাজ করছেন। জোট ও ভোটের রাজনীতিতে তারা সহায়ক হিসেবে কাজ করবেন বলে মনে করেন তিনি।

দীর্ঘদিন অকার্যকর থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে দেশব্যাপী সন্ত্রাসী-জঙ্গি হামলার পর কিছুটা চাঙ্গা হয় ১৪ দল। কিন্তু একটি সভা করার পর আবার হিমঘরে তাদের কর্মসূচি। রাজনৈতিক দলের নেতারা মনে করেন, বাদশা-লিটনের শীতল সম্পর্কের কারণে এখানে ১৪ দল কার্যকর নয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক রাজনৈতিক দলের নেতা জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে ওয়ার্কার্স পার্টির দূরত্ব বেড়েছে। ক্ষমতায় থাকার সুবাদে ফজলে হোসেন বাদশা ওয়ার্কার্স পার্টিকে সংগঠিত করতে কাজ করছেন। ফলে ১৪ দলের নিয়মিত বৈঠকও হয় না। নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শফিকুর রহমান বাদশা জানান, ১৪ দল মূলত কার্যকর নয়। নামেই আছে সেই কমিটি। কার জন্য বা কেন ১৪ দল কার্যকর নয়, সে প্রসঙ্গে কোনো মন্তব্য করতে চাননি তিনি। তবে জোটের প্রয়োজনে ১৪ দলকে কার্যকর করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। নগর ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক দেবাশীষ প্রামাণিক দেবু জানান, তারা দলকে শক্তিশালী করতে মাঠে কাজ করে যাচ্ছেন। বিভিন্ন দল থেকে ওয়ার্কার্স পার্টিতে এ সময়ে যোগদানও করেছেন অনেকে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু বিষয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের বিরোধ আছে স্বীকার করে বলেন, ‘আমাদের নেতা রাজপথে ও সংসদে তার দায়িত্ব পালন করছেন। নগরীর বিভিন্ন উন্নয়নে ভূমিকা রাখছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতারা তা স্বীকার করতে চান না। এ কারণে আমাদের দুঃখ আছে।’ ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা জানান, নানা ইস্যুতে ১৪ দলকে কার্যকর করার উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি। কিন্তু আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি। লিটনের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো আছে জানিয়ে এই নেতা বলেন, ‘একটি মহল আমাদের সম্পর্কের ফাটল খুঁজে ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করছে।’ সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে মামলায় ভারাক্রান্ত রাজশাহী জেলা ও নগর বিএনপি। বর্তমান সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর থেকে মূলত জামায়াতকে নিয়ে কোনো কর্মসূচি পালন করেনি দলটি। জামায়াত থাকলেই মামলায় পড়ছেন বিএনপি নেতারা। আর এ কারণে রাজশাহী জেলা ও মহানগরে জামায়াতকে পাশ কাটিয়ে কর্মসূচি পালন করছে বিএনপি।

তবে বিএনপি নেতারা জানিয়েছেন, ২০ দলের শরিক হিসেবে জামায়াত এখনো বিএনপির সঙ্গেই আছে। ভোটের রাজনীতিতেও তারা বিগত সময়ে অংশ নিয়েছে। কৌশলগত কারণে এখন জামায়াত বিএনপি থেকে কিছুটা দূরে আছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনের শুরু থেকে নগর ও জেলা বিএনপির নেতা-কর্মীদের নামে একের পর এক মামলা হতে থাকে। বর্তমানে নগর ও জেলা বিএনপির প্রায় ৫০ হাজার নেতা-কর্মীর নামে ২৫০টিরও বেশি মামলা আছে। এসব মামলার বেশির ভাগের বাদী পুলিশ। পুলিশ হত্যা থেকে শুরু করে মাদকদ্রব্য আইনেও বিএনপি নেতা-কর্মীদের নামে মামলা দেওয়া হয়েছে। এসব মামলা রাজনৈতিক হয়রানি বলে দাবি করেছেন নগর ও জেলা বিএনপির নেতারা। তবে এসব মামলার অধিকাংশই ছিল জামায়াতের আন্দোলন।

নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল হক মিলন জানান, কেন্দ্রীয়ভাবে জামায়াত এখনো বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ। ফলে এখানেও তাদের অংশগ্রহণ আছে। এ অঞ্চলে জামায়াতের ভোটব্যাংক আছে, যা বিএনপির জন্য লাভজনক। মাঠের রাজনীতিতে একসঙ্গে না থাকলেও জোটবদ্ধভাবে এখনো আছে বলে মনে করেন তিনি।

 

যুদ্ধাপরাধ মামলায় জামায়াতের একাধিক নেতার রায় কার্যকর হওয়ার পর স্থানীয় বিএনপি নেতারা কোনো প্রতিক্রিয়া না জানানোয় কিছুটা ক্ষুব্ধ জামায়াত। তবে জেলা বিএনপির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন উজ্জ্বল জানান, জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক ভালোই আছে। দূরত্ব হয়েছে বলে মনে করেন না তিনি।

জামায়াত ইস্যু ছাড়াও সদ্য ঘোষিত বিএনপির কমিটি নিয়ে ক্ষোভ আছে স্থানীয় নেতাদের। গুরুত্বপূর্ণ পদ না পাওয়ায় দীর্ঘদিন রাজশাহী বিএনপির রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিয়ে আসা মিনু ও নাদিম কিছুটা ক্ষুব্ধ। জামায়াতের কারণে বিএনপির বহু নেতা-কর্মী মামলায় আসামি হয়েছেন, তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের এমন দাবি থাকলেও আপাতত এ নিয়ে কথা বলতে চান না নগর বিএনপির সভাপতি মিজানুর রহমান মিনু। আর জেলা বিএনপির সভাপতি নাদিম মোস্তফা জানান, কেন্দ্রীয়ভাবে বিএনপি যে সিদ্ধান্ত নেবে, তারা তা ফলো করবেন। ২০ দলের ঐক্য অটুট আছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘সরকারের এমন দমন-পীড়নের পরও আমরা তো মাঠ ছেড়ে যাইনি।’

বিগত নির্বাচনগুলোয় বিএনপির কাছে জামায়াত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিলেও স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচন জোটবদ্দভাবেই তারা করেছে। দলীয় প্রতীকের বাইরে কয়েকটি এলাকায় জামায়াতকে সমর্থন দিয়েছে বিএনপি। আবার বিএনপিকে সমর্থন দিয়েছে জামায়াত। ফলে আন্দোলনে জামায়াতকে বাইরে রাখলেও ভোটের রাজনীতিতে বিএনপির সঙ্গে আছে তারা। ছোটখাটো কিছু কর্মসূচি পালন ছাড়া রাজশাহীতে বাম দলগুলো মূলত কাগজে-কলমে। ন্যাপ, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটে। সিপিবি, বাসদ বাইরে থেকে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। তবে ভোটের রাজনীতিতে বাম দলগুলোর প্রভাব নেই বললেই চলে।

স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোয় দু-একটি জায়গায় বাম দলগুলোর পক্ষ থেকে প্রার্থী দেওয়া হলেও তারা কোনো প্রভাবই ফেলতে পারেনি। ফলে জোটের ভিতরে যারা আছে তাদের ভরসা বড় দলগুলো। আর জোটের বাইরে যারা আছে, তাদের ভরসা কর্মসূচি।

রাজশাহীতে একমাত্র ওয়ার্কার্স পার্টি ছাড়া অন্য বাম দলের সাংগঠনিক তত্পরতা নেই বললেই চলে। আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে চলাফেরা জাসদের। ওয়ার্কার্স পার্টির সঙ্গে মিশেছে সাম্যবাদী দল। সিপিবি ও বাসদ মাঝে মাঝে মিছিল করে নিজেদের অবস্থান জানান দেওয়ার চেষ্টা করে।

নগরীর সাহেববাজার জিরো পয়েন্ট মোড়ে ওয়ার্কার্স পার্টির কার্যালয়। এমপি ফজলে হোসেন বাদশা এলেই কার্যালয়টিতে নেতা-কর্মীর ব্যাপক ভিড় হয়। দ্বিতীয় দফায় ফজলে হোসেন বাদশা এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের সঙ্গে মতবিরোধ বাড়ে। এ সুযোগে ওয়ার্কার্স পার্টি নগরীতে তাদের অবস্থান শক্ত করেছে। সরকারি বিভিন্ন বরাদ্দ, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বাদশার উপস্থিতি ব্যাকফুটে ফেলে দিয়েছে নগর আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকে।

নগর ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক দেবাশীষ প্রামাণিক দেবু জানান, ওয়ার্কার্স পার্টি ছাড়া রাজশাহীতে অন্য বাম দলগুলোর তেমন কার্যক্রম নেই। তারা দলকে শক্তিশালী করতে মাঠে কাজ করে যাচ্ছেন। বিভিন্ন দল থেকে ওয়ার্কার্স পার্টিতে এ সময়ে যোগদানও করেছেন অনেকে। আগের চেয়ে রাজশাহীতে তাদের অবস্থান অনেক শক্তিশালী বলে তিনি মনে করেন।

নগর জাসদের সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল মাসুদ শিবলী জানান, তারা ১৪ দলের মধ্যে থেকে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করছেন। জাসদের মধ্যে বিরোধ আছে স্বীকার করে বলেন, ‘যারা বিরোধ করছেন, তাদের অন্য নামে কর্মসূচি পালন করতে হবে। জাসদের নাম তারা ব্যবহার করতে পারবেন না।’

বাসদের জেলা আহ্বায়ক দেবাশীষ রায় জানান, তারা আগামী নির্বাচন সামনে রেখে মাঠে কাজ করছেন। সিপিবি-বাসদ জোট গণতান্ত্রিক সব আন্দোলনে মাঠে আছে। সাংগঠনিকভাবে এই জোট শক্তিশালী হলেও ভোটের মাঠে কিছুটা দুর্বল। তবে সেটি কাটিয়ে উঠতে তারা কাজ করছেন।

সর্বশেষ খবর