মঙ্গলবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

ব্লগার হত্যাকাণ্ডের বিচারে গতি নেই

এখনো চলছে তদন্ত চার্জশিট হয়নি

মাহবুব মমতাজী

দেশে ২০১৩ সালে ব্লগার হত্যার মধ্য দিয়ে একের পর এক চলে বিভিন্ন নির্মম হত্যাকাণ্ড। এর মধ্যে লেখক, সাহিত্যিক, ব্যবসায়ী ও গৃহবধূ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটতে থাকে। এখন পর্যন্ত ব্লগার রাজীব হত্যা মামলার রায় ছাড়া আর কোনো মামলার অগ্রগতি নেই বলে পরিবারের অভিযোগ। মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশও তেমন কিছু জানে না। সব কিছুর তদন্ত মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ করছে বলে জানান তারা। রাজীব হত্যাকাণ্ড ছাড়া বাকিগুলোর তদন্ত এখনো চলছে এবং সেগুলোর চার্জশিট কবে নাগাদ দেওয়া হবে তাও নিশ্চিত করে জানাতে পারেনি মহানগর পুলিশ।

অভিযোগ রয়েছে, এখন পর্যন্ত মোট পাঁচজন ব্লগারকে তাদের লেখালেখির কারণে হত্যা করা হলেও একটি বাদে কোনো মামলারই চোখে পড়ার মতো অগ্রগতি নেই।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি যখন যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ বিচার ফাঁসির দাবিতে উত্তাল শাহবাগের আন্দোলন; ঠিক তখন আন্দোলনেরই এক কর্মী রাজীব আহমেদ দুর্বৃত্তদের চাপাতির আঘাতে নিহত হন। এ হত্যাকাণ্ডটিই ছিল ব্লগে লেখালেখির অপরাধে বাংলাদেশে প্রথম কোনো হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। তাতে জড়িত সন্দেহের ভিত্তিতে সাতজনকে আটক করে পুলিশ এবং তদন্ত শেষে হত্যাকাণ্ডের ১১ মাস পর আদালতে অভিযোগপত্র দায়ের করা হয়। এ ঘটনার পর গত বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি মুক্তমনা নামে একটি ব্লগ সাইটের প্রতিষ্ঠাতা বিজ্ঞানবিষয়ক লেখক অভিজিৎ রায়ও নিহত হন দুর্বৃত্তদের হামলায়। সঙ্গে স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাও মারাত্মক আহত হন। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে শফিউর রহমান ফারাবী নামে একজনকে আটক করে পুলিশ। ওই ঘটনার পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইর একটি প্রতিনিধি দল তদন্তের জন্য ঢাকা আসে। ২০ জুন বন্দুকযুদ্ধে অভিজিৎ হত্যা  মামলার প্রধান সন্দেহভাজন আসামি শরিফ নিহত হয়েছেন। অভিজিৎ হত্যা তদন্তে সিসিটিভির ফুটেজে শরিফের উপস্থিতি ধরা পড়ে বলে জানানো হয়। অভিজিৎ রায় হত্যার এক মাসের মধ্যে ৩০ মার্চ ব্লগার ওয়াশিকুর রহমানকে রাজধানীর তেজগাঁওয়ের একটি সড়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ সময় হামলাকারীদের দুজনকে ধাওয়া করে পুলিশে দেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। তাদের একজনের স্বীকারোক্তি আদালতে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। তারা আরও জানায়, মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) মামলাটির তদন্ত করে। আর সেটির দ্রুত চার্জশিট দেওয়ার কথা থাকলেও তা পরে দেওয়া হয়নি। গত ৭ আগস্ট দুপুরে বাড়িতে ঢুকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় আরেক ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়কে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কাউকে আটক করা যায়নি। গত বছরের ৩১ অক্টোবর বিকালে আজিজ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলায় জাগৃতি প্রকাশনীর কার্যালয়ে ফয়সল আরেফিন দীপনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তিনি অভিজিৎ রায়ের ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ বইটি প্রকাশ করেছিলেন। দীপন হত্যার ঘটনায় গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ‘মূল হোতা’ সিফাত ওরফে শামীম ওরফে মঈনুল ইসলামকে টঙ্গী থেকে গ্রেফতার করেছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। গত বুধবার আদালতের মাধ্যমে ছয় দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয় সিফাতকে। ৬ এপ্রিল রাতে লক্ষ্মীবাজারের ঋষিকেশ দাস লেনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এলএলএম (আইন) বি সেকশনের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী নাজিমুদ্দিন সামাদকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ওই ঘটনায় সূত্রাপুর থানায় একটি হত্যা মামলা হয়। তবে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তপনচন্দ্র সাহা জানান, তিনি মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে কিছুই জানেন না। সেটি মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) তদন্ত করছে।

পুলিশ জানায়, অভিজিৎ রায়কে হত্যার ঘটনায় মামলা করেছেন তার বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক অজয় রায়। এ বিষয়ে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু বকর সিদ্দিক জানান, ‘এই মামলার তদন্তের সর্বশেষ পরিস্থিতি বলতে পারব না। কারণ মামলাটি তদন্ত করছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।’ ছেলে হত্যার বিষয়ে অভিজিতের বাবা অধ্যাপক অজয় রায় বলেন, ‘মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে পুলিশ আগে আমাকে কিছু না কিছু জানাত। এখন আর কিছু জানায় না। এই হত্যার তদন্ত বিষয়ে এফবিআই বলছে তাদের তদন্ত রিপোর্ট তারা দিয়েছে। কিন্তু এখানে পুলিশ বলছে তারা রিপোর্ট পায়নি। এই পরিস্থিতিতে ছেলে হত্যার সুষ্ঠু বিচারের অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই আমার। কারণ আমার নিজ থেকে কিছু করার মতো তো ইউটিলিটি নেই।’ দীপনের বাবা অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, ‘যারা আমার ছেলেকে মেরে ফেলেছে আমরা তাদের সুষ্ঠু বিচার চাই। আজ দীপন বেঁচে নেই। আমাদের পরিবারের সবাই ক্ষতিগ্রস্ত দীপনের মৃত্যুতে। সেই থেকে আমার নিজেকে অপরাধী মনে হয়। সেই হত্যাকাণ্ডের পর থেকে জড়িতদের ধরতে পুলিশ ও গোয়েন্দারা কাজ করছেন। সময় সময় পুলিশের ডেপুটি লেভেলের কর্মকর্তারা যে বক্তব্য দিয়েছিলেন তাতে অনেক অসঙ্গতি ছিল। তবে সর্বশেষ তারা বিষয়টি নিয়ে আরও জোরালো পদক্ষেপ নিয়েছে এবং প্রকাশিত ভিডিও ফুটেজে পাওয়া ছবি অনুযায়ী একজনকে আটক করেছে। এরপর তারা যে বক্তব্য দিয়েছে তাতে আমাদের আস্থা ফিরে এসেছে। সম্পূর্ণ বিষয়টি পুলিশ তদন্ত করছে। তদন্তে যারা প্রকৃত দোষী তাদের সুষ্ঠু বিচার যেন আদালতে হয় সেদিকেই আমরা চেয়ে আছি। তবে আমি বা আমার পরিবার বিচার চাওয়ার বিষয়ে নিজ থেকে কিছুই করবে না।’ আদালত সূত্রে জানা গেছে, ব্লগার রাজীব হত্যার ঘটনায় গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র পলাতক রেদোয়ানুল আজাদ রানা ও ফয়সাল বিন নাঈম দীপের ফাঁসির রায় দেয় আদালত। এ ছাড়া একজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান মুফতি মো. জসীমউদ্দিন রাহমানীসহ পাঁচজনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজার আদেশ দেওয়া হয়েছে। দুজনকে মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি ১০ হাজার টাকা জরিমানার আদেশও দেওয়া হয়। তবে আদালতের এই রায়ে সব আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন মামলার বাদী ও রাজীবের বাবা নাজিম উদ্দিন। বিচারিক আদালতে রায় হওয়ার পর মামলাটি উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ায়। জানতে চাইলে মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বলেন, ‘প্রতিটি ঘটনার মামলার অগ্রগতি আলাদা। আমরা কয়েকটি ঘটনায় জড়িতদের শনাক্ত করতে পেরেছি। তবে এখনো অভিজিৎ, নীলাদ্রি, নাজিমুদ্দিন ও ওয়াশিকুর হত্যা ঘটনার চার্জশিট দেওয়া হয়নি। সেগুলোর তদন্ত এখনো চলছে। কবে নাগাদ চার্জশিট দেওয়া হবে নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।’

সর্বশেষ খবর