রবিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

অবিশ্বাসেই থমকে আছে বাম দলগুলোর ঐক্য

ঐক্য করতে দফায় দফায় বৈঠক হলেও কাজ হচ্ছে না

রফিকুল ইসলাম রনি

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোট ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের বাইরে বাম গণতান্ত্রিক বিকল্প জোট গঠনের তত্পরতা চালালেও অবিশ্বাসেই থমকে আছে বাম দলগুলোর ঐক্য প্রক্রিয়া। ঐক্যের জন্য অনেকবার বৈঠক হলেও দলগুলোর মধ্যে ঐক্য হচ্ছে না। সিপিবি ও বাসদ বাম গণতান্ত্রিক বিকল্প শক্তি গড়ে তুলতে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় থাকলেও রাজনৈতিক আস্থাহীনতার কারণে অপেক্ষাকৃত ছোট দলগুলোকে কাছে টানতে পারছে না তারা। জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে গণফোরাম ও জেএসডি বেশ কিছু বাম দল ও বুদ্ধিজীবীকে নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করলেও সে প্রক্রিয়া বেশি দূর এগোয়নি। তবে আগামী নভেম্বরে জোট গঠনের প্রক্রিয়া দৃশ্যমান হতে পারে বলে ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত দুজন নেতা আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

বাম দল সূত্রে জানা গেছে, বামপন্থি দলগুলোর মধ্যে যুগপৎ আন্দোলনের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে এবং অপরাপর দলগুলোকে আন্দোলনে যুক্ত করে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে আলোচনা ও মতবিনিময় করে যাচ্ছেন সিপিবি ও বাসদ নেতারা। অন্যদিকে ড. কামালের নেতৃত্বাধীন গণফোরাম এবং আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে দুই জোটের বাইরে বাম দলগুলোর পাশাপাশি সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আগস্ট মাসে জেএসডি সভাপতি আ স ম রবের বাসায় এবং সেগুনবাগিচায় একটি রেস্তোরাঁয় পৃথক দুটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে গণফোরাম, বাসদ, নাগরিক ঐক্য ছাড়াও কয়েকটি বাম দলের প্রতিনিধি এবং কয়েকজন বুদ্ধিজীবী উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে দুই জোটের বাইরে আলাদা জোট গঠনের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হলেও কোন প্রক্রিয়ায় বা কারা থাকবেন সেই জোটে এমন চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি তারা। পাশাপাশি বর্তমানে আটটি দলের সমন্বয়ে পরিচালিত গণতান্ত্রিক বাম মোর্চাও একই লক্ষ্যে তত্পর রয়েছে। গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট লীগ, বাসদ (মাহবুবুল হক), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন ও শ্রমিক-কৃষক সমাজবাদী দল মহাজোটের শরিকদের বাইরে বামদের বৃহৎ এই জোটের শরিক। এ ছাড়া বদরুদ্দীন উমরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল, নয়া গণতান্ত্রিক গণমোর্চা ও জাতীয় গণতান্ত্রিক গণমুক্তি মিলে ঐক্যবদ্ধ বাম বিকল্প জোট গঠনেও সক্রিয় রয়েছে বলে জানা গেছে। তবে চারটি পক্ষ পৃথকভাবে প্রায় একই রকম উদ্যোগ নিলেও এখন পর্যন্ত বড় ঐক্য প্রক্রিয়া গড়ে ওঠেনি।

জানা গেছে, চার ধারায় বিভক্ত বামজোট একসময় স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে একসঙ্গে রাজনীতি করেছে। ১৯৯০-এর গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার পর ১৯৯৪ সালে বামপন্থি দলগুলো গঠন করে বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট। সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি নিয়ে জোটটি তোপখানা রোডে শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দলের অফিসেই তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করত। সে সময় বড় দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে বিকল্প শক্তি হিসেবে বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট ব্যাপক আলোচনায় আসে। জনস্বার্থবিরোধী বিভিন্ন ইস্যুতে দেশব্যাপী নানা কর্মসূচিও পালন করে বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পর বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের শরিক দল জাসদ আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভায় যোগদান করায় ঐক্য প্রক্রিয়া নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। তখন জোটের অন্য দলগুলো আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি মোকাবিলায় গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল অন্য তিনটি দল নিয়ে ১১ দল নামে আরেকটি জোট গঠন করে। দল তিনটি হলো—গণফোরাম, গণতন্ত্রী পার্টি, গণআজাদী লীগ। সে সময় বলা হয়, বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট সমাজের আমূল পরিবর্তনের জোট আর ১১ দল দুই দলের বাইরে বিকল্প শক্তি সমাবেশ ও ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনের জোট। এ জোটটির শরিক পাঁচটি দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে ২০০৮ সালে নির্বাচনী জোট করলে তাও নষ্ট হয়ে যায়। এখন পৃথকভাবে কর্মসূচি পালন করছে দলগুলো। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোট ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের বাইরে আবারও আলাদা প্লাটফরম গঠনের প্রক্রিয়ায় নিজেদের মধ্যে দফায় দফায় বৈঠক করা হলেও বেশি দূর এগোয়নি নিজেদের অবিশ্বাস-সন্দেহের কারণে। এ প্রসঙ্গে সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘জোট গঠনের প্রক্রিয়ায় আমরা বিভিন্ন দলের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে। সময় হলেই সবকিছু জানানো হবে।’

জেএসডি সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন বলেন, ‘মানুষ দুই জোটের বাইরে তৃতীয় শক্তি চায়। তৃতীয় শক্তির লক্ষ্য নিয়েই আমরা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করছি। কোরবানি ঈদের কারণে জোট প্রক্রিয়া কিছুটা ঝিমিয়ে পড়েছে। চলতি মাসসহ অক্টোবরেও আলোচনা হবে।’ নভেম্বরে কিছুটা রেজাল্ট আসতে পারে বলে জানান তিনি।

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা বাম মোর্চার মাধ্যমে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছি। এ ছাড়া দুই জোটের আলাদা জোট গঠনের জন্য গণফোরাম, জেএসডি, বাসদ, নাগরিক ঐক্যের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চলছে। অনেকটা ফলপ্রসূও হচ্ছে। আরও আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। নিজেদের মধ্যে ভিন্নমত থাকলেও একসঙ্গে কীভাবে কাজ করা যায় বা জোট গঠন করা যায় তা কয়েক মাসের মধ্যেই চূড়ান্ত করতে পারব।’

গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার নেতা ও গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘আমরা গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল সব শক্তির ঐক্য চাই। এ ঐক্যটা হবে বর্তমান স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের অগণতান্ত্রিক আচরণের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ভেতর দিয়ে। দ্বিদলীয় বৃত্তের বাইরে জনগণের ঐক্য গড়ে তোলার জন্য আমরা কাজ করছি।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের ভেতর অনেকের লক্ষ্য ও বিষয়বস্তু নিয়ে মতপার্থক্য বা বোঝাপড়ার ভুল-বোঝাবুঝি থাকলেও দ্রুতই জোট গঠন করা সম্ভব হবে বলে আমি আশাবাদী।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে জোট প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত একটি বাম দলের গুরুদায়িত্বে থাকা নেতা বলেন, ঐক্যের প্রশ্ন এলে প্রথমেই বলতে হয়, ঐক্যটা কার বিরুদ্ধে। শুধু যে দুই দলের বিরুদ্ধে ঐক্য হবে তা নয়। এ দুই দলের বাইরে থাকা অনেক দল আছে, যারা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতের দালাল। তাই আমরা শুধু ক্ষমতার জন্য ঐক্য চাই না। আমরা চাই সমাজের আমূল সংস্কার। এ জন্য প্রয়োজন বিপ্লব।’

সর্বশেষ খবর