সোমবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

চামড়ার বাজারে বিশৃঙ্খলা

বিস্ময়কর দরপতনের নেপথ্যে কারা?

আহমদ সেলিম রেজা

এবার কোরবানির চামড়ার দরপতন বিস্ময়কর। সরকারি দরের চেয়েও চামড়ার বাজার দর ছিল কম। ৮২ হাজার টাকার বড় গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে ৮০০ টাকায়। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা আড়তে নিয়ে তা বিক্রি করতে পেরেছেন ১২০০ টাকায়। অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ী, মাদ্রাসা ও এতিমখানা চামড়া কিনে পড়েছে বিপাকে। এবার ট্যানারির পক্ষ থেকে রাজধানীর অনেক জায়গায় ট্রাক নিয়ে আগের মতো পাইকার বা কারখানার প্রতিনিধিরা চামড়া নিতে আসেননি। ফলে চামড়া কিনে তা বিক্রি করতে তাদের ঘুরতে হয়েছে ঘাটে ঘাটে। এভাবে ধপাস করে চামড়ার দাম পড়ে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হয়েছেন এই চামড়ার পয়সার প্রকৃত হকদার গরিব মানুষেরা।

চামড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ট্যানারি মালিকরা এখনো চামড়া কেনাই শুরু করেননি। আগামী সপ্তাহ থেকে শুরু হবে চামড়া কেনাবেচা। তাহলে চামড়া কিনল কে? চামড়ার দাম রেকর্ড পরিমাণ কমাল কারা? এ বিষয়ে কেউ অজুহাত তুলছেন নগদ টাকার সংকটের। আবার কেউ অজুহাত তুলছেন গত বছরের কেনা চামড়া বিক্রি হয়নি এখনো। আটকে গেছে বিনিয়োগ। এ ছাড়া নির্ধারিত সময়ে ট্যানারি সরাতে না পারায় আদালতের নির্দেশে জরিমানা হিসেবে দেওয়া টাকা, হেমায়েতপুরে বিনিয়োগ আটকে যাওয়াসহ নানা কারণে এবার টার্গেট করা হয়েছে চামড়াকেই। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, চামড়া শিল্পে জড়িতরা নিজেদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চামড়া শিল্পের মালিক, ফড়িয়া, আড়তদার, কমিশন এজেন্ট সবাই একজোট হয়েছেন। সবার যোগসাজশেই এবার চামড়ার দাম ‘নামিয়ে ফেলা’ হয়েছে। নানা অজুহাত তুলে আসলে থমকে দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশে চামড়ার বাজার। ফলে এবার বাড়ছে চামড়া পাচারের আশঙ্কা। চামড়ার দর পড়ে যাওয়ার নেপথ্য কারণ হিসেবে চামড়া ব্যবসায়ীরা দায়ী করলেন আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার দাম পড়ে যাওয়াকে। এ ছাড়া ভারতের মন্দা চামড়া বাজারকেও দায়ী করছেন অনেক চামড়া ব্যবসায়ী। সেখানেও নগদ টাকার অভাবে এবার অনেক চামড়া ব্যবসায়ী মূলধন ঘাটতিতে পড়েছেন। বাংলাদেশেও মূলধনের ঘাটতি রয়েছে। ব্যাংক থেকে পাওয়া ঋণ সহায়তাও চাহিদার তুলনায় নগণ্য বলে মনে করেন চামড়া ব্যবসায়ীরা। এদিকে বরাবরের মতো চামড়ার বাজারকে নিজেদের খেয়ালখুশিমতো উঠবোস করানোর অভিযোগ উঠেছে ট্যানারি মালিকদের বিরুদ্ধে। প্রাথমিকভাবে লবণের দাম খুব বেশি— এই প্রথম ভয়টা দেখান তারা। এ কারণে চামড়া সংরক্ষণের জন্য সরকার গণহারে লবণ আমদানির অনুমোদন দেয় এবং চামড়ার দাম কম নির্ধারণ করে। তা সত্ত্বেও সরকার নির্ধারিত হারে চামড়া কেনেননি ট্যানারি মালিকরা। এমনকি অভিযোগ উঠেছে গতবারের চামড়ার টাকাও অনেক আড়তদার চামড়া ব্যবসায়ীদের সম্পূর্ণ পরিশোধ করেননি। চামড়া শিল্পের অনেক মালিক হাজার হাজার কোটি টাকার চামড়া বাকিতে কেনার পর বকেয়া শোধ না করে নির্বিকার বসে আছেন। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. সাখাওয়াত উল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার দর কমে যাওয়াতে এবার আমাদের বাজারে তার প্রভাব পড়েছে। গত বছর কোরবানির ঈদের আগে যেখানে চামড়ার দর ছিল ১০৬ ডলার, সেখানে গত জুলাইয়ে তা নেমে গেছে ৭০ ডলারে। চামড়া বাজারে সিন্ডিকেশনের বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি বলেন, চামড়া কেনা তো শুরুই করেননি ট্যানারি মালিকরা। আগামী সপ্তাহে পুরোদমে শুরু হবে চামড়ার কেনা-বেচা। সরকার নির্ধারিত দামেই কেনা হবে। তিনি বলেন, ঈদের দিন ট্যানিরা মালিকরা চামড়া কেনেন না। ব্যাপারী, ফড়িয়া বা কমিশন এজেন্টরা কাঁচা চামড়া কিনে তা লবণ দিয়ে প্রক্রিয়াজাত করেন। পরে তা ট্যানারি মালিকরা তাদের কাছ থেকে কিনে নেন। আমরা তো এখনো চামড়া কেনা শুরুই করিনি। চামড়া কেনা হবে আগামী সপ্তাহ থেকে। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা তাদের মতো করে চামড়া কেনেন। ফলে দাম না পাওয়ার অভিযোগ মানতে নারাজ অ্যাসোসিয়েশন। তবে তিনি চামড়া শিল্পে নগদ অর্থ সংকটের কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, পুঁজির একটা সংকট আমাদের রয়েছে। চামড়া শিল্পনগরীতে আমাদের ১২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হয়েছে। সেখানে ব্যাংক আমাদের কোনো টাকা দেয়নি। কারণ সরকার প্লট উন্নয়ন করেছে। তবে আমাদের কাছে এখনো প্লট হস্তান্তর করেনি। তাই আমরা সেখানে ব্যাংক ঋণ পাচ্ছি না। আবার চামড়া কেনার জন্য যে ঋণ দেওয়া হচ্ছে তা প্রয়োজনের তুলনায় কম। গত বছরের দেওয়া ঋণের তুলনায় মাত্র ১০ ভাগ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আসলে এ খাতে একটি বিশৃঙ্খলা চলছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। বাজারে পাইকারদের বকেয়ার বিষয়টি স্বীকার করলেও তার পরিমাণ কম বলে দাবি করেন তিনি।

কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় সম্প্রতি প্রকাশিত এ রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘দীর্ঘ দিন যাবৎ গরু নিয়ে রাজনীতি করতে গিয়ে ভারতের চামড়া শিল্প অভ্যন্তরীণ সমস্যায় ভুগছে। গরু জবাই বন্ধের ফলে কাঁচা চামড়ার জোগানে ঘাটতি, আমদানিনিভর্রতা, ব্যবসায়ীদের মূলধনে ঘাটতি দেখা দিয়েছে।’ কলকাতা লেদার ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তা ইমরান আহমেদ খানকে উদ্ধৃত করে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, আমদানি বেড়ে যাওয়ায় নগদ অর্থের সংকট হচ্ছে। কারণ, অন্য রাজ্য থেকে কাঁচা চামড়া কেনার অর্থ নগদে পরিশোধ করতে হতো না। কিন্তু বিদেশ থেকে আমদানির ফলে নগদে অর্থ পরিশোধের পরেই সেই কাঁচামাল হাতে আসছে। ফলে বাধ্য হয়ে উৎপাদন কমিয়েছে অনেক ব্যবসায়ী।

চাতুরি : অনেকেই মনে করছেন, নগদ অর্থের জোগান কম থাকায় পুরোপুরি থমকে দাঁড়িয়েছে চামড়ার বাজার। চামড়া পাচারের আশঙ্কা বাড়ছে। তবে এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করে এক চামড়া ব্যবসায়ী জানান,  চামড়া পাচারের অভিযোগ তোলেন চামড়া ব্যবসায়ীরা নিজেরাই, নিজেদের স্বার্থে। যাতে সিন্ডিকেটের বাইরে নতুন কেউ কাঁচা চামড়া রপ্তানির বাজারটা ধরতে না পারেন। সরকারিভাবেও কাঁচা চামড়া রপ্তানি বন্ধ রাখা হয়েছে। এক্ষেত্রে শিল্প মালিক, পোস্তার আড়তদার, ফড়িয়া, চামড়া মজুদদার, কমিশন এজেন্ট সবাই এক জোট। মূল লক্ষ্য— সম্মিলিত সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চামড়ার দাম কমিয়ে বাজার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখা। হেমায়েতপুরে আধুনিক ট্যানারির কাজ করতে পারছে না, ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করছে না। এ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে আরও জানা যায়, চামড়া বিক্রি  হচ্ছে না অজুহাতে ব্যাংক থেকে শত শত কোটি টাকা ঋণ নিয়েও অনেক শিল্পপতি, আড়তদার ও মজুদদাররা চামড়ার ব্যাপারীদের বকেয়া টাকা পরিশোধ করছেন না। ব্যাংকের টাকাও সময়মতো পরিশোধ করছেন না। এ খাতে যেন অঘোষিত একটি অরাজক অবস্থা তৈরির চেষ্টা। সংশ্লিষ্ট অনেকে মনে করেন, এটা বাংলাদেশের চামড়া খাতকে ধ্বংস করার একটা পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের অংশ। যদি চামড়া বিক্রি না হয় তাহলে ব্যবসায়ীরা ওয়েটব্লু চামড়া রপ্তানির অনুমতি চাইছে না কেন? ওয়েট ব্লুর বাজার মন্দা হলে লেদারকে ফিনিশ করে বিদেশে রপ্তানি বাড়াচ্ছে না কেন? সরকার চামড়া শিল্পকে রক্ষার দায়িত্ব নিয়ে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। ফলে সরকারের নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও রপ্তানিযোগ্য বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী চামড়া শিল্প আজ হুমকির মুখে।

সর্বশেষ খবর